বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : মানুষের দাঁত মাত্র দুবার গজায়। ছয় মাস বয়স থেকে ওঠে দুধ দাঁত। সেগুলো ছয় থেকে বারো বছর বয়সেই পড়ে যায়। এরপর যে দাঁতের দেখা মেলে, তা স্থায়ী দাঁত। এই স্থায়ী দাঁত ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রাকৃতিকভাবে সেখানে আর দাঁত গজায় না। আর কিশোর বয়সে চকলেট, আইসক্রিমের প্রেমে পড়ে অনেকেই স্থায়ী দাঁতের কয়েকটা হারিয়ে ফেলেন। অনেকের দাঁত পোকায় ধরে। ফলে অল্প বয়সে সে দাঁত পড়ে যায় বা উঠিয়ে ফেলতে হয়। এই বিষয়টা নিয়ে মানুষের আক্ষেপের শেষ নেই। থাকবে নাই-বা কেন! অনেক প্রাণীর দাঁত পড়ে, আবার নতুনভাবে গজায়। মানুষের বেলায় তা হয় না।
সেই আক্ষেপ উপশমে কিছুটা সফল হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দাঁতের চিকিৎসায় এটা যুগান্তকারী আবিষ্কার হবে! যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের গবেষকেরা সফলভাবে ল্যাবরেটরিতে দাঁত গজাতে সক্ষম হয়েছেন। চূড়ান্ত সফলতা ধরা দিলে বিপ্লব ঘটে যাবে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দাঁতও সাধারণ নিয়মে ধীর গতিতে গজাবে।
এই সাফল্যের গুরুত্ব কতটা, তা ধারণা করতে পারছেন! তা বুঝতে হলে প্রথমে বর্তমানের দাঁত মেরামতের পদ্ধতিগুলোর সীমাবদ্ধতা জেনে নিই। তাহলে কিছুটা খোলাসা হবে। বর্তমানে দাঁতে ফিলিং করা হয়।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই গবেষণা। মূল লক্ষ্য ছিল দাঁত গঠনে মানবদেহের মতো জটিল জৈব পরিবেশ সৃষ্টি করা। শরীরের কোষীয় ম্যাট্রিক্সের মতো কাজ করবে এমন বিশেষ একটা উপাদান তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই উপাদানটি দাঁত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণার এ ধাপটি প্রকৃত ও কার্যকর দাঁত পাওয়ার জন্য অপরিহার্য ছিল।
কিংস কলেজ লন্ডনের রিজেনারেটিভ ডেন্টিস্ট্রির পরিচালক আনা অ্যাঞ্জেলোভা ভলপনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন উপকরণ ব্যবহার করে একটা কোষীয় ম্যাট্রিক্স তৈরি করি। এটা কোষগুলোর মধ্যে সফলভাবে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটায়। ফলে ল্যাবের পাত্রেই দাঁত গঠন সহায়ক ও সহজ হয়। আমাদের ধারণার চেয়েও উপযোগী ছিল সেই পরিবেশ। এভাবে আমরা হয়তো মানুষের দাঁত ল্যাবে তৈরির আরও এক ধাপ কাছে চলে গেলাম।’
এই সাফল্যের গুরুত্ব কতটা, তা ধারণা করতে পারছেন! তা বুঝতে হলে প্রথমে বর্তমানের দাঁত মেরামতের পদ্ধতিগুলোর সীমাবদ্ধতা জেনে নিই। তাহলে কিছুটা খোলাসা হবে। বর্তমানে দাঁতে ফিলিং করা হয়। ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত টিকিয়ে রাখতে বহুল ব্যবহৃত চিকিৎসা পদ্ধতি এটা। কিন্তু এটা সাময়িক সমাধান। ডেন্টাল অ্যান্ড ক্র্যানিওফেশিয়াল সায়েন্সেস ফ্যাকাল্টির গবেষক জিউশেন ঝ্যাং বলেন, ‘দাঁত ফিলিং করা ভালো কোনো সমাধান নয়। বরং তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাঁতের স্থায়িত্ব দুর্বল করে দেয়। ফিলিং বেশিদিন টিকেও না। এছাড়া দাঁতের অতিরিক্ত ক্ষয় হয়।’
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই গবেষণা। মূল লক্ষ্য ছিল দাঁত গঠনে মানবদেহের মতো জটিল জৈব পরিবেশ সৃষ্টি করা। শরীরের কোষীয় ম্যাট্রিক্সের মতো কাজ করবে এমন বিশেষ একটা উপাদান তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা।
