রোজ গার্ডেনের সেই নির্জনতা কি ভুলবেন? লক্ষাধিক ভারতীয় সমর্থকের উপস্থিতিতে ভরপুর স্টেডিয়ামটি নিস্তব্ধ। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও যেখানে তুমুল উল্লাস আর ‘ইন্ডিয়া-ইন্ডিয়া’ স্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছিল অ্যাডেনলাইডের রাত, সেখানে এখন স্তব্ধতা। পিচের ওপারে ট্র্যাভিস হেড আর মার্নাস লাবুশেনের আলিঙ্গন, আর এপারে কপালে হাত রেখে দাঁড়ানো বিরাট কোহলি। ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বরের সেই ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনালের ম্যাচ শেষ হওয়ার মুহূর্তগুলো ক্রিকেট ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে – একদলের জন্য অনবদ্য বিজয়ের মহিমা, অন্যদলের জন্য হৃদয়ভাঙা পরাজয়ের গ্লানি। এই বিশ্বকাপ ফাইনাল বিশ্লেষণ শুধু স্কোরকার্ডের সংখ্যাগুলোকে উল্টেপাল্টে দেখার চেষ্টা নয়; এটি একটি গল্প – মেন্টালিটি, কৌশল, টার্নিং পয়েন্ট এবং নাটকীয়তার গল্প, যা স্পষ্ট করে দিয়েছে কেন অস্ট্রেলিয়া আবারও শিরোপার মালিক হল আর ভারত ঘরে ফিরল শূন্য হাতে। এই গভীর পর্যবেক্ষণে আমরা খুঁজে বের করব সেই সমস্ত সূক্ষ্ম সূত্র, যা ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
বিশ্বকাপ ফাইনাল বিশ্লেষণ: টস থেকে শুরু হওয়া জয়-পরাজয়ের খেলা
অনেকেই বলে থাকেন, টস ক্রিকেটের একটি অংশ মাত্র। কিন্তু ফাইনালের মতো ম্যাচে, বিশেষ করে এমন একটি পিচে যেখানে সন্ধ্যার পর আর্দ্রতা বেড়ে গিয়ে বলকে স্যুইং করাতে সাহায্য করে, টসের গুরুত্ব অপরিসীম। প্যাট কামিনসের সেই সিদ্ধান্ত – “আমরা বোলিং করব” – শুধু একটি ঘোষণা নয়, এটি ছিল অস্ট্রেলিয়ান টিম ম্যানেজমেন্টের সুচিন্তিত কৌশলের প্রকাশ। তারা স্পষ্টতই লক্ষ্য করেছিল দিনের শুরুর দিকে পিচে কী ঘটছিল এবং সন্ধ্যার দিকে কী ঘটতে পারে। ICC-র পিচ রিপোর্ট এবং বিভিন্ন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস (যেমন ESPNcricinfo-তে প্রকাশিত বিশ্লেষণ) ইঙ্গিত দিয়েছিল যে রাতে ব্যাটিং আরও চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
কামিনসের এই সিদ্ধান্ত ছিল এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেরও সূচনা। অস্ট্রেলিয়া স্পষ্ট জানান দিল, তারা ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত, তাদের শক্তির উৎসেই আঘাত হানতে চায়। আর এর বিপরীতে, রোহিত শর্মাকে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে বাধ্য হওয়ার অর্থ ছিল, তাদেরকে অবশ্যই একটি বড় স্কোর গড়তে হবে, যা চাপের জন্ম দিয়েছিল। এই টসের সিদ্ধান্ত ফাইনালের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে, যার প্রভাব পড়েছিল পরবর্তী প্রতিটি ওভারে। এটি বিশ্বকাপ ফাইনাল বিশ্লেষণের একটি অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়।
অস্ট্রেলিয়ার মেন্টাল ম্যাজেস্ট্রি: চাপে দমে না যাওয়ার শিল্প
ভারত পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে এক কথায় অপরাজেয় ছিল। তাদের বোলিং আক্রমণ ছিল দুর্দান্ত, ব্যাটিং ছিল ধ্বংসাত্মক। কিন্তু ফাইনাল হল ভিন্ন এক মঞ্চ, যেখানে অতীতের রেকর্ডের চেয়ে বর্তমানের নার্ভ অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। অস্ট্রেলিয়া, তাদের বিশ্বকাপের সমৃদ্ধ ইতিহাস (এখন ৬টি ODI বিশ্বকাপ শিরোপা) এবং ফাইনালে খেলার অপরিমেয় অভিজ্ঞতার কারণে, এই চাপ মোকাবেলায় ছিল এক ধাপ এগিয়ে। তারা জানত কিভাবে বড় ম্যাচ খেলতে হয়।
