শরীফ হেলালী: ছোটবেলায় একদিন সকালে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় মায়ের কান্না ও চিৎকারে। বারবার আমার বড় ভাইয়ের নাম নিচ্ছিলো আর রোনাজারি করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। অনেকদূর গিয়ে মাকে আমরা থামালাম। কী হয়েছে? কী হয়েছে? অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর মা জানালেন, তোর বড় ভাই এক্সিডেন্ট করেছে। দুইটা পা ভেঙ্গে গেছে। শরীরের আরও অনেক জায়গায় নাকি মারাত্মক জখম পেয়েছে। সাতসকালে মাকে এরকম একটি দুঃসংবাদ আমার নানার বাড়ি থেকে একজন লোক এসে জানিয়ে গেছেন। তখন মোবাইল ফোনে যোগাযোগ ছিল না। আমার মাসহ আমরা আমাদের নানার বাড়িতে গিয়ে ভাইয়াকে দুই পায়ে পুরো ব্যান্ডেজসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ লাগানো অবস্থায় বিছানায় শুয়ে কাঁতরাতে দেখলাম।
পরে জানতে পারলাম, আগেরদিন বিকেলে নোয়াখালীর চাটখিল বাজারের নিকটবর্তী একটি ব্রিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে উঠার সময় রাস্তার পাশে দুইজন লোক মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে এবং সেখানে কিছুক্ষণ অজ্ঞান অবস্থায় ছিলো। তারপর স্থানীয় লোকজন সেখান থেকে তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। একরাত হাসপাতালে রেখে তাদেরকে পরদিন সকালে রিলিজ করে দেওয়া হলে তারা আমার নানার বাড়িতে এসে উঠেন। আমার ভাই ছাড়া অন্যজন আমার সম্পর্কে মামা ছিলেন। মূলত মামাই মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিলেন। আর আমার ভাই মোটরসাইকেলের পেছনে ছিলেন। পরে জানা যায়, তাদের মোটরসাইকেলের স্পিড বেশি ছিলো। কিন্তু রাস্তা এবং ব্রিজের সংযোগস্থলের মাটি কিছুটা সরে যাওয়ায় তাদের মোটরসাইকেল গতির কারণে ব্রিজে না উঠে ব্রিজের মুখে ধাক্কা লেগে রাস্তার একপাশে পড়ে যায়! পরে হাসপাতাল থেকে আমার ভাইকে নিয়ে এসে আমার নানার বাড়িতে রাখা হয়েছে। সেই ঘটনায় আমার ভাইয়ের সুস্থ হতে অনেকদিন সময় লেগেছিলো! বয়সে ছোট থাকায় আমি সেদিন সেই দুর্ঘটনায় আমার ভাইয়ের যন্ত্রণা, আমার মায়ের রোনাজারির মর্মার্থ কিংবা আর কী পরণতি হতে পারতো তা অনুমান করতে পারিনি!
কিন্তু সময় আর বয়সের সাথে সাথে অনেক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছি, শুনেছি কিংবা পত্রিকা, টিভি নিউজ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেনেছি। প্রতিটি ঘটনাই অত্যন্ত মর্মান্তিক ও মর্মস্পর্শী। প্রতিটি ঘটনাই তাজা প্রাণ হারানোর করুণ কাহিনী। বাবা-মায়ের বুক খালি করে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কিংবা অন্য কোনো যানবাহন দুর্ঘটনায় লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে। এই লেখাটি মূলত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা। এপ্রসঙ্গে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার অনেকগুলো ঘটনাই এখন মনে পড়ছে। তবে সবগুলো ঘটনা এখানে বিস্তারিত লেখা সম্ভব নয়। তারপরও দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
২০০৫ সালে ঢাকায় থাকাকালে একদিন সকালে হঠাৎ দেখি, আমার রুমমেট সাদিয়ার রহমান ভাই হাউমাউ করে কাদতে লাগলেন আর ব্যাপক অস্থির হয়ে পড়লেন। পরে জানতে পারলাম, তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাইলট ভাই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় একটু আগেই মারা গেছেন! এমন একটি সংবাদে আমরা সবাই স্তম্ভিত ও শোকাহত হয়ে পড়ি। কোনোভাবেই এমন মৃত্যু বিশ্বাস হচ্ছিল না। পাইলট ভাই মাত্র কয়েকদিন আগেই আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। অত্যন্ত মেধাবী ও পরিশ্রমী ছিলেন। দেশ ও জাতিগঠনে অবদান রাখতে তার অনেক চিন্তা এবং পরিকল্পনার কথা আমাদেরকে জানিয়েছেন। অথচ তিনিই অকস্মাৎ এভাবে বিদায় নিয়ে