বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে কে কতটা প্রভাবশালী—তা জানতে আমরা প্রতি বছর নানা গবেষণা ও জরিপের দিকে চোখ রাখি। এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো বিশ্বের শক্তিশালী দেশের তালিকা ২০২৫-এ বাংলাদেশের নাম উঠে আসা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই বিষয়টি নিয়ে চলছে প্রচণ্ড আলোচনা, প্রশংসা, আবার কিছু ভুল তথ্যও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে একে গর্বের বিষয় হিসেবে নিচ্ছেন, আবার অনেকে বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন। তাই চলুন বিশ্লেষণ করি কোনটা আসল, কোনটা ভুয়া, এবং কী বলছে প্রকৃত পরিসংখ্যান।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশের তালিকা “২০২৫”: প্রকৃত উৎস ও তথ্য বিশ্লেষণ (US News Power Ranking অনুযায়ী)
২০২৪ সালের ইউএস নিউজ (US News) দ্বারা প্রকাশিত সর্বশেষ Power Rankings অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ৫০টি দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এই তালিকাটি ২০২৪ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় এবং তা প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। জরিপে বিশ্বের প্রায় ১৭,০০০ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে ৬টি প্রধান সূচক যেমন—সামরিক শক্তি, বৈদেশিক নীতি, অর্থনৈতিক প্রভাব, বিশ্ব নেতৃত্বে ভূমিকা, রপ্তানি খাত এবং আন্তর্জাতিক জোট—এই বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা হয়। গর্বের বিষয় হলো, এই তালিকায় বাংলাদেশ ৪৭তম অবস্থানে স্থান পেয়েছে, যা আমাদের জন্য একটি সম্মানজনক অর্জন।
Table of Contents
নিচে বাংলায় কমা দিয়ে লেখা হয়েছে বিশ্বের ৫০টি সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের নাম।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান, ইসরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, ইতালি, ইরান, কানাডা, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ইউক্রেন, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, সুইডেন, কাতার, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, মিসর, পাকিস্তান, পোল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, বেলজিয়াম, মেক্সিকো, ডেনমার্ক, গ্রিস, আর্জেন্টিনা, চেক প্রজাতন্ত্র, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ আফ্রিকা, জর্ডান, থাইল্যান্ড, কলম্বিয়া, কুয়েত, নাইজেরিয়া, পর্তুগাল, রোমানিয়া, আলজেরিয়া, হাঙ্গেরি, বাংলাদেশ, আয়ারল্যান্ড।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশের তালিকা ২০২৫ বিষয়টি ঘিরে ফেসবুকে দুটি বিপরীতধর্মী দাবি ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথমত, কিছু পোস্ট বলছে বাংলাদেশ ১২৩তম স্থান থেকে ৭৬ ধাপ এগিয়ে ৪৭তম হয়েছে মাত্র ৭ মাসে। অন্যদিকে, আরেকটি দল বলছে বাংলাদেশ ৪০তম স্থান থেকে ৮ মাসে নেমে এসেছে ৪৭তম স্থানে। এই দুটি দাবির মধ্যেই রয়েছে বিভ্রান্তি।
প্রথমত, ইউএস নিউজ (US News) ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, যার জরিপ চলেছিল ২০২৪ সালের ২২ মার্চ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত। এই তালিকায় বাংলাদেশ পাওয়ার সাবর্যাংকিংয়ে ৪৭তম ও সামগ্রিকভাবে ৭১তম স্থানে রয়েছে। অর্থাৎ এটি ২০২৫ সালের তালিকা নয় বরং ২০২৪ সালের জরিপ-ভিত্তিক প্রকাশনা, যদিও সেটি সেপ্টেম্বরে এসেছে।
এই জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান ঠিক তখনকার সরকারের শাসনামলে না হলেও, জরিপটি শুরু হয়েছিল সেই সময়েই। তাই এই তালিকাকে বর্তমানে ৭ মাসে ৭৬ ধাপ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা সঠিক নয়। মূলত US News প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে এই তালিকা প্রকাশ করে।
অপরদিকে, দ্বিতীয় দাবিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ৪০তম থেকে নেমে এসেছে ৪৭তম স্থানে। এই দাবির উৎস একটি আলাদা ওয়েবসাইট—ceoworld.biz—যা ২০২৪ সালের এপ্রিলে ১৪২টি দেশের তালিকা প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৪০তম। অথচ US News-এর তালিকায় ছিল ৮৯টি দেশ। কাজেই দুটি তালিকার পদ্ধতি ও কাঠামো ভিন্ন হওয়ায় এ ধরনের তুলনা ভিত্তিহীন।
তালিকা তৈরির পদ্ধতি ও যাচাইযোগ্যতা
ইউএস নিউজ তাদের র্যাংকিং তৈরি করে ৬টি মূল সূচকের উপর ভিত্তি করে, যেগুলো হলো:
- বিশ্ব নেতৃত্বে ভূমিকা
- অর্থনৈতিক প্রভাব
- শক্তিশালী রপ্তানি খাত
- রাজনৈতিক প্রভাব
- আন্তর্জাতিক জোট ও মিত্রতা
- শক্তিশালী সামরিক বাহিনী
এই ছয়টি সূচকই নির্ধারণ করে একটি দেশের ‘পাওয়ার সাবর্যাংকিং’। ২০২৪ সালের তালিকায় বাংলাদেশ এসব সূচকের ভিত্তিতে ৪৭তম স্থানে রয়েছে। উল্লেখযোগ্য যে, এই তালিকাটি ১৭ হাজার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়।
এছাড়া, ভুল তথ্য যাচাই নিয়ে প্রকাশিত অনুসন্ধান অনুসারে, তালিকার প্রকৃত প্রকাশনার তারিখ, জরিপের সময়কাল ও ব্যবহৃত সূচক যথাযথভাবে যাচাই না করেই ভুল দাবি ছড়ানো হচ্ছে।
বাংলাদেশের অবস্থান: গর্ব নাকি গুজব?