- শুরুতেই আক্রমণের ছক: মিচেল স্টার্ক এবং জশ হজলউডের প্রথম পাওয়ারপ্লে ছিল ম্যাচের আরেকটি টার্নিং পয়েন্ট। রোহিত শর্মার আক্রমণাত্মক ব্যাটিং পুরো টুর্নামেন্টে ভারতের সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল। অস্ট্রেলিয়া স্পষ্টতই এই হুমকি চিহ্নিত করেছিল। হজলউডের সুইং আর স্টার্কের একটু শর্ট অফ লেংথে সেট আপ করে রোহিতকে ক্যাচ দিতে বাধ্য করা (স্কাইড করে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের হাতে) ছিল এক মাস্টারক্লাস। এই উইকেট ভারতের রান রেট এবং মনোবল উভয়কেই আঘাত করেছিল। (ICC Match Centre – Scorecard – এই লিংকে বিস্তারিত বল বাই বল বিবরণ ও ফ্যালিং উইকেটস দেখুন)
- মিডল ওভারে নিয়ন্ত্রণ: ভারতের ব্যাটসম্যানরা, বিশেষ করে কোহলি এবং রাহুল, পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা, বিশেষ করে প্যাট কামিনস নিজে এবং অ্যাডাম জাম্পা, রান রেটকে চাপের মধ্যে রাখতে সফল হয়েছিলেন। তারা ব্যাটসম্যানদের ঘুরপাক খাওয়াতে বাধ্য করেছিল, সীমানা রক্ষা ছিল অত্যন্ত কৌশলপূর্ণ। জাম্পার গুগলি এবং কামিনসের অফ-কাটাররা ব্যাটসম্যানদের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে দেয়নি। এই নিয়ন্ত্রণই পরে উইকেটের পতন ত্বরান্বিত করেছিল।
- ফিল্ডিংয়ে প্রাণ: ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিং ছিল অসাধারণ। ডেভিড ওয়ার্নারের ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যাচ নেওয়া (শ্রেয়াস আইয়ার), ট্র্যাভিস হেডের অসম্ভব ক্যাচ (রোহিত শর্মা), এবং সর্বত্র দৌড়ঝাঁপ – প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা অতিরিক্ত রান বাঁচিয়েছে এবং ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের উপর মানসিক চাপ বাড়িয়েছে। এই ছোটখাটো সঞ্চয় ফাইনালের মতো ম্যাচে বিশাল পার্থক্য গড়ে দেয়। এটি দলগত মনোবল এবং প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন।
ভারতের ব্যাটিং কোলাপস: স্বপ্নভঙ্গের নীরব গল্প
২৪০ রান কোনভাবেই প্রতিরক্ষার যোগ্য স্কোর নয়, বিশেষ করে বিশ্বকাপ ফাইনালে। ভারতের ব্যাটিং লাইনআপ, যারা টুর্নামেন্ট জুড়ে প্রতিপক্ষের বোলারদের ওপর সিংহের মতো থাবা বসিয়েছিল, তারা কেন ফাইনালে এমন নিষ্প্রভ হয়ে পড়ল? এই বিশ্বকাপ ফাইনাল বিশ্লেষণ সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজে।
- শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার ব্যর্থতা: রোহিতের প্রারম্ভিক বিদায় এবং শুভমন গিলের হতাশাজনক রান আউট ভারতকে শুরু থেকেই পিছিয়ে ফেলেছিল। কোহলি (54) এবং রাহুল (66) একটি পুনরুদ্ধার অভিযান শুরু করলেও, তারা কখনোই অস্ট্রেলিয়ান বোলিং আক্রমণকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। রান রেট ক্রমাগত বেড়ে চলা চাপ তাদের উপর ক্রিয়াশীল ছিল।
