মিরিয়ামকে নিয়ে সেখানে এলো নিকিতিন। মাটির ওপরে একটুখানি বের করা সরীসৃপ জাতের জন্তুর বিরাট কঙ্কালটা দেখে মিরিয়াম তো অবাক। জন্তুটা এক পাশ ফিরে পড়ে আছে। লম্বা লেজটা পিঠের নিচে পাকান, পেছনের বিরাট বিরাট পা দুটো মুড়ে রাখা। যে কয়টা হাড় সে দেখতে পাচ্ছে, তার প্রতিটিতেই নম্বর মারা—কশেরুকা, পাঁজরা এমন কি ভোঁতা ক্ষুরগুলোতে পর্যন্ত। জন্তুটার দুই মিটার লম্বা খুলিটা ক্রমশ মোটা হয়ে খোঁচা খোঁচা কাঁটা বসানো মস্ত কলারে পরিণত হয়েছে। চোখের গর্ত দুটোর ওপরে একজোড়া লম্বা শিং। আরেকটা শিং রয়েছে মস্ত পাখির ঠোঁটের মতো মুখের ওপরে।
‘এটা হচ্ছে ট্রিসেরাট্পস্, তিন শিংওয়ালা গাছপালাখেকো ডাইনোসর। শিকারী জন্তুদের সঙ্গে লড়ার জন্য তার যে অনেক অস্ত্রশস্ত্র ছিল, সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। নিকিতিন বুঝিয়ে বলতে লাগল, ‘কঙ্কালটা সম্পূর্ণ অক্ষত আছে। আমরা এটাকে তিন ভাগে আলাদা করে নিয়ে শক্ত ফ্রেমে আটকে রাখব,’ কাঠের বরগাগুলো দেখিয়ে নিকিতিন বলল, ‘ওপরে জিপসাম ছড়িয়ে দিয়ে কঙ্কালটাকে নিয়ে যাব। তারপর আমাদের ল্যাবরেটরিতে ওরা বাকি কাজটা সম্পূর্ণ করবে।’
‘যে শিকারী জন্তুদের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য এর এরকম ভয়াবহ সব অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন হতো, তাদের চেহারাটা না জানি কী রকম?’
‘এটা দেখে কিছুটা বুঝতে পারবেন,’ একটা বাক্স থেকে নিকিতিন প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা একটা চ্যাপ্টা দাঁত বের করল। দাঁতটার ধারগুলো খাঁজ কাটা, ডগাটা বাঁকানো। ‘এটা হচ্ছে টিকটিকি জাতীয় প্রাণীদের রাজা টিরানোসরের দাঁত। টিরানোসর আবার পেছনের পায়ে ভর দিয়ে হাঁটত। পাহাড়ের নিচেও আমরা শীগগিরি খোঁড়ার কাজ শুরু করব। মার্তিন মার্তিনভিচ তিনটা সশস্ত্র ডাইনোসরের কঙ্কাল সেখানে পেয়েছে। তাদের গায়ের চামড়া বর্মের মতো।
তার ওপরে কাঁটা। ঠিক যেন ট্যাংক। কেবল আধুনিক ট্যাঙ্কের মতো তাদের কামান নেই, কারণ কামান হচ্ছে আক্রমণের অস্ত্র। নিরামিষাশী জন্তু তার বর্ম আর শিং নিয়ে কেবল আত্মরক্ষার জন্যই লড়াই করে। নিজ থেকে এগিয়ে গিয়ে কখনো আক্রমণ করে না।’ পুবের গিরিবর্তের মুখে না ঢুকে মিরিয়াম বাঁয়ে বেঁকে পাহাড়ের নিচে ছড়ানো মস্ত মস্ত পাথরের ভেতর দিয়ে নিকিতিনকে নিয়ে গেল।
হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের পথ জুড়ে দাঁড়াল লাল কালো পাথরের একটা মস্ত দেয়াল। তার গায়ে একটা সরু গলি, কেউ যেন বিরাট তলোয়ার দিয়ে কেটে সেটা তৈরি করেছে। তার ওপর দুই পাশে দুটি পাথরের স্তম্ভ। সে দুটি অনেক উঁচুতে উঠে গিয়ে মাথার ওপরে প্রায় মিশে গেছে।