অন্যদিকে ইমপ্লান্ট চিকিৎসা পদ্ধতি তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী। তবে জটিল অপারেশন ও ভালোভাবে সংরক্ষিত ‘অ্যালভিওলার বোন’ প্রয়োজন। চোয়ালের হারকে অ্যালভিওলার বোন বলে। এই হাড়েই দাঁত যুক্ত থাকে। ওপরের দুটি সমাধানই কৃত্রিম। স্বাভাবিক দাঁতের গঠন ও কার্যকারিতা ফিরিয়ে আনতে পুরোপুরি ব্যর্থ।
নতুন এ গবেষণার ফল এমন সমস্যাগুলোর সমাধান করবে। রোগীর নিজের কোষ থেকে সৃষ্ট দাঁত শরীরের সঙ্গে মানিয়ে নেবে। এগুলো প্রাকৃতিক দাঁতের হুবহু বিকল্প হতে পারে। স্বাভাবিকভাবে মিশে যাবে চোয়ালের সঙ্গেও। ক্ষয় হলে নিজেই সে ক্ষয় পূরণ করবে। কৃত্রিম বা সিনথেটিক পদার্থের সংস্পর্শে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এই দাঁত। ঝ্যাং জানান, ‘ল্যাবে তৈরি দাঁত প্রাকৃতিকভাবে আবার জেগে ওঠবে। আসল দাঁতের মতোই চোয়ালের সঙ্গে লেগে থাকবে। আরও মজবুত, দীর্ঘস্থায়ী হবে এগুলো।’
ওপরে কোষীয় ম্যাট্রিক্সের কথা বলেছি। এটা শরীরের আভ্যন্তরীণ পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তবে এর আগেও এই চেষ্টা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কোষের সংকেত আদান-প্রদান ছন্নছাড়া ও আচমকা ছিল বলে সে চেষ্টাগুলো আলোর মুখ দেখেনি। তাছাড়া এক সঙ্গে সব সংকেত পাঠানোর পদ্ধতিও ঠিক ছিল না। নতুন পদার্থ বা উপাদান এই সমস্যা সমাধান করেছে। নতুন দাঁত গজানোর পাশাপাশি এ সমাধানটিও বিজ্ঞানীদের জন্য অনন্য এক বিষয়। আসল দাঁতের কোষগুলো যে ক্রমে কাজ করে, ঠিক যে ধীর গতিতে সংকেত বিনিময় করে, গবেষকদের তৈরি এই উপাদানও সেভাবেই কাজ করে। কোষগুলোকে এ উপাদানের পরিবেশে রাখা হলে ধীরে ধীরে দাঁতের গঠন শুরু হয়।
ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত টিকিয়ে রাখতে বহুল ব্যবহৃত চিকিৎসা পদ্ধতি এটা। কিন্তু এটা সাময়িক সমাধান। ডেন্টাল অ্যান্ড ক্র্যানিওফেশিয়াল সায়েন্সেস ফ্যাকাল্টির গবেষক জিউশেন ঝ্যাং বলেন, ‘দাঁত ফিলিং করা ভালো কোনো সমাধান নয়।
এখন গবেষকেরা সম্ভাব্য দুটি চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছেন। দাঁত ল্যাবে তৈরি করে রোগীর চোয়ালে বসানো। আর প্রাথমিক লেবেলেই দাঁতের কোষ সরাসরি রোগীর চোয়ালে স্থাপন করা। এ পদ্ধতিতে চোয়ালে কোষ নিজেই বিকশিত হবে। অর্থাৎ, ঠিক যেখানে আসল দাঁত ছিল, সে স্থানে ল্যাবে তৈরি দাঁতের প্রাথমিক কোষ যুক্ত করার কথা ভাবছেন গবেষকরা। এরপর তা মুখের ভেতর বেড়ে ওঠবে।
দাঁত হাসির প্রতীক। শুধু হাসি নয়, খাবারে তৃপ্তি আসে মূলত দাঁতের কর্ষণে। তাই হারানো দাঁতের পুনর্জন্ম চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক বিশাল বিপ্লব এনে দেবে, সন্দেহ নেই। ভলপনি মনে করেন, ‘যত সময় যাবে, এ কৌশলগুলো তত উন্নত হবে। এতে দাঁতের চিকিৎসা বদলে যেতে পারে। দাঁতের এই পুনর্জন্ম টেকসই ও কার্যকর সমাধান’
হয়তো নতুন এই পদ্ধতি শিগগিরই সাধারণ চিকিৎসার অংশ হয়ে ওঠবে। বয়সের কারণে দাঁত প্রভাবিত হবে না। বুড়ো বয়সেও ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত আবার গজাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা কলেজ
সূত্র: কিংস কলেজ লন্ডন, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউকে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।