- মিডল ওভারে সীমানা খুঁজে না পাওয়া: অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা, বিশেষ করে কামিনস এবং জাম্পা, ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মিড-উইকেটের ফাঁকে আটকে দিয়েছিলেন। সীমানা পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল। ফোর কিংবা সিক্সের বদলে সিঙ্গেল এবং ডট বলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় রান রেট স্থবির হয়ে পড়ে। রাহুল এবং কোহলির মধ্যে ৬৭ বলের পার্টনারশিপে মাত্র ৩টি বাউন্ডারি ছিল, যা তাদের স্বাভাবিক প্রবাহের তুলনায় অনেক কম।
- ক্লাস্টার অফ উইকেটস: কোহলির উইকেট (কামিনসের বলে, যেটি সামান্য ইন-সুইং করে স্টাম্প স্পর্শ করেছিল) ছিল মারাত্মক আঘাত। এরপর শ্রেয়াস আইয়ার (4), রবীন জাদেজা (9) এবং সূর্যকুমার যাদব (18) দ্রুত বিদায় নেওয়ায় ভারতের ইনিংস পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। শেষ ৭ উইকেট মাত্র ৬০ রানে হারানো ভারতকে ২০০-এর ঘরেও পৌঁছাতে দেয়নি। এই ধস ভারতের মোট স্কোরকে প্রতিরক্ষার অযোগ্য করে তোলে এবং অস্ট্রেলিয়ার জয়ের পথ সুগম করে।
অস্ট্রেলিয়ার রান তাড়া: হেডের মহাকাব্যিক ইনিংস
লক্ষ্য মাত্র ২৪১। কিন্তু এটি যে বিশ্বকাপ ফাইনাল! চাপ সর্বত্র। ভারতের বোলিং আক্রমণ, বিশেষ করে জসপ্রীত বুমরাহ, মোহাম্মদ শামি এবং মোহাম্মদ সিরাজ, পুরো টুর্নামেন্টে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া তাদের রান তাড়ায় যে আত্মবিশ্বাস এবং পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছিল, তা ছিল অসাধারণ।
- ওয়ার্নার-হেডের দৃঢ় ভিত্তি: ডেভিড ওয়ার্নার (7) এবং মিচেল মার্শ (15) দ্রুত বিদায় নিলেও, ট্র্যাভিস হেড এবং মার্নাস লাবুশেন অত্যন্ত ধৈর্য্য এবং দৃঢ়তার সাথে জবাব দেন। তারা ভারতের শক্তিশালী নতুন বলের বোলিং আক্রমণকে সম্মান করলেও, বাউন্ডারির সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগাতে ছাড়েননি। বিশেষ করে হেড, তিনি বুমরাহকে প্রথম ওভারেই সীমানা মেরে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত।
- ট্র্যাভিস হেডের জয়সূচক শতরান: হেডের ইনিংসটি (137 রান, 120 বল, 15×4, 4×6) ছিল বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি। তিনি কেবল রানই করেননি, তিনি ভারতীয় বোলারদের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। শামির গতিকে পুল শটে, কুলদীপ যাদবের স্পিনকে সোজা সীমানার ওপারে, বুমরাহের ইয়র্কারকে চওড়া মিডউইকেটে – সব ধরনের বোলিংকেই তিনি নিজের শক্তি দিয়ে জবাব দিয়েছিলেন। তার ইনিংস ছিল নার্ভ, টেকনিক এবং আক্রমণাত্মক মনোভাবের এক অনবদ্য সংমিশ্রণ। তার ইনিংসে ভারতীয় সমর্থকদের আশা ক্রমাগত ম্লান হতে থাকে।
- লাবুশেনের অমূল্য সহায়ক ভূমিকা: মার্নাস লাবুশেন (58* রান) হয়তো হেডের ঝলমলে ইনিংসের আড়ালে চলে গেছেন, কিন্তু তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি অত্যন্ত ধৈর্য্যের সাথে এক প্রান্তে ডাঁড়িয়ে রেখেছিলেন, হেডকে আক্রমণাত্মক খেলার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তার অপরাজিত ইনিংসটি ছিল ক্লাসিক ফিনিশারের নমুনা – ঠিক সময়ে স্ট্রোক খেলেছেন, রান রেটের চাপ নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন এবং শেষ পর্যন্ত জয় নিশ্চিত করেছেন।
কী শেখালো এই বিশ্বকাপ ফাইনাল?
