ঢাকার ভ্যাবসা ছেড়ে যখন প্রথমবার বার্লিনের রাস্তায় দাঁড়ালাম, শীতের হিমেল হাওয়া গায়ে লাগার চেয়েও বেশি শিহরণ জাগালো মনে। এটাই তো স্বপ্ন! কিন্তু সেই স্বপ্নের মুহূর্তের আগে, বিমানবন্দরের চেক-ইন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে হঠাৎ খেয়াল হল – পাসপোর্ট তো আছে, কিন্তু ভিসা স্ট্যাম্প কি ঠিক জায়গায়? ট্র্যাভেল ইন্স্যুরেন্সের কাগজপত্র? সেই মুহূর্তের হতবিহ্বল চোখ আর দ্রুত ধড়ফড় করা হৃদয় ভুলিনি কখনো। বিদেশ ভ্রমণে কি কি লাগে – এই প্রশ্নটার উত্তর শুধু চেকলিস্টের আইটেম নয়; এটা স্বস্তির নিশ্চয়তা, নিরাপদে ঘুরে আসার ভিত্তি, আর সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তির অনুভূতি। প্রতিটি টিক মার্কই যেন বলে, “তুমি প্রস্তুত, এখন উপভোগ করো।” এই গাইডে শুধু তালিকা নয়, শেয়ার করব অভিজ্ঞতার আলোকে সেই অপরিহার্য প্রস্তুতি, যা তোমার বিদেশ যাত্রাকে করবে নির্বিঘ্ন আর স্মরণীয়।
বিদেশ ভ্রমণে কি কি লাগে: অপরিহার্য ডকুমেন্টেশন – তোমার পরিচয়পত্র ও যাত্রার চাবিকাঠি
কাগজপত্র ছাড়া আধুনিক বিশ্বে এক পা-ও ফেলা যায় না, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ভ্রমণে। এগুলো শুধু ফর্মালিটি নয়, তোমার আইডেন্টিটি ও যাত্রার বৈধতার প্রমাণপত্র। ভুলে গেলে বা অসম্পূর্ণ থাকলে বিমানবন্দরেই থমকে যেতে পারে স্বপ্নভরা যাত্রা। চলো, জেনে নিই কোন কোন ডকুমেন্টগুলো অত্যাবশ্যক:
- বৈধ পাসপোর্ট: এটাই তোমার বৈশ্বিক পরিচয়পত্র। খেয়াল রাখতে হবে:
- পাসপোর্টের মেয়াদ ভ্রমণ শেষে ফেরার তারিখের কমপক্ষে ছয় মাস অবশিষ্ট থাকতে হবে। অনেক দেশ এটা কঠোরভাবে মেনে চলে। যেমন, থাইল্যান্ড বা তুরস্কে ভ্রমণেও এই নিয়ম প্রযোজ্য।
- পাসপোর্টে কমপক্ষে দুটি ফাঁকা পৃষ্ঠা (ভিসা ও ইমিগ্রেশন স্ট্যাম্পের জন্য) থাকা বাধ্যতামূলক।
- পাসপোর্টের অবস্থা ভালো কিনা দেখে নাও – কোন ছেঁড়া, ক্ষতিগ্রস্ত পৃষ্ঠা, বা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অস্পষ্ট হলে সমস্যা হতে পারে। ঢাকার আগারগাঁও বা স্থানীয় পাসপোর্ট অফিস থেকে সময়মতো নবায়নের ব্যবস্থা করো।
- প্রয়োজনীয় ভিসা: গন্তব্য দেশে প্রবেশের অনুমতিপত্র। বিশেষভাবে মনে রাখবে:
- ভিসার ধরন: ট্যুরিস্ট ভিসা, বিজনেস ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসা – গন্তব্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী সঠিক ভিসা আবেদন করতে হবে। ইউরোপের শেঙেন ভিসা একবার পেলে একাধিক দেশে ভ্রমণ করা যায়, তবে আবেদন প্রক্রিয়া জটিল হতে পারে।
- আবেদন প্রক্রিয়া: ভিসা প্রক্রিয়া দেশভেদে ভিন্ন। হতে পারে অনলাইন আবেদন (e-Visa – যেমন তুরস্ক, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম), দূতাবাসে সরাসরি যোগাযোগ, বা অথোরাইজড ভিসা এজেন্সির মাধ্যমে (ভিএফএস গ্লোবাল বা ট্যাটা কনসাল্টেন্সি সার্ভিসেস)। দূতাবাসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস। ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের ওয়েবসাইটে (যেমন: জার্মান দূতাবাস, মার্কিন দূতাবাস) বিস্তারিত গাইডলাইন পাওয়া যায়।
- সময়সূচি: ভিসা প্রক্রিয়ায় সময় লাগে – কখনো কয়েক দিন, কখনো সপ্তাহ বা তারও বেশি (বিশেষ করে পিক সিজনে বা স্ক্রুটিনি বেশি হলে)। অন্তত ভ্রমণের ৩-৪ মাস আগে আবেদন শুরু করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ভিসা মঞ্জুরির তারিখও দেখে নিতে হবে – কোন কোন ভিসার নির্দিষ্ট প্রবেশের সময়সীমা থাকে।
- প্রয়োজনীয় কাগজপত্র: ভিসার জন্য সাধারণত পাসপোর্ট, ফিল্ড আপ ফটোগ্রাফ, ভ্রমণ ইতিবৃত্তান্ত, ফ্লাইট বুকিং (অস্থায়ী), হোটেল বুকিং কনফার্মেশন (বা ইনভিটেশন লেটার), আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ (ব্যাংক স্টেটমেন্ট/পাসবুক), চাকুরির সার্টিফিকেট বা ব্যবসার কাগজপত্র, এবং কভার লেটার লাগে। প্রতিটি কপি নির্দেশনা অনুযায়ী সঠিক সাইজে ও ক্লিয়ার হতে হবে।
- ভ্রমণ বীমা (ট্র্যাভেল ইন্স্যুরেন্স): অনেকের কাছে এটি অপচয় মনে হলেও, এটা একটি অপরিহার্য নিরাপত্তা বলয়। বিদেশে অসুস্থতা বা দুর্ঘটনায় চিকিৎসা খরচ অত্যন্ত উচ্চ হতে পারে। ভালো মানের ট্র্যাভেল ইন্স্যুরেন্স:
- চিকিৎসা ব্যয় (মেডিকেল ইমার্জেন্সি, হাসপাতালে ভর্তি), চিকিৎসক পরামর্শ ইত্যাদি কভার করে।
- ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্বের ক্ষতিপূরণ দিতে পারে।
- জরুরী অবস্থায় মেডিকেল ইভাকুয়েশনের খরচ বহন করে।
- পাসপোর্ট হারানো বা ব্যাগেজ হারানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করে।