গলিটা বন্দুকের নলের মতো সোজা। দেয়ালগুলো বেশ মসৃণ আর পালিশ করা। শখানেক ফুট যাওয়ার পর মিরিয়াম আর নিকিতিন এসে পড়ল একটা ছোট্ট খোলা উপত্যকায়, চারপাশে তার খাড়া পাহাড়। উল্টোদিকটা অর্ধচন্দ্রাকারে বেঁকে গেছে, তার ঠিক মাঝে উঠে গেছে লালচে খয়েরী রঙের লম্বা চৌকো বালিপাথর। পায়ের কাছে গাদা হয়ে রয়েছে অনেক চ্যাপ্টা পাথর। পাথরগুলো বেশ বোঝা যায়, সম্প্রতি ভেঙে পড়েছে। লম্বা চৌকো পাথরটার এক কোণে চকমক করছে একটা মস্ত কালো আয়না।
নিকিতিন অবাক হয়ে চারদিকে চেয়ে রইল। মিরিয়াম শান্তভাবে বলল, ‘এই হচ্ছে এসফল্টের সঞ্চয়। আসলে বলা উচিত, লৌহবাহী বালিপাথরের মধ্যে সমস্তরে এরা সঞ্চিত। এই বালিপাথরের উৎপত্তি বোধ হয় বাতাস থেকে—তার মানে প্রাচীন বালিয়াড়ির জাতের। জলাশয়ে আমাদের ওই বিস্ফোরণের ফলে এখানকার পাহাড় ভেঙে প্রস্তরীভূত নতুন স্তর বেরিয়ে পড়েছে। এর মসৃণ ত্বক এখনও ক্ষয়ে যায়নি। আয়নার মতো চকচক করছে।’
‘বালিপাথরের সঞ্চয় কখন ঘটেছে বলে আপনার ধারণা?’ নিকিতিন কাল সময় নষ্ট না করে জিজ্ঞেস করল। ‘ডাইনোসরদের সমাধিক্ষেত্রের উৎপত্তির সময়েই হবে,’ মিরিয়াম জবাব দিল, ‘প্রাচীন পাহাড়ের এই উপত্যকায় সঞ্চয়গুলো খুব ভাল অবস্থায় রয়েছে।’ নিকিতিন বেশ খুসি হয়ে মাথা নেড়ে বড় বড় দানা, খড়খড়ে বালির ওপরেই বসে পড়ল। মিরিয়ামও তার প্রিয় ভঙ্গীতে তুর্কী চালে পা মুড়ে বসে পড়ল নিকিতিনের সামনে।
উপত্যকাটা চারপাশ থেকে পাহাড়ে ঢাকা, কিন্তু তবু কেন জানি না তেমন গরম নয়। চারপাশের গম্ভীর নিস্তব্ধতা মাঝেমধ্যে ব্যাহত হচ্ছে একটি ক্ষীণ শব্দে। এই স্বাভাবিক পাহাড়ে প্রাসাদকক্ষের মেঝেতে যে শুকনো ঘাস গজিয়েছে তার গায়ে বাতাসের মর্মর যেন স্ফটিকের ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে। এই করুণ মর্মরধ্বনি নিকিতিন আগে কখনো শোনেনি। তাই সে জিজ্ঞাসু চোখে মিরিয়ামের দিকে তাকাল।
মিরিয়াম মাথা নামিয়ে ঠোঁটের কাছে আঙুল চেপে ধরল। কানখাড়া করে নিকিতিন শুনতে পেল, আরেকটা শব্দ মিশে গেল সেই প্রায় অশ্রুত অস্ফুট নিক্কণে। সেটাও মনে হলো অনেক দূর থেকে ভেসে এলো, আওয়াজটা কিছু চাপা। নিকিতিন ভাবল, উপত্যকার মাটিতে গোল হয়ে যে ঝোপগুলো উঠেছে, সেখান থেকেই বুঝি এই আওয়াজ আসছে। নিস্তব্ধ মরুভূমির এই ক্ষীণ সংগীত নিকিতিনের মনটাকে কেমন বিষণ্ণ করে তুলল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।