২০২৩ বিশ্বকাপ ফাইনাল ক্রিকেটকে আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে যে এই খেলা শুধুই প্রতিভা বা ফর্মের নয়; এটি সমানভাবে মেন্টাল স্ট্রেংথ, বড় মঞ্চে পারফরম্যান্স দেওয়ার ক্ষমতা, সুযোগ বুঝে নেওয়ার দক্ষতা এবং দলগত একতার খেলা। অস্ট্রেলিয়া এই সমস্ত গুণের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়েছিল।
- পরিকল্পনা ও নির্বাহ: অস্ট্রেলিয়ার টসের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে বোলিং, ফিল্ডিং সেটিং, ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ – প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল এবং তারা তা নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করেছিল।
- চাপ ব্যবস্থাপনা: ফাইনালের চাপ অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দেরকে দমিয়ে দিতে পারেনি; বরং তারা তাতেই উজ্জীবিত হয়েছিল। ভারত, বিপুল প্রত্যাশা এবং ঘরের মাঠের চাপের কাছে কিছুটা নতজানু হয়ে পড়েছিল, বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে।
- মুহূর্তের নায়ক: ফাইনালে প্রায়ই একজন বা দু’জন খেলোয়াড় মহাকাব্যিক কিছু করে ইতিহাস গড়েন। ট্র্যাভিস হেড ছিলেন সেই নায়ক, যার ইনিংস শিরোপা জয়ের সমার্থক হয়ে উঠেছিল। ভারতের পক্ষে এমন কোনও একক মুহূর্তের নায়ক সেদিন ছিলেন না।
- অভিজ্ঞতার মূল্য: বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা অমূল্য। অস্ট্রেলিয়ার দলে এমন অনেক খেলোয়াড় ছিলেন যারা এর আগেও বড় বড় ফাইনাল খেলেছেন। ভারতীয় দলে, বিশেষ করে মূল একাদশে, ফাইনালের অভিজ্ঞতা তুলনামূলকভাবে কম ছিল, যা হয়তো প্রভাব ফেলেছিল।
বিশ্বকাপ ফাইনাল বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া এই শিক্ষাগুলো ভবিষ্যতের দলগুলোর জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। এটি শুধু ক্রিকেটের খেলাই নয়, জীবনেও বড় লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে পরিকল্পনা, নির্বাহ, মানসিক দৃঢ়তা এবং দলগত প্রচেষ্টা কতটা অপরিহার্য, তা এই ফাইনাল দেখিয়ে দিয়েছে। রোজ গার্ডেনের সেই রাত ভারতের জন্য ছিল বিষাদের, কিন্তু ক্রিকেটের জন্য ছিল আরেকটি অনবদ্য, শিক্ষণীয় অধ্যায়ের সাক্ষী। ট্র্যাভিস হেডের ব্যাটে উড়ন্ত বল, বিরাট কোহলির নিঃসহায় দৃষ্টি, আর প্যাট কামিনসের হাতে উত্থিত ট্রফি – এই সবকিছু মিলিয়েই তৈরি হয়েছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনালের গভীর পর্যবেক্ষণের এই অমূল্য ইতিহাস, যা ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে ও মস্তিষ্কে দীর্ঘকাল ধরে আলোড়ন তুলবে।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. ২০২৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে টস জিতে অস্ট্রেলিয়া কেন ফিল্ডিং বেছে নেয়?
২০২৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিনস টস জিতে ফিল্ডিং বেছে নেওয়ার পেছনে প্রধান কারণ ছিল পিচ ও আবহাওয়ার অবস্থা বিশ্লেষণ। দিনের শুরুর দিকে পিচে ব্যাটিং তুলনামূলকভাবে সহজ মনে হলেও, সন্ধ্যার পর আর্দ্রতা বেড়ে গেলে বল স্যুইং ও সীম করার সুযোগ পায় বলে পূর্বাভাস ছিল। বিশেষ করে ভারতের বিপজ্জনক নতুন বলের বোলারদের (বুমরাহ, শামি) মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে তাদের সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে ভারতের ব্যাটারদের আউট করাকেই কামিনস অগ্রাধিকার দেন। এই কৌশলগত সিদ্ধান্ত ম্যাচের গতিপথই বদলে দেয়। (ICC Pitch Report Reference)
২. ভারতের ব্যাটিং ফাইনালে কেন ব্যর্থ হয়েছিল?