- ভিসার আবশ্যকতা: ইউরোপের শেঙেনভুক্ত দেশসহ অনেক দেশে ট্র্যাভেল ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক। ভিসা আবেদনের সময়ও এর প্রমাণপত্র দিতে হয়। বিমা কোম্পানির ওয়েবসাইট বা রেপুটেড এজেন্টের মাধ্যমে সহজেই কেনা যায়। পলিসির শর্তাবলী (কভারেজ লিমিট, এক্সক্লুশন) ভালো করে পড়ে নিতে হবে।
- আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের টিকিট: ভিসা আবেদনের সময় প্রায়ই ফ্লাইট বুকিংয়ের প্রিন্ট আউট বা ই-টিকেট কপি জমা দিতে হয়। ভ্রমণের তারিখ ও সময় ডাবল-চেক করো, বিশেষ করে টাইম জোনের পার্থক্যের কথা মাথায় রেখে। রিটার্ন টিকিট থাকলে ইমিগ্রেশনে প্রশ্ন কম হতে পারে।
- আবাসনের বুকিং কনফার্মেশন: হোটেল, হোস্টেল, বা এয়ারবিএনবি – যেখানেই থাকো না কেন, তার কনফার্মেশন লেটার বা ভাউচার প্রিন্ট করে সঙ্গে রাখো। ভিসা আবেদন ও ইমিগ্রেশন কাউন্টারে এটা প্রায়ই চাওয়া হয়। কনফার্মেশনে ঠিকানা ও যোগাযোগের নম্বর স্পষ্ট থাকতে হবে।
- আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ: ইমিগ্রেশন অফিসার প্রায়ই দেশে ফেরার সামর্থ্য বা ভ্রমণকালীন খরচ বহনের সামর্থ্য যাচাই করেন। সাম্প্রতিক ব্যাংক স্টেটমেন্ট/পাসবুক (সবগুলো পৃষ্ঠা), ক্রেডিট কার্ড স্টেটমেন্ট, বা নগদ টাকার প্রমাণপত্র (যেমন এফডি সার্টিফিকেট) সঙ্গে রাখা ভালো। টাকার অংক গন্তব্য দেশের ভ্রমণকালীন খরচের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত।
- ড্রাইভিং লাইসেন্স (যদি গাড়ি চালাতে চাও): বাংলাদেশী ড্রাইভিং লাইসেন্স অনেক দেশে স্বীকৃত নয়। আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট (আইডিপি) নেওয়া প্রয়োজন হতে পারে। ঢাকার বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে আইডিপি সংগ্রহ করা যায়। স্থানীয় ড্রাইভিং লাইসেন্সও সঙ্গে রাখা উচিত।
- ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট (যদি প্রযোজ্য হয়): করোনা মহামারীর সময় যেমন কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের প্রমাণপত্র চাওয়া হত, তেমনি ইয়েলো ফিভার (হলুদ জ্বর) প্রবণ দেশে (যেমন: আফ্রিকার কিছু দেশ, দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশ) ভ্রমণে ইয়েলো ফিভার ভ্যাকসিনের সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক। গন্তব্য দেশের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নির্দেশিকা আগে থেকে জেনে নাও। ঢাকার আন্তর্জাতিক টিকা কেন্দ্র (আইভিসি) বা নির্ধারিত হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন ও সার্টিফিকেট নেওয়া যায়।
বিদেশ ভ্রমণে কি কি লাগে: আর্থিক প্রস্তুতি ও বাজেট ব্যবস্থাপনা – পকেটে স্বস্তি, যাত্রায় আনন্দ
কাগজপত্র ঠিক থাকলেও পকেট ফাঁকা থাকলে যাত্রার আনন্দ ম্লান হয়ে আসতে বাধ্য। বিদেশ ভ্রমণে আর্থিক প্রস্তুতি শুধু টাকা নিয়ে যাওয়া নয়, সঠিক পদ্ধতিতে সেটা ম্যানেজ করা। এখানে জড়িয়ে আছে মুদ্রা বিনিময়, পেমেন্ট মেথড, বাজেটিং, এবং জরুরি তহবিলের ব্যবস্থা:
- বিনিময়যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা: বাংলাদেশ থেকে সীমিত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা (সাধারণত ব্যক্তিপ্রতি ১২ হাজার মার্কিন ডলারের সমমূল্যের) ব্যাংক চ্যানেলে (অনুমোদিত ডিলার ব্যাংক) কাগজপত্র দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। এই ক্যাশ কিছুটা জরুরি অবস্থার জন্য এবং ছোটখাটো খরচের জন্য রাখা ভালো। খেয়াল করো:
- বিনিময় হার: বিভিন্ন ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জের হার ভিন্ন হয়। আগে থেকে রেট চেক করে সবচেয়ে ভালো রেট কোথায় পাওয়া যায় দেখে নাও। ঢাকার মতিঝিল বা বিমানবন্দরে সাধারণত ভালো রেট পাওয়া যায়।
- ডিনমিনেশন: ছোট ছোট নোট বা কয়েন রাখার চেষ্টা করো (যেমন: $1, $5, $10, €5, €10)। ট্যাক্সি, টিপ, বা ছোট কেনাকাটার জন্য এগুলো খুব কাজে লাগে। বড় নোট ভাঙাতে সমস্যা হতে পারে।
- নিরাপত্তা: বিপুল পরিমাণ ক্যাশ সঙ্গে না নিয়ে যাওয়াই ভালো। হোটেলের সেফে বা মানিবেল্টে সুরক্ষিত রাখো।
- আন্তর্জাতিক লেনদেন সক্ষম ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড: এটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক ও নিরাপদ পেমেন্ট মেথড। তবে সতর্কতা জরুরি:
- কার্ড সক্রিয়করণ: ব্যাংকে গিয়ে বা নেট ব্যাংকিং/মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে বিদেশে ব্যবহারের জন্য কার্ডটি আনব্লক বা ট্রাভেল নোটিশ দিতে হবে। না হলে বিদেশে প্রথম ব্যবহারেই কার্ড ব্লক হয়ে যেতে পারে!