গেলেন! বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। ভাবতেই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো! সাদিয়ার ভাইয়ের মতো আমরাও সেদিন অনেক ব্যথিত হয়েছি; শোকাহত হয়েছি! বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অন্য ডিপার্টমেন্টের আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু একদিন শুক্রবার ঢাকা শহরের অদূরে আরিচায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায়! সে কষ্ট, সে শোক কিছুতেই ভুলে যাবার নয়! আমি কুষ্টিয়াতে থাকাকালে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক স্যারের গানম্যান ছিলেন ইব্রাহিম। খুবই হ্যান্ডসাম ও বিনয়ী ছেলে ছিলো। কুষ্টিয়া থেকে চলে আসার পর একদিন ফেসবুকে দেখতে পাই, ইব্রাহিম মোটরসাইকেল এক্সিডেন্টে মারা গেছেন! খুবই হৃদয়বিদারক! ইব্রাহিমের বয়স পঁচিশ বা ছাব্বিশের মতো হবে। তার ফুটফুটে একটা ছেলে সন্তান আছে!
শুরুতে আমার আপন বড় ভাইয়ের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কথা বলেছিলাম। আমার সেই ভাইয়ের শেষ ঘটনাটিও বলি। ২০১৬ সালের ২৬ আগস্ট রাত নয়টায় দিকে আমি ল্যাপটপে বসে একটা কাজ করছিলাম। এমন সময় আমার ছোট ভাই আমাকে ফোন করেই একটা দুঃসংবাদ দিলো। সে কথা বেশি না ঘুরিয়ে আমাকে অকপটে বলে ফেললো, বড় ভাইয়া মোটরসাইকেল এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। এই কথা শুনামাত্রই আমি কাঁদতে কাঁদতে অস্থির ও বেসামাল হয়ে পড়ি। আমার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। পরক্ষণে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে দ্রুত বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা করলাম। বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম, আমার ভাই এই ক্ষেত্রেও মোটরসাইকেলের চালক ছিলেন না। মোটরসাইকেলের আরোহী ছিলো মোট তিনজন। আমার ভাইয়ের বন্ধু গাড়িটি ড্রাইভ করছিলেন। আমার ভাই সবার পিছনে বসেছিলেন। গাড়ির স্পিডের কারণে আমার ভাই পেছন থেকে হঠাৎ ছিটকে পড়ে যান এবং সাথে সাথে একটি ট্রাক এসে তার পেটের উপর দিয়ে চলে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই ব্যাপক ব্লিডিং হয়ে তিনি স্পট ডেড! মাত্র ৪০ বছর বয়সে তিনি এক মেয়ে ও এক ছেলে রেখে আমাদেরকে ছেড়ে অকালেই চলে গেছেন।
এটি স্বাভাবিক যে, এরকম অসংখ্য দুর্ঘটনা কিংবা মৃত্যুর কাহিনী অনেকেরই জানা আছে! প্রতিদিন আমরা আমাদের আত্মীয়-অনাত্মীয় অনেকের এরকম অনেক অকাল মৃত্যুর খবর পেয়ে থাকি। মিডিয়ার মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এরকম অনেক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর জানতে পারছি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯ সালে দেশে ১১৮৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল ৯৪৫ জন। পরের বছর ২০২০ সালে এ মৃত্যর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪৬৩ জনে, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটে ১৩৮১টি। সবশেষ ২০২১ সালে ২০৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২ হাজার ২ জন। সব মিলিয়ে গত তিন বছরে ৪৬৪৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৪৬২২ জনের। এতে দেখা যায় ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৬.১৪ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪.৮১ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায়২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০.৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫১.৩৩ শতাংশ। এছাড়া সব শেষ বছর ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০৭৮টি, নিহত হয়েছে ২ হাজার ২১৪ জন, আহত ১ হাজার ৩০৯ জন। নিহতের মধ্যে ৭৪.৩৯ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী।