ভারতের ব্যাটিং ফাইনালে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে কয়েকটি মুখ্য কারণ কাজ করেছে। প্রথমত, শুরুতেই রোহিত শর্মা ও শুভমন গিলের দ্রুত বিদায় দলকে পিছিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা (বিশেষ করে স্টার্ক, হজলউড, কামিনস ও জাম্পা) লাইন-লেংথ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে বজায় রেখে ব্যাটসম্যানদের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে দেয়নি এবং রান রেট নিয়ন্ত্রণে রাখে। তৃতীয়ত, মাঝের ওভারগুলোতে সীমানা পাওয়া কঠিন ছিল, ফলে রান কমে যায়। চতুর্থত, বিরাট কোহলির গুরুত্বপূর্ণ উইকেটের পর উইকেটগুলোর দ্রুত পতন (ক্লাস্টার) ইনিংসটিকে পুরোপুরি ভেঙে দেয়।
৩. ট্র্যাভিস হেডের ইনিংসকে কেন ঐতিহাসিক বলা হয়?
ট্র্যাভিস হেডের ১২০ বলে ১৩৭ রানের ইনিংসটি ঐতিহাসিক কারণ এটি ছিল একটি বিশ্বকাপ ফাইনালে সেঞ্চুরি – যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্য স্বপ্নের সমতুল্য। এটি করা হয়েছিল বিপুল চাপের মধ্যে (দল ৪৭/৩), বিশ্বের সেরা বোলিং আক্রমণের (বুমরাহ, শামি, সিরাজ, কুলদীপ) বিরুদ্ধে, এবং ঘরের মাঠে বিপক্ষ দলের বিপুল সংখ্যক সমর্থকের সামনে। হেড শুধু রানই করেননি, তিনি আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন, ভারতীয় বোলারদের বিভিন্ন ধরনের বলকে সফলভাবে মোকাবেলা করে জয়ের জন্য প্রায় একাই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এটি ফাইনালের সেরা পারফরম্যান্সগুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে।
৪. ফাইনালে ভারতের বোলিং কেন অস্ট্রেলিয়াকে থামাতে পারেনি?
ভারতের বোলাররা পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত ছিলেন, কিন্তু ফাইনালে তাদেরকে তুলনামূলক কম রান রক্ষা করতে হয়েছিল (২৪০)। এই কম স্কোরের চাপে তারা হয়তো অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক হতে গিয়েছিলেন অথবা লাইন-লেংথ হারিয়েছিলেন। তাছাড়া, ট্র্যাভিস হেড অসাধারণ ব্যাটিং করেছিলেন, যিনি ভালো বলকেও রান বানিয়ে ফেলছিলেন। মার্নাস লাবুশেনের অপরাজিত সহায়ক ইনিংসও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারতের স্পিনাররা (কুলদীপ যাদব ও জাদেজা) আশানুরূপ প্রভাব ফেলতে পারেননি, যা মিডল ওভারে রান চাপ কমাতে সাহায্য করেনি।
৫. এই ফাইনাল থেকে প্রধান কী শিক্ষা নেওয়া উচিত?
এই বিশ্বকাপ ফাইনাল থেকে প্রধান শিক্ষা হল যে শুধুমাত্র প্রতিভা ও ফর্মই বড় ম্যাচ জিতিয়ে দেয় না। সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হল মানসিক দৃঢ়তা, বড় মঞ্চে পারফরম্যান্স দেওয়ার ক্ষমতা, নির্ভুল পরিকল্পনা ও তার নির্বাহ, এবং দলগত একতা ও কৌশলগত আত্মবিশ্বাস। অস্ট্রেলিয়া তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চাপের মুহূর্তে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। এছাড়া, ফাইনালে একটি “মুহূর্তের নায়ক” (হেড) থাকা এবং টসের মতো ক্ষুদ্র দিকেও নজর দেওয়া যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা এই ম্যাচ প্রমাণ করেছে।
৬. পরবর্তী বিশ্বকাপে কোন দলকে ফেভারিট বলা যেতে পারে?
২০২৩ বিশ্বকাপের পরের আসর এখনও দূরে, তবে বর্তমান ফর্ম, দলগত গঠন এবং অভিজ্ঞতা বিবেচনায় অস্ট্রেলিয়া স্বাভাবিকভাবেই শক্তিশালী দল হিসেবে থাকবে তাদের ফাইনাল জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চাইবে। ইংল্যান্ড (সাদা বলের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন) এবং পাকিস্তানও সবসময় প্রতিদ্বন্দ্বী। ভারত অবশ্যই শক্তিশালী থাকবে এবং ঘরের মাঠের সুবিধা না পেলেও শিরোপার জন্য লড়বে। নিউজিল্যান্ডের মতো দলও সবসময় ফাইনালের দাবিদার। তবে ক্রিকেট অপ্রত্যাশিততার খেলা, তাই ভবিষ্যতবাণী করা কঠিন!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।