- ফরেন এক্সচেঞ্জ ফি: প্রতিটি বিদেশী লেনদেনে (ক্রয় বা এটিএম থেকে টাকা তোলা) ব্যাংক একটি ফরেন এক্সচেঞ্জ ফি (সাধারণত ২%-৫%) এবং সম্ভবত একটি ফ্ল্যাট ফি নেয়। এই ফি সম্পর্কে আগে থেকে জেনে নাও। কিছু ব্যাংক বা বিশেষ ধরনের কার্ডে এই ফি কম বা নেই বললেই চলে (যেমন: Standard Chartered Zero, DBBL Nexus Tap & Go – নির্দিষ্ট শর্ত প্রযোজ্য)।
- নেটওয়ার্ক: ভিসা বা মাস্টারকার্ডের মতো গ্লোবাল নেটওয়ার্কের কার্ড নিশ্চিত করো। কিছু দেশে আমেরিকান এক্সপ্রেস বা ডিনার্স ক্লাবের গ্রহণযোগ্যতা কম হতে পারে।
- এটিএম থেকে টাকা তোলা: বিদেশে এটিএম থেকে স্থানীয় মুদ্রায় টাকা তোলাই সাধারণত সবচেয়ে ভালো রেট পাওয়ার উপায়। তবে প্রতিবার উত্তোলনে একটি ফিক্সড চার্জ (প্রায় $৩-$৫) এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ ফি লাগতে পারে। তাই কম বার বেশি টাকা তোলার চেষ্টা করো। সতর্কতা: স্কিমিং প্রতিরোধে বিশ্বস্ত ব্যাংক বা বিমানবন্দরের ভেতরের এটিএম ব্যবহার করাই ভালো। পিন ঢাকেই লুকিয়ে লিখো।
- প্রি-পেইড ট্রাভেল কার্ড / ফরেক্স কার্ড: এগুলো অনেকটা ডেবিট কার্ডের মতো, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা লোড করে নেওয়া যায়। এতে বাজেট কন্ট্রোল করা সহজ হয় এবং কার্ড হারালে মূল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিরাপদ থাকে। ফরেক্স ফ্লাকচুয়েশনের ঝুঁকিও কিছুটা কমে। তবে এগুলোরও ইস্যু ফি, রিলোড ফি, বা ইনঅ্যাকটিভিটি ফি থাকতে পারে। ব্যাংক বা রেপুটেড ফরেক্স ডিলার থেকে সংগ্রহ করা যায়।
- বাস্তবসম্মত বাজেট তৈরি: “বিদেশ ভ্রমণে কি কি লাগে” জিজ্ঞাসার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল খরচের সঠিক ধারণা। গন্তব্য দেশের জীবনযাত্রার ব্যয় (আবাসন, খাদ্য, পরিবহন, এন্ট্রি ফি, শপিং) রিসার্চ করে বাজেট তৈরি করো। কন্ট্রিজেন্সি ফান্ড (অপ্রত্যাশিত খরচের জন্য ১০-১৫% অতিরিক্ত) রাখতে ভুলো না। ট্রাভেল ব্লগ, সরকারি ট্যুরিজম সাইট (যেমন: থাইল্যান্ডের tat.or.th, মালয়েশিয়ার tourism.gov.my), এবং বাজেট ট্রাভেলারদের অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা নেওয়া যায়।
- জরুরি নগদ তহবিল: কার্ড কাজ না করলে, মানিবেল্ট হারিয়ে গেলে, বা অন্য কোন জরুরি পরিস্থিতির জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ টাকা (আরেক জায়গায়, যেমন ব্যাগের গোপন পকেটে) আলাদা করে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই টাকা শুধুমাত্র সত্যিকার জরুরি অবস্থায় ব্যবহার করা উচিত।
- স্থানীয় মুদ্রা সম্পর্কে ধারণা: দেশে পৌঁছানোর পর স্থানীয় মুদ্রার নোট ও কয়েন চিনে নাও। দ্রুত বুঝতে পারা কোনটা ১০ টাকা আর কোনটা ১০০ টাকা, রাস্তায় কেনাকাটা বা দরদাম করতে সাহায্য করবে। ছোট একটি কারেন্সি চার্ট বা অফলাইন কারেন্সি কনভার্টার অ্যাপ (যেমন XE Currency) ফোনে রাখতে পারো।
স্মার্টলি প্যাক করি: কাপড় থেকে কসমেটিক্স, যা কিছু লাগবে
প্যাকিং একটা আর্ট! বেশি নিয়ে ভারাক্রান্ত হওয়া, কম নিয়ে অসুবিধায় পড়া – দুটোই সমস্যা। লক্ষ্য হওয়া উচিত হালকা, সংগঠিত এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যাত্রা করা।
- সঠিক লাগেজ বাছাই: হালকা ও টেকসই স্যুটকেস বা ব্যাকপ্যাক বেছে নাও। খেয়াল করো এয়ারলাইনের ব্যাগেজ এলাউন্স (হ্যান্ড ব্যাগ + চেকড ব্যাগের ওজন ও সাইজ লিমিট)। বাংলাদেশ বিমান বা অন্যান্য এয়ারলাইনের ওয়েবসাইটে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। লিমিট ছাড়ালে অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হবে যা অনেক বেশি। হ্যান্ড ব্যাগে অবশ্যই জরুরি ওষুধ, ডকুমেন্টস, গয়না, ইলেকট্রনিক্স, এক সেট কাপড়, এবং প্রয়োজনীয় টয়লেট্রিজ রাখবে।