উপরের তথ্যমতে, প্রতিবছর আমাদের দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে এবং মৃত্যুও আশংকাজনক হারে বাড়ছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মোটরসাইকেল ছাড়া অন্যান্য মোটরযানের ক্ষেত্রেও প্রায়শই অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে এবং অনেক মানুষ মারা যাচ্ছেন! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এতো দুর্ঘটনা ঘটছে? কেন এতো মৃত্যু হচ্ছে? এর পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা যায়: ১) বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ২) ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো ৩) হেলমেট পরিধান না করা ৪) সংশ্লিষ্ট আইন অমান্য করা ৫) দুই এর অধিক যাত্রী আরোহণ করা ৬) ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো ৭) নেশাগ্রস্ত হয়ে গাড়ি চালানো ৮) অদক্ষতা ৯) মহাসড়কে চালকদের ওভারটেকিং বা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, ইত্যাদি।
প্রশাসন ক্যাডারে চাকুরি করার সুবাদে আমি দুইটি জেলায় বিআরটিএ এর ড্রাইভিং লাইসেন্স এর লিখিত, ফিল্ড টেস্ট ও মৌখিক পরীক্ষার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলাম। প্রতিটি ফিল্ড টেস্টেই প্রায় ৬০-৭০% আবেদনকারী ফেল করতেন। অথচ তাদের অনেকেই নাকি কয়েক বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন! এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকালে অনেককে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো, হেলমেটবিহীন গাড়ি চালানো ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধে জরিমানাও করেছি। কিন্তু জরিমানা করলেও তাদের অনেকে মোটেও সচেতন হন না। আবার একই অপরাধ করে থাকেন।
এসব লাইসেন্সবিহীন, অদক্ষ, বেপরোয়া, নেশাগ্রস্ত, হিরোভাব দেখানো ড্রাইভাররাই প্রায় সময় দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন বলে ধারণা করা যায়। তবে অনেক শিক্ষিত ও সচেতন লোকেরাও অনেক ক্ষেত্রে নিজে ড্রাইভ করলে কিংবা ড্রাইভার থাকলে অথবা কোনো রাইডে উঠে কোনো প্রোগ্রামে এটেন্ড করার জন্য বাসা থেকে দেরি করে ফেললে পরে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে যেতে অস্থির হয়ে পড়েন কিংবা ড্রাইভারকে স্পিডে চালিয়ে যেতে প্ররোচিত করেন। এমন ক্ষেত্রেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে! এটি মোটেও কাম্য নয়। এমন মানসিকতা পরিহার করতে হবে। বাসা থেকে প্রয়োজনীয় সময় নিয়ে বের হতে হবে এবং স্বাভাবিক গতিতে ধীর-স্থিরভাবে গাড়ি চালাতে হবে।
এ জাতীয় দুর্ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই মৃত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়! অনেকে মারা না গেলেও গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন এবং সারাজীবন অসহায় ও কষ্টের জীবন পরিচালনা করেন। যদিও জন্ম-মৃত্যুর উপর আমাদের কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। তথাপিও সকলকে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে। নিজের খামখেয়ালিপনার কারণে যাতে নিজের মূল্যবান জীবন কিংবা অন্যের জীবন শেষ না হয় এবং পরিবারের অন্যদের জীবন যাতে বিপন্ন না হয় সে বিষয়টি অবশ্যই সবসময় মাথায় রেখে চলতে হবে। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট আইন-কানুন মেনে চলতে হবে। প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো উচিত নয়। মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে কখনোই খেলা করা সমীচীন নয়! কোনো পরিবারকেই যাতে এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত অকালমৃত্যুর ক্ষতি বহন করতে না হয়, এটিই কাম্য। এক্ষেত্রে সকলেরই সচেতন হওয়া জরুরি।
লেখক: সিনিয়র সহকারী কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, চট্টগ্রাম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।