দেখুন তো! এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতি যেন এক অশান্ত সমুদ্রে ভাসমান এক জাহাজ – কখনও উত্তাল ঢেউ, কখনও গভীর অন্ধকার খাদ। একদিকে চোখ ধাঁধানো প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, অন্যদিকে যুদ্ধ-সংঘাতের দাবানল। কোভিডের ক্ষত এখনও শুকোয়নি, তার ওপর জ্বালানি সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আর ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার ভার। বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই: এই টালমাটাল পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, নীতিনির্ধারক – সকলের কণ্ঠেই একটাই জিজ্ঞাসা: “কি হবে আগামীকাল?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আমাদের এই গভীর অনুসন্ধান।
বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা: সংকটের জটিল জালে আটকে যাওয়া একটি গ্রহ
আজকের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চিত্রটা এক কথায় বিভ্রান্তিকর। মনে হচ্ছে, একইসাথে চলছে একাধিক সংকটের ম্যারাথন দৌড়:
- উচ্চ মূল্যস্ফীতি: ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি গোটা বিশ্বকে কাবু করে ফেলেছে। আমেরিকা, ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোতে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। ইউরোজোনে মুদ্রাস্ফীতির হার কিছুটা কমলেও এখনও লক্ষ্যমাত্রার অনেক ওপরে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি রীতিমতো আতঙ্কের নাম।
- সুদ হার বৃদ্ধির ছোবল: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো (ফেডারেল রিজার্ভ, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক) সুদের হার বাড়িয়েছে দ্রুত গতিতে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ঋণের খরচে। ব্যবসায়িক বিনিয়োগ সংকুচিত হচ্ছে, বাড়িঘর কেনার স্বপ্ন অনেকের কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও এই ট্রেন্ড অনুসরণ করছে, যা স্থানীয় শিল্প ও বিনিয়োগের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
- ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা: ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুধু মানবিক ট্র্যাজেডিই নয়, এর অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্বজোড়া। সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন, শক্তি বাজারে অস্থিরতা, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা – এর সবই যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতি। মধ্যপ্রাচ্যে গাজা সংকট এবং ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য নতুন করে ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে।
- কোভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধারের অনিশ্চয়তা: মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে অনেক দেশ সংগ্রাম করছে। শ্রমবাজারে পরিবর্তন, দূরবর্তী কাজের নতুন সংস্কৃতি, এবং কিছু খাতে দক্ষতার ঘাটতি পুনরুদ্ধারকে ধীরগতির করে দিচ্ছে।
- বিপুল সরকারি ঋণের বোঝা: মহামারী ও সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের বহু দেশ, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলো, বিপুল পরিমাণ ঋণ করেছে। এই ঋণের সুদ পরিশোধ এবং মূলধন ফেরত দেওয়ার চাপ ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণকে সীমিত করছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বারবার এই ঋণের ঝুঁকির ব্যাপারে সতর্ক করে আসছে।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়? এই সংকটগুলো একে অপরের সাথে জটিলভাবে জড়িত। একটির সমাধান খুঁজতে গেলে আরেকটির প্রভাব পড়ছে। এই “পলিসি ট্রেড-অফ” বিশ্ব নেতাদের জন্য রীতিমতো দুরূহ পাজল বানিয়ে দিয়েছে।
অদূর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দৃশ্যপট: আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলছে বিশ্ব
বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা থেকে আগামীর দিকে তাকালে কোনও একক, স্পষ্ট উত্তর নেই। বরং কয়েকটি সম্ভাব্য পথ (Scenario) চিহ্নিত করা যায়, যার প্রতিটিরই আলাদা আলাদা প্রভাব থাকবে:
- “সফল নরম অবতরণ” (Soft Landing): এটি সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুচিন্তিতভাবে সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনবে, কিন্তু অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দেবে না। চাকরির বাজার স্থিতিশীল থাকবে, বিনিয়োগ ধীরে ধীরে ফিরবে, এবং বিশ্ব অর্থনীতি স্থিতিশীল, যদিও মন্থর, প্রবৃদ্ধির পথে ফিরবে। আইএমএফের সাম্প্রতিক পূর্বাভাস কিছুটা এই দিকেই ইঙ্গিত করছে, যদিও তারা ঝুঁকির ব্যাপারে সতর্ক করেছে।