- পোশাক-পরিচ্ছদ: গন্তব্য দেশের আবহাওয়া, মৌসুম এবং ভ্রমণের ধরন (শপিং, হাইকিং, ফরমাল ডিনার?) অনুযায়ী কাপড় বেছে নাও। মূলমন্ত্র: মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ। কয়েকটি বেসিক পিস (জিন্স, কালো প্যান্ট, নিরপেক্ষ রঙের টি-শার্ট) নাও যেগুলো বার বার কয়েকভাবে মিলিয়ে পরা যায়। স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জুতা (হাঁটার জন্য) এবং এক জোড়া ফরমাল বা সেমি-ফরমাল জুতার কথা ভাবো। অন্তর্বাস, মোজার পরিমাণ হিসাব করে নাও। রেইনকোট বা হালকা জ্যাকেট আবহাওয়ার জন্য। সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা মেনে পোশাক নির্বাচন করো (যেমন: মধ্যপ্রাচ্য বা ধর্মীয় স্থানে ঢিলেঢালা পোশাক)।
- টয়লেট্রিজ ও পার্সোনাল কেয়ার: ছোট বোতলে শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, বডি ওয়াশ, টুথপেস্ট, ডিওডোরেন্ট ভরে নাও। সলিড টয়লেট্রিজ (শ্যাম্পু বার, সলিড ডিও) ওজন বাঁচায়। অপরিহার্য আইটেম: টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, ফ্লস, ডিওডোরেন্ট, সানস্ক্রিন (উচ্চ SPF), লিপ বাম, ময়েশ্চারাইজার, চিরুনি/ব্রাশ, রেজার, কন্ট্যাক্ট লেন্স সলিউশন (যদি ব্যবহার করো)। প্রেসক্রিপশন মেডিসিন অবশ্যই আসল বোতলে নিয়ে যেতে হবে, সাথে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন কপি। ছোট ফার্স্ট এইড কিট (প্লাস্টার, অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, পেইনকিলার, পেটের ওষুধ, অ্যান্টিহিস্টামিন) রাখা খুবই বুদ্ধিমানের কাজ।
- ইলেকট্রনিক্স ও গ্যাজেট:
- মোবাইল ফোন ও চার্জার: বিশ্বব্যাপী কাজ করে এমন আনলকড ফোন নিশ্চিত করো। ইন্টারন্যাশনাল রোমিং প্যাক নিতে হবে, অথবা গন্তব্যে লোকাল সিম কার্ড কিনতে হবে (সবচেয়ে সাশ্রয়ী)। পাসপোর্ট কপি ও ফটো নিয়ে সিম রেজিস্ট্রেশন করতে হতে পারে।
- ইউনিভার্সাল ট্রাভেল অ্যাডাপ্টার: দেশভেদে প্লাগের ধরন আলাদা (ইউরোপে Type C/F, UK-তে Type G, USA-তে Type A/B)। একটি ইউনিভার্সাল অ্যাডাপ্টার সব জায়গায় কাজে লাগবে। নোট: অ্যাডাপ্টার ভোল্টেজ পরিবর্তন করে না, শুধু প্লাগ ফিট করে। বাংলাদেশের মতো ২২০V-এ চলে এমন ডিভাইস (ফোন, ল্যাপটপ চার্জার) ইউরোপ, এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে কাজ করবে। USA (১১০V) গেলে চেক করে নাও ডিভাইস ডুয়াল ভোল্টেজ (Input: 100-240V) সাপোর্ট করে কিনা।
- পাওয়ার ব্যাংক: দীর্ঘ দিনের ট্যুরে বা ফ্লাইটে ফোন চার্জ রাখতে শক্তিশালী পাওয়ার ব্যাংক অপরিহার্য। বিমানে পাওয়ার ব্যাংকের ক্যাপাসিটি লিমিট (সাধারণত ১০০Wh বা ২৭০০০mAh পর্যন্ত) মেনে চলতে হবে।
- ক্যামেরা, ইয়ারফোন, ই-রিডার ইত্যাদি প্রয়োজন ও পছন্দ অনুযায়ী।
- অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় জিনিস:
- কপি করা ডকুমেন্টস: পাসপোর্ট, ভিসা, ইন্স্যুরেন্স, ফ্লাইট ডিটেইলস, হোটেল বুকিং – এর ফটোকপি বা স্ক্যান কপি (ক্লাউডে ও ইমেইলে সেভ করে রাখো) এবং আলাদা ব্যাগে কিছু হার্ড কপি রাখো। আসল ডকুমেন্টস হারালে কাজে লাগবে।
- ইমার্জেন্সি কন্ট্যাক্ট তথ্য: হোটেলের ঠিকানা ও ফোন নম্বর, দূতাবাস/হাইকমিশনের যোগাযোগের তথ্য, পরিবারের সদস্যের নম্বর – একটি কাগজে লিখে রাখো।
- রিইউজেবল ওয়াটার বোতল: বিমানবন্দর বা বাইরে থেকে পানি কিনে খাওয়ার চেয়ে এটা পরিবেশ ও পকেট বান্ধব। অনেক বিমানবন্দরে পানির ফিলিং স্টেশন আছে।
- ছোট ছোট সুবিধার জিনিস: ইলাস্টিক/জিপলক ব্যাগ (ভেজা কাপড়, স্যুভেনির প্যাকিং), ক্লিপ/বাইন্ডার (কাগজপত্র সংগঠিত রাখতে), ছোট ফ্ল্যাশলাইট, ভ্রমণ আকারের ছাতা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ভেজা টিস্যু।