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের জন্য ৪৭তম অবস্থান কোনোভাবেই খারাপ নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র ভারতই বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে, যার অবস্থান ১২তম। পাকিস্তান, ভুটান কিংবা মালদ্বীপ এই তালিকায় স্থানই পায়নি। কাজেই এই অবস্থান একটি সম্মানজনক ও স্থিতিশীল অর্জন।
তবে এটাও সত্য, তালিকা প্রকাশের সময় ও এর পেছনের গবেষণা না বুঝে যেভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তা খুবই দুঃখজনক। বিশেষ করে যেখানে আন্তর্জাতিক জরিপ ও সূচকসমূহ এতটাই স্বচ্ছ ও ভিত্তিমূলক। তাই তথ্য যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তথ্য বিভ্রান্তি ও সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা
ফেসবুক পোস্টে যেসব দাবি উঠে এসেছে, তার অধিকাংশই অনির্ভরযোগ্য ও যাচাইবিহীন। প্রথম দাবি যেমন ইউএস নিউজ-এর তালিকাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে, তেমনি দ্বিতীয় দাবির ক্ষেত্রেও ভিন্নধর্মী তালিকার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে যা আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়।
এরকম বিভ্রান্তিকর তথ্য ফ্যাক্টওয়াচ বা রিউমর স্ক্যানারের মতো প্রতিষ্ঠান নির্ভুলভাবে যাচাই করে, যা সাধারণ পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। এ কারণে ভুল তথ্যের প্রভাব নিয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলাও এখন সময়ের দাবি।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশের তালিকা ২০২৫ ঘিরে বাংলাদেশকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভ্রান্তিকর তথ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তথ্য যাচাই ছাড়া যেকোনো দাবি বিশ্বাস করা উচিত নয়। ইউএস নিউজ-এর প্রকৃত তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের ৪৭তম অবস্থান গর্বের হলেও, এই অর্জন নিয়ে অতিরঞ্জন বা গুজব কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই আমাদের উচিত যাচাই করা তথ্য শেয়ার করা এবং ভিত্তিহীন গুজব এড়িয়ে যাওয়া।
FAQs
১. বাংলাদেশের অবস্থান কততম বিশ্বের শক্তিশালী দেশের তালিকায়?
২০২৪ সালের ইউএস নিউজ-এর তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম। তবে এটি ২০২৫ সালের তালিকা নয়, বরং ২০২৪ সালের জরিপভিত্তিক।
২. এই তালিকা কে তৈরি করে এবং কীভাবে?
এই তালিকা তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম US News। তারা প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে তালিকা প্রকাশ করে এবং এটি ৬টি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়।
৩. ৪৭তম অবস্থান মানে কি বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে?
না। এটি এখনো সম্মানজনক অবস্থান, কারণ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই তালিকায় নেই, এবং বাংলাদেশ অনেক ইউরোপীয় দেশকেও পিছনে ফেলেছে।
৪. তালিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশ কি ভবিষ্যতে এগিয়ে যেতে পারে?
অবশ্যই। কূটনৈতিক সম্পর্ক, সামরিক উন্নয়ন, রপ্তানি খাত ইত্যাদিতে অগ্রগতি হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অবস্থান আরও ভালো হতে পারে।
৫. সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তথ্যগুলো কতটা নির্ভরযোগ্য?
অনেক সময় এগুলো যাচাই না করেই শেয়ার করা হয়। তাই নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য যাচাই করেই শেয়ার করাই শ্রেয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।