- “কঠিন অবতরণ” (Hard Landing) বা মন্দা: যদি মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত না কমে অথবা বিশ্বব্যাপী চাহিদা হঠাৎ করেই দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে অর্থনীতি মন্দায় (Recession) ঢুকে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। চাকরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ব্যবসা বন্ধ হবে, ঋণ খেলাপি বেড়ে যেতে পারে। উন্নয়নশীল দেশগুলো এই মন্দায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
- “স্থবির প্রবৃদ্ধি” (Stagflation): এটি সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য। এখানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি (Inflation) এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতা (Stagnation) একসাথে দেখা দেয়। অর্থাৎ দাম বাড়তেই থাকে কিন্তু অর্থনীতি বড়তে পারে না, বেকারত্ব বেড়ে যায়। ১৯৭০-এর দশকের তেল সংকটের সময় বিশ্ব এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। বর্তমান শক্তি বাজার ও সরবরাহ শৃঙ্খলের ঝামেলা এই ভয়ের জন্ম দিচ্ছে।
- “অঞ্চলভিত্তিক বিভাজন” (Fragmentation): ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা (যেমন আমেরিকা-চীন বাণিজ্য বিরোধ, রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা) বিশ্ব অর্থনীতিকে ভাগ করে ফেলতে পারে। একদিকে আমেরিকা-ইউরোপ-জাপান-কোরিয়া-অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশের ব্লব, অন্যদিকে রাশিয়া-চীন-ইরানসহ দেশগুলোর ব্লব। এই বিভাজন বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তির প্রবাহকে ব্যাহত করবে, যা সবার জন্যই দামী হবে এবং বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য ও অসমতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
- “আশার আলো আছে, কিন্তু সতর্কতার পরামর্শ দরকার,” বলছেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি উল্লেখ করেন যে উন্নত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখনও ‘সফট ল্যান্ডিং’-এর পথে আছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু যেকোনও বড় ভূ-রাজনৈতিক ধাক্কা (যেমন তাইওয়ান প্রণালী বা মধ্যপ্রাচ্যে সংকট বৃদ্ধি) পরিস্থিতি উল্টে দিতে পারে।
- “উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য ঝুঁকি সবচেয়ে তীব্র,” সতর্ক করে দিচ্ছেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ। দুর্বল মুদ্রা, উচ্চ ঋণের বোঝা এবং আমদানিনির্ভর জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধি দেশগুলোকে চরম চাপে ফেলছে।
উন্নয়নশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনীতির জন্য ঝড়ের পূর্বাভাস: বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে?
বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা যেহেতু জটিল এবং অনিশ্চিত, এর প্রভাব উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর পড়বে সবচেয়ে কঠিনভাবে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের সাথে দেশের অভ্যন্তরীণ কিছু চ্যালেঞ্জ মিলে এক ‘পারফেক্ট স্টর্ম’ তৈরি করছে:
- রপ্তানি আয়ে ধস: ইউরোপ-আমেরিকার মতো প্রধান বাজারগুলোতে চাহিদা কমে যাওয়া এবং ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা সংকুচিত হওয়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে замедিত হয়েছে। নতুন অর্ডার কমে যাওয়ায় কারখানাগুলোতে কর্মঘণ্টা কমছে, শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা বাড়ছে।
- রেমিট্যান্স প্রবাহে চাপ: বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা এবং মধ্যপ্রাচ্যে চাকরির বাজার সংকুচিত হওয়ায় প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, যা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- জ্বালানি ও খাদ্য আমদানির উচ্চ মূল্য: আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গম, ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক উচ্চতায় থাকায় আমদানি বিল বিপুল পরিমাণে বেড়ে গেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর এবং দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের দামের ওপর।
- মুদ্রার অবমূল্যায়ন: মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার মান ক্রমাগত কমছে। এর ফলে আমদানি করা পণ্য আরও ব্যয়বহুল হচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে।
- মুদ্রাস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস: দেশে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে ৮%-৯% এর আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে, যা নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মানকে চরমভাবে সংকুচিত করে ফেলেছে।
- আন্তর্জাতিক সাহায্য ও ঋণপ্রবাহে অনিশ্চয়তা: উন্নত দেশগুলো নিজেদের সংকটে জড়িত থাকায় এবং ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনায় উন্নয়ন সহায়তা ও নরম ঋণে কাটছাঁট হতে পারে, যা বাংলাদেশের উন্নয়ন বাজেট ও প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য জরুরি পদক্ষেপ কী?
- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ (নতুন বাজার অনুসন্ধান, উচ্চমূল্যের পণ্যে যাওয়া) এবং রেমিট্যান্স আনয়নে প্রণোদনা জোরদার করা।
- আমদানি সংকোচনে জরুরি ভিত্তিতে অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমানো এবং বিদ্যুৎ-জ্বালানি সাশ্রয়ের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া।
- কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যাতে আমদানিনির্ভরতা কমে।
- সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা ও প্রভাব বাড়িয়ে দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীকে মূল্যস্ফীতির ধাক্কা থেকে রক্ষা করা।
- রাজস্ব আদায়ে সংস্কার এনে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো।
বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব নিয়ে আরও গভীর বিশ্লেষণের জন্য আমাদের পূর্ববর্তী প্রতিবেদনটি পড়তে পারেন।
টেকসই ভবিষ্যতের দিকে: সবুজ অর্থনীতি ও প্রযুক্তিই কি মুক্তির পথ?
এই ঘন অন্ধকারেও আশার আলো দেখার কিছু কারণ আছে। বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা পরিবর্তনের চাবিকাঠি হতে পারে দুটি শক্তি:
প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন (Technological Innovation):
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI): উৎপাদনশীলতা বিপ্লব ঘটানোর, নতুন পণ্য-সেবা সৃষ্টির এবং সরবরাহ শৃঙ্খলকে আরও দক্ষ করার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে AI-এর। তবে এর ফলে চাকরির বাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে, যার জন্য কর্মীদের পুনর্বিন্যাস (Reskilling) জরুরি।
- জীবপ্রযুক্তি (Biotech): স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় কমানো, খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো এবং টেকসই জ্বালানি ও উপকরণ তৈরি করার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
- হরাইজন্টাল টেক (CleanTech): সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, ব্যাটারি স্টোরেজ প্রযুক্তির দাম দ্রুত কমছে, যা জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইকে অর্থনৈতিকভাবে আরও সম্ভবপর করে তুলছে।
- সবুজ রূপান্তর (Green Transition):
- জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব মোকাবিলা এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জ্বালানি খাতের রূপান্তর এখন আর পছন্দের বিষয় নয়, বরং অপরিহার্য।
- এই রূপান্তরে বিপুল বিনিয়োগের (Renewable Energy, Electric Vehicles, Energy Efficiency) সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা নতুন শিল্প ও লাখ লাখ সবুজ চাকরি (Green Jobs) সৃষ্টির পথ খুলে দিতে পারে।
- উন্নয়নশীল দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য, অভিযোজন (Adaptation) ও প্রশমন (Mitigation) প্রকল্পে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন পাওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চ্যালেঞ্জ: এই রূপান্তর সহজ নয়। প্রচুর প্রাথমিক বিনিয়োগ দরকার। জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক শিল্প ও কর্মক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপান্তর (Just Transition) নিশ্চিত করা হবে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা তাই শুধুই সংকটের গল্প নয়, এটা এক বিপুল রূপান্তরের মুখোমুখি হওয়ার গল্প। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সুদের হার বৃদ্ধি, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মন্দার ভয় – এই সবকিছুর মধ্য দিয়েই বিশ্বকে এগোতে হবে ভবিষ্যতের দিকে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই ঝড় আরও ভয়াবহ, যেখানে বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিগুলো বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, আমদানিনির্ভরতা এবং অভ্যন্তরীণ চাপের সাথে লড়াই করছে। তবুও আশা হারানোর সময় এখনও আসেনি। প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতি এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় গ্লোবাল জোটের উদ্যোগ ভবিষ্যতের জন্য নতুন পথ খুলে দিতে পারে। এই অনিশ্চিত যুগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে সহযোগিতা, অভিযোজন ক্ষমতা এবং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই নীতির প্রতি অঙ্গীকার। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী – সকলেরই এই কঠিন সময়ে সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়া, সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সতর্ক হওয়া এবং ভবিষ্যতের দক্ষতায় নিজেদের প্রস্তুত করা জরুরি। বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা আমাদের শেখাচ্ছে যে অতীতের মডেল ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ট নয়; আমাদের ভাবতে হবে নতুন করে, কাজ করতে হবে দলবদ্ধভাবে। এই জ্ঞান ও প্রস্তুতিই আমাদের আগামী দিনের অনিশ্চয়তাকে সম্ভাবনায় রূপান্তরের হাতিয়ার। আপনার অর্থনৈতিক সাক্ষরতা বাড়ান, স্থানীয় ও বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহে সজাগ থাকুন – কারণ এই বোঝাপড়াই আগামী দিনে আপনার সবচেয়ে বড় সুরক্ষা কবচ।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা কেন এতটা অনিশ্চিত বলে মনে হচ্ছে?
বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি অনিশ্চিত হওয়ার পেছনে একাধিক জটিল কারণ কাজ করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্য সংকট সরবরাহ শৃঙ্খলকে ব্যাহত করেছে, জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বাড়িয়েছে। একইসাথে, কোভিড-পরবর্তী পুনরুদ্ধার পুরোপুরি হয়নি। বিশ্বজুড়ে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়াচ্ছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ঝুঁকিতে ফেলছে। এছাড়া আমেরিকা-চীন বাণিজ্য উত্তেজনা ও বৈশ্বিক ঋণের উচ্চ স্তরও অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে।
২. বৈশ্বিক মন্দা (Global Recession) কি আসন্ন?
বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না যে বৈশ্বিক মন্দা হবে কিনা। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক কিছুটা প্রবৃদ্ধি হ্রাসের পূর্বাভাস দিলেও এখনই পূর্ণাঙ্গ মন্দার কথা বলছেন না। তবে, ঝুঁকি অবশ্যই বিদ্যমান। যদি মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত না কমে বা নতুন কোনও বড় ধাক্কা (যেমন ভূ-রাজনৈতিক সংকট তীব্রতর হওয়া) আসে, তাহলে মন্দার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মন্দার প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে।
৩. বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনে কী প্রভাব ফেলছে?
বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান সংকটের সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়। আমদানিকৃত জ্বালানি ও পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশে খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আমদানি সংকোচন করা হচ্ছে, যা কিছু পণ্যের সরবরাহে প্রভাব ফেলতে পারে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে ধীরগতি নতুন চাকরি সৃষ্টি এবং বিদ্যমান চাকরির নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলছে। ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমার কারণে বিদেশ ভ্রমণ বা পড়াশোনার খরচও বেড়েছে।
৪. বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ব্যক্তিপর্যায়ে কীভাবে সুরক্ষিত থাকা যায়?
এই অনিশ্চিত সময়ে আর্থিকভাবে সুরক্ষিত থাকতে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
- সঞ্চয় বাড়ানো: অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো এবং জরুরি তহবিল (Emergency Fund) গড়ে তোলা।
- ঋণ নিয়ন্ত্রণ: উচ্চ সুদের ঋণ এড়িয়ে চলা এবং বিদ্যমান ঋণ যথাসম্ভব দ্রুত শোধের চেষ্টা করা।
- বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনা: শুধুমাত্র এক ধরনের সম্পদে বিনিয়োগ না করে বিভিন্ন খাতে (যেমন সঞ্চয়পত্র, ভাল কোম্পানির শেয়ার, সোনা – সতর্কতার সাথে) বিনিয়োগ ছড়িয়ে দেওয়া।
- দক্ষতা বৃদ্ধি: চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে প্রাসঙ্গিক নতুন দক্ষতা শেখা।
- সচেতন ভোক্তা হওয়া: দাম তুলনা করা, প্রয়োজন ছাড়া কেনাকাটা না করা।
৫. বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
বাংলাদেশের অর্থনীতির মুখোমুখি হওয়া প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট: আমদানি বিল মেটানো এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে চাপ।
- উচ্চ ও স্থায়ী মুদ্রাস্ফীতি: বিশেষ করে খাদ্য ও জ্বালানিতে, যা দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলছে।
- রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের অনিশ্চয়তা: বৈশ্বিক চাহিদা দুর্বলতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাজারের ওপর নির্ভরতা ঝুঁকি তৈরি করছে।
- ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা: খেলাপি ঋণের উচ্চ হার এবং তারল্য সংকট।
- রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতা: উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করছে।
৬. এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সরকারের করণীয় কী কী?
সরকারের জন্য জরুরি পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির জন্য রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে জোর দেওয়া।
- অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।
- জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে কঠোর নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
- কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া।
- রাজস্ব সংস্কার এনে রাজস্ব আয় বাড়ানো।
- দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা ও প্রভাব বাড়ানো।
- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার তদারকি জোরদার করা এবং কার্টেল ও মজুতদারি কঠোর হস্তে দমন করা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।