- স্ন্যাকস: ফ্লাইট বা ট্রেন জার্নির জন্য কিছু হালকা খাবার (বিস্কুট, চিপস, ড্রাই ফ্রুট) রাখতে পারো। গন্তব্য দেশের খাদ্যাভ্যাসে সমস্যা হলে সাময়িক সমাধান হবে। তবে কৃষি পণ্য নিয়ে অনেক দেশে কঠোর বিধিনিষেধ আছে – বিমানবন্দরে ডিক্লেয়ার করতে হবে বা না নেওয়াই ভালো।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা প্রস্তুতি: সুস্থ শরীরে সুখের ভ্রমণ
ভ্রমণকালীন অসুস্থতা যাত্রার সব আনন্দ মাটি করে দিতে পারে। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকটা একদম অবহেলা করা চলবে না।
- প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনেশন: শুধু ইয়েলো ফিভার নয়, গন্তব্য দেশের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনুযায়ী অন্যান্য ভ্যাকসিন (যেমন: টাইফয়েড, হেপাটাইটিস এ ও বি, র্যাবিস, মেনিনজাইটিস) নেওয়া প্রয়োজন হতে পারে। ঢাকার আন্তর্জাতিক টিকা কেন্দ্র (আইভিসি) বা আইইডিসিআর-এ গিয়ে ট্রাভেল ক্লিনিক থেকে পরামর্শ নাও। অন্তত ভ্রমণের ৪-৬ সপ্তাহ আগে ভ্যাকসিনেশন শুরু করো, কারণ কিছু ভ্যাকসিনের একাধিক ডোজ লাগে এবং কার্যকর হতে সময় নেয়। ভ্যাকসিন রেকর্ডের “ইন্টারন্যাশনাল সার্টিফিকেট অফ ভ্যাকসিনেশন অর প্রোফাইল্যাক্সিস” (ইয়েলো কার্ড) সঙ্গে রাখো।
- ব্যক্তিগত ওষুধের স্টক: নিয়মিত কোন ওষুধ (ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, জন্মনিয়ন্ত্রণ, অ্যালার্জি ইত্যাদি) খেলে, পুরো ভ্রমণকালের চাহিদা মেটানোর মতো ওষুধ আসল প্যাকেটিংয়ে সঙ্গে নিতে হবে। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন কপি (ইংরেজিতে) অবশ্যই রাখতে হবে। দেশভেদে কিছু ওষুধ নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে (যেমন: কিছু ব্যথানাশক, সিডাটিভ) – আগে থেকে রিসার্চ করে নাও বা দূতাবাসে জিজ্ঞাসা করো। ওষুধগুলো হ্যান্ড ব্যাগে রাখো, চেকড ব্যাগে নয়।
- ফার্স্ট এইড কিট: ছোট কিন্তু কার্যকর একটি কিটে রাখো: প্লাস্টার (ব্যান্ড-এইড) বিভিন্ন সাইজে, গজ, অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম/লোশন (বেটাডিন/স্যাভলন), পেইনকিলার (প্যারাসিটামল, আইবুপ্রোফেন), পেটের ওষুধ (অ্যান্টাসিড, অ্যান্টি-ডায়ারিয়াল লোপেরামাইড, ইলেকট্রোলাইট পাউডার – ওরস্যালাইন), অ্যান্টিহিস্টামিন (অ্যালার্জির জন্য), মোশন সিকনেসের ওষুধ, ইনসেক্ট রিপেলেন্ট (মশা-মাকড় তাড়ানোর ক্রিম/স্প্রে), সানবার্ন জেল। কিটটি সহজে অ্যাক্সেসযোগ্য স্থানে রাখো।
- খাদ্য ও পানি সতর্কতা: “ডায়রিয়া” ভ্রমণকারীদের অন্যতম সাধারণ শত্রু। পানির বোতল কিনে খাওয়াই নিরাপদ। রেস্টুরেন্টে বরফ এড়িয়ে চলা ভালো। ফলমূল নিজে ধুয়ে খাও। স্ট্রিট ফুডের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করো – দেখে শুনে যেখানে ভিড় আছে, সেখানে খাও। কাঁচা শাকসবজি বা সালাদ এড়ানো যেতে পারে। হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলো, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করো।
- সান প্রোটেকশন: গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশের বাসিন্দা হয়েও বিদেশের রোদে পুড়ে যাওয়া খুব সহজ! উচ্চ SPF (৩০ বা ৫০+) যুক্ত সানস্ক্রিন নিয়মিত ব্যবহার করো, বিশেষ করে পাহাড়ে বা সমুদ্রসৈকতে। সানগ্লাস ও টুপি ব্যবহার করো।
যোগাযোগ ও ইন্টারনেট: বিশ্বের সাথে সংযুক্ত থাকুন
বিদেশে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং ইন্টারনেট অ্যাক্সেস থাকা নিরাপত্তা, নেভিগেশন এবং ঘরোয়া মন ভালো রাখার জন্য জরুরি।
- মোবাইল ফোন অপশন:
- ইন্টারন্যাশনাল রোমিং: বাংলাদেশী অপারেটরদের (গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক, এয়ারটেল) ইন্টারন্যাশনাল রোমিং প্যাক আগে থেকে অ্যাক্টিভেট করতে হবে। এতে কল, এসএমএস এবং ডাটার জন্য নির্দিষ্ট প্যাকেজ কেনা যায়। সুবিধা: নিজের নম্বরটি অপরিবর্তিত থাকে। অসুবিধা: দাম অনেক বেশি (বিশেষ করে ডাটা), এবং স্পিড কম হতে পারে।
- লোকাল সিম কার্ড: গন্তব্য দেশের বিমানবন্দর, মল, বা কনভিনিয়েন্স স্টোরে পৌঁছে একটি লোকাল প্রিপেইড সিম কার্ড কেনা সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও কার্যকর সমাধান। সাধারণত পাসপোর্ট কপি ও ফটো দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। ভালো ডাটা প্যাকেজ নিলে নেভিগেশন, যোগাযোগ সবই সহজ হয়। সতর্কতা: সিম কার্ডটি ঠিকমত কাজ করছে কিনা দোকানেই চেক করে নাও। কিছু দেশে (যেমন জাপান) বিদেশীদের জন্য বিশেষ ট্রাভেলার সিম পাওয়া যায়।
- ই-সিম: যদি তোমার ফোন ই-সিম সাপোর্ট করে (আইফোন XS/XR এবং পরের মডেল, নতুন জেনেরেশনের কিছু অ্যান্ড্রয়েড), তাহলে অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভার্চুয়াল ই-সিম কিনে নিতে পারো (Airalo, Holafly, Ubigi ইত্যাদি জনপ্রিয় সার্ভিস)। এতে আলাদা সিম কার্ডের প্রয়োজন হয় না। ডাটা প্যাকেজ কেনা যায়, কল/এসএমএসের সুবিধা কম থাকে। ডাটার দাম সাধারণত রোমিংয়ের চেয়ে কম, লোকাল সিমের কাছাকাছি।
- ওয়াই-ফাই অ্যাক্সেস: হোটেল, ক্যাফে, রেস্টুরেন্ট, এমনকি অনেক পাবলিক প্লেসে ফ্রি ওয়াই-ফাই পাওয়া যায়। তবে পাবলিক ওয়াই-ফাই নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিপূর্ণ। VPN (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) ব্যবহার করে ইন্টারনেট ট্রাফিক এনক্রিপ্ট করা নিরাপদ। গুগল ম্যাপস অফলাইন ডাউনলোড করে রাখলে নেট ছাড়াই নেভিগেট করা যায়।
- জরুরি যোগাযোগ নম্বর: স্থানীয় জরুরি নম্বর (পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস) এবং বাংলাদেশ দূতাবাস/মিশনের ফোন নম্বর ও ঠিকানা ফোনে ও নোট করে রাখো।
সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা ও নিরাপত্তা: শ্রদ্ধা জানাই, সচেতন থাকি
ভিন্ন দেশ, ভিন্ন রীতি। স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও সচেতনতা শুধু শিষ্টাচার নয়, নিরাপত্তার জন্যও জরুরি।
- স্থানীয় রীতি-নীতি ও শিষ্টাচার: গন্তব্য দেশের সংস্কৃতি, ধর্মীয় রীতি, সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে সামান্য রিসার্চ করলেই অনেক ভুল এড়ানো যায়। যেমন:
- পোশাক: মন্দির, মসজিদ, বা রক্ষণশীল এলাকায় ঢিলেঢালা ও শালীন পোশাক পরা (যেমন: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মন্দিরে কাঁধ ও হাঁটু ঢাকতে হবে; মধ্যপ্রাচ্যে)।
- শিষ্টাচার: জাপানে বা কোরিয়ায় সালাম বা সম্মান জানানোর ভঙ্গি, থাইল্যান্ডে ‘ওয়াই’ করা, খাবার টেবিলের আচরণ (যেমন: চীনে খাবারের মধ্যে চপস্টিক সোজা করে গাঁথা রাখা অশুভ)।
- ছবি তোলা: কিছু স্থান (ধর্মীয় স্থান, সামরিক স্থাপনা) বা মানুষ (বিশেষ করে স্থানীয় নারী বা শিশু) ছবি তোলার আগে অনুমতি নেওয়া উচিত।
- টিপিং সংস্কৃতি: ইউরোপে সার্ভিস চার্জ অন্তর্ভুক্ত থাকলে ছোটখাটো টিপ দিলেই চলে, আমেরিকায় টিপিং (১৫-২০%) বাধ্যতামূলক ধরনের, জাপানে টিপ দেওয়া অপমানজনক হতে পারে।
- ব্যক্তিগত নিরাপত্তা:
- সচেতনতা: পর্যটকদের টার্গেট করে চুরি-ছিনতাই হতে পারে। ভিড় এড়িয়ে চলো, অপরিচিত জায়গায় রাতে একা ঘোরাফেরা না করা। মানিবেল্ট বা ক্রসবডি ব্যাগ ব্যবহার করো।
- মূল্যবান জিনিস: পাসপোর্ট, অতিরিক্ত নগদ টাকা, গয়না হোটেলের সেফে রাখো। পাসপোর্টের ফটোকপি সঙ্গে রাখো।
- অপরিচিতদের প্রতি সতর্কতা: খুব বেশি আত্মীয়তাপূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির প্রস্তাবে সাড়া দেওয়া থেকে বিরত থাকো। স্ক্যাম (জাল ট্যাক্সি, জাল গাইড, জাল পুলিশ) সম্পর্কে সচেতন থাকো।
- কপি ও বীমা: ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, কিন্তু আবারও – জরুরি ডকুমেন্টস ও ইন্স্যুরেন্সের কপি আলাদাভাবে রাখো।
- স্থানীয় আইন মেনে চলা: প্রতিটি দেশের নিজস্ব আইন-কানুন আছে। ছোটখাটো মনে হলেও সেগুলো ভঙ্গ করা গুরুতর সমস্যা ডেকে আনতে পারে (যেমন: সিঙ্গাপুরে চুইংগাম বিক্রি/ব্যবহার নিষিদ্ধ, থাইল্যান্ডে রাজপরিবারের সমালোচনা শাস্তিযোগ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রকাশ্যে স্নেহ প্রকাশ নিষেধাজ্ঞাযুক্ত)। ভ্রমণ শুরুর আগে গন্তব্য দেশের কিছু মৌলিক আইন জেনে নাও।
পরিবহন ও নেভিগেশন: গন্তব্যে পৌঁছানোর সহজ উপায়
গন্তব্য দেশে পৌঁছেও যাতায়াতের ব্যবস্থা জানা দরকার।
- বিমানবন্দর থেকে শহরে যাওয়া: বিমানবন্দর থেকে শহরের কেন্দ্রে যাওয়ার অপশনগুলো আগে থেকে জেনে নাও: এয়ারপোর্ট এক্সপ্রেস ট্রেন (দ্রুততম ও নির্ভরযোগ্য, যেমন: লন্ডন, টোকিও), মেট্রো/সাবওয়ে, অফিসিয়াল ট্যাক্সি/রাইড-শেয়ারিং (উবার, গ্র্যাব), অথবা এয়ারপোর্ট শাটল বাস (সবচেয়ে সাশ্রয়ী)। জাল ট্যাক্সি এড়াতে অফিসিয়াল ট্যাক্সি স্ট্যান্ড ব্যবহার করো।
- স্থানীয় পরিবহন: পাবলিক ট্রান্সপোর্ট (মেট্রো, বাস, ট্রাম) ব্যবহার করা সাশ্রয়ী ও অভিজ্ঞতামূলক। অনেক শহরে ট্যুরিস্ট ট্রাভেল কার্ড (যেমন: লন্ডনের Oyster Card, প্যারিসের Navigo, টোকিওর Suica/Pasmo) কিনে নিলে সহজে ও কম খরচে চলাফেরা করা যায়। রাইড-শেয়ারিং অ্যাপ (উবার, লিফট, গ্র্যাব) অনেক দেশে সহজলভ্য। সাইকেল ভাড়া বা হাঁটাও ভালো অপশন হতে পারে কমিউনিটি অনুভবের জন্য।
- নেভিগেশন: গুগল ম্যাপস বা অ্যাপল ম্যাপস সবচেয়ে জনপ্রিয়। অফলাইন ম্যাপস ডাউনলোড করে রাখতে পারো (গুগল ম্যাপসে অফলাইন এরিয়া সেভ করার অপশন আছে)। স্থানীয় অফলাইন ম্যাপস অ্যাপও থাকতে পারে। একটি ছোট পকেট ম্যাপ বা গাইডবুকও সহায়ক।
- ড্রাইভিং: যদি গাড়ি ভাড়া নেওয়ার পরিকল্পনা থাকে, আইডিপি (আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট) এবং বাংলাদেশী লাইসেন্স সঙ্গে রাখতেই হবে। গাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় বিমা, জ্বালানী পলিসি, এবং গাড়ির পূর্বের ক্ষতি ভালো করে চেক করে নিতে হবে (ভিডিও বা ছবি তুলে রাখা ভালো)। গন্তব্য দেশের ট্রাফিক আইন ও রাস্তার চিহ্ন সম্পর্কে জেনে নাও (যেমন: ইউরোপের ডান হাতের রাস্তা, UK-এর বাম হাতের রাস্তা)।
শেষ কথা নয়, শুরু যেন হয় নিশ্চিন্ত যাত্রার
বিদেশ ভ্রমণে কি কি লাগে – এই প্রশ্নের উত্তর আসলে শুধু জিনিসপত্রের তালিকা নয়; এটা একটা মনোভাব, এক ধরনের প্রস্তুতি, যার কেন্দ্রে থাকে সচেতনতা ও স্বস্তি। একবার যখন তুমি জানো যে তোমার পাসপোর্টে ভিসা ঝলমল করছে, ব্যাংক স্টেটমেন্টে পর্যাপ্ত ফান্ড আছে, ট্র্যাভেল ইন্স্যুরেন্সের কভারেজ পলিসি হাতের নাগালে, এবং জরুরি ওষুধের প্যাকেট সুরক্ষিত – তখনই ভ্রমণের আসল আনন্দ শুরু হয়। প্রতিটি সঠিক প্রস্তুতি যেন তোমার পিঠ থেকে একটা করে বোঝা নামিয়ে দেয়, যাত্রাপথকে করে তোলে হালকা আর উদ্বেগমুক্ত। তাই সময় নিয়ে প্রস্তুত হও, সবকিছু ডাবল-চেক করো, এবং বিশ্বাস রেখো নিজের উপর। এই পৃথিবী অপেক্ষা করছে তোমাকে জয় করার জন্য। তোমার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে সুরক্ষিত ও আনন্দময় যাত্রা হোক – এখনই শুরু করো সেই স্বপ্নের যাত্রার পরিকল্পনা, আর নিজেকে বলো, “আমি প্রস্তুত!” ✈️
জেনে রাখুন
বিদেশ ভ্রমণে কি কি লাগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র কোনগুলো?
বিদেশ ভ্রমণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র হলো বৈধ পাসপোর্ট (যার মেয়াদ ফেরার পর কমপক্ষে ৬ মাস), প্রয়োজনীয় ভিসা, ট্র্যাভেল ইন্স্যুরেন্সের প্রমাণপত্র, ফ্লাইট টিকিটের কনফার্মেশন, এবং আবাসনের বুকিং ডিটেইলস। আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ (ব্যাংক স্টেটমেন্ট) ও ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট (প্রযোজ্য হলে) রাখাও জরুরি। সব কাগজপত্রের ফটোকপি বা স্ক্যান কপি আলাদাভাবে সংরক্ষণ করুন।
বিদেশে টাকা নেওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় কি?
বিদেশে টাকা নেওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক ও নিরাপদ উপায় হলো আন্তর্জাতিক লেনদেন সক্ষম ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা। তবে কার্ড বিদেশে ব্যবহারের জন্য আগে থেকে ব্যাংকে অনুমতি নিতে (ট্রাভেল নোটিশ) ভুলবেন না। কিছু নগদ বৈদেশিক মুদ্রা (ছোট নোটে) জরুরি অবস্থার জন্য রাখুন। এটিএম থেকে স্থানীয় মুদ্রায় টাকা তোলাও একটি ভালো অপশন, তবে প্রতি উত্তোলনে ফি চার্জ হতে পারে। প্রি-পেইড ট্রাভেল কার্ড/ফরেক্স কার্ডও ব্যবহার করা যায়।
ভ্রমণ বীমা কি সত্যিই দরকারি?
হ্যাঁ, ভ্রমণ বীমা অত্যন্ত দরকারি এবং অনেক দেশের জন্য বাধ্যতামূলক (যেমন শেঙেনভুক্ত দেশসমূহ)। বিদেশে চিকিৎসা ব্যয় অত্যন্ত উচ্চ হতে পারে। ভালো মানের ট্র্যাভেল ইন্স্যুরেন্স চিকিৎসা ব্যয়, ফ্লাইট বাতিল/বিলম্ব, জরুরী মেডিকেল ইভাকুয়েশন, পাসপোর্ট বা ব্যাগেজ হারানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে আর্থিক সুরক্ষা ও সহায়তা প্রদান করে। ভিসা আবেদনের সময়ও এর প্রমাণপত্র জমা দিতে হয়।
বিদেশে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সেরা উপায় কি?
সবচেয়ে সাশ্রয়ী উপায় হলো গন্তব্য দেশে পৌঁছে একটি স্থানীয় প্রিপেইড সিম কার্ড কেনা (পাসপোর্ট কপি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হতে পারে)। এটি সস্তায় ডাটা ও কল করার সুবিধা দেয়। বিকল্প হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল রোমিং প্যাক নেওয়া যায়, তবে খরচ বেশি। ই-সিম সাপোর্টেড ফোন থাকলে ভার্চুয়াল ই-সিম (Airalo, Holafly ইত্যাদি) কিনে ডাটা ব্যবহার করা যায়। ফ্রি পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহারের সময় VPN ব্যবহার করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।
প্যাকিং করার সময় সবচেয়ে সাধারণ ভুলগুলি কী কী?
প্যাকিং করার সময় সাধারণ ভুলগুলির মধ্যে রয়েছে: প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিসপত্র নেওয়া (ওভারপ্যাকিং), আবহাওয়া ও গন্তব্যের সংস্কৃতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ পোশাক নেওয়া, জরুরী ওষুধ বা টয়লেট্রিজ ভুলে যাওয়া, ডকুমেন্টস ও মূল্যবান জিনিস হ্যান্ড ব্যাগে না রাখা, এয়ারলাইনের ব্যাগেজ ওজন ও সাইজ লিমিট না জেনে বড় স্যুটকেস নেওয়া, এবং ইলেকট্রনিক্সের চার্জার বা অ্যাডাপ্টার ভুলে যাওয়া। একটি চেকলিস্ট ব্যবহার করে ধাপে ধাপে প্যাকিং করলে এই ভুলগুলো এড়ানো যায়।
বিদেশে অসুস্থ হলে বা জরুরি অবস্থায় কি করব?
প্রথমেই তোমার ট্র্যাভেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির জরুরি হেল্পলাইনে ফোন করো। তারা তোমাকে নিকটস্থ উপযুক্ত হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যাওয়ার পরামর্শ দেবে এবং খরচের দিকটা ম্যানেজ করতে সাহায্য করবে (সাধারণত ডাইরেক্ট বিলিংয়ের ব্যবস্থা থাকে)। স্থানীয় জরুরি নম্বর (যেমন ইউরোপে ১১২, আমেরিকায় ৯১১) ডায়াল করো। বাংলাদেশ দূতাবাস/মিশনে যোগাযোগ করতে পারো সহায়তার জন্য (ইন্স্যুরেন্স ডকুমেন্টে বা অনলাইনে তাদের নম্বর পাওয়া যায়)। নিজের ওষুধ ও চিকিৎসা ইতিহাস সম্পর্কে জানা থাকলে ডাক্তারকে সাহায্য করবে।
⚠️ সতর্কতা: ভিসা নীতিমালা, এয়ারলাইনের ব্যাগেজ নিয়ম, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাওয়ার সীমা, এবং গন্তব্য দেশের স্বাস্থ্যবিধি ও আইনকানুন পরিবর্তনশীল। ভ্রমণের খুব কাছাকাছি সময়ে আবারও সংশ্লিষ্ট দূতাবাস, এয়ারলাইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট বা নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে হালনাগাদ তথ্য যাচাই করে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই গাইড সাধারণ তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি; ব্যক্তিগত পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।