মো. মামুনুর রশীদ : বন্যার পানি নেমে গেছে। সামনে বোরোর চাষ করবেন নাটোরের কৃষকরা। কিন্তু তার আগে তারা ঘরে তুলবেন সরিষা ফসল। অন্যান্য ফসলের তুলনায় সরিষার চাষাবাদ খরচ কম। যে কারণে জেলার চলনবিল ও হালতিবিলে সরিষা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কৃষকরা। এবার আবাদও ভালো হয়েছে তাদের।
জানা গেছে, চলনবিল ও হালতিবিলের মতো এক ফসলি এলাকাসহ গ্রামাঞ্চলে বেড়েছে সরিষার চাষাবাদ। এ ফসলের ফলন ও দাম দুটোই ভালো। যে কারণে কৃষকরা বোরো ধান চাষাবাদের আগেই সরিষা আবাদে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। গত দুই বছর ধরে সরিষা চাষাবাদের পরিধি অনেকাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।
চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এক হাজার ৬৯৮ হেক্টর বেশি জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে ১১ হাজার ৬৮৬ মেট্রিক টন। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ১০ হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন। এতে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারজাতও করা গেছে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে সাত উপজেলায় সরিষা চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় আট হাজার ৫৩০ হেক্টর। চাষাবাদ হয়েছে ১০ হাজার ২২৮ হেক্টর। এবার সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৬৮৬ মেট্রিক টন।
গত মৌসুমে সরিষা চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিল পাঁচ হাজার ৫০ হেক্টর। সেখানে চাষাবাদ হয়েছিল সাত হাজার ৭৪৮ হেক্টর। সরিষা উৎপাদন হয়েছিল ১০ হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন। এবারও সরিষার বাম্পার ফলন হবে বলে আশা প্রকাশ করছে কৃষি বিভাগ।
চলতি মৌসুমে জেলার সদর উপজেলায় এক হাজার ১৮৫ হেক্টর, নলডাঙ্গা উপজেলায় ৫৩০ হেক্টর, সিংড়া উপজেলায় চার হাজার ৬২০ হেক্টর, বড়াইগ্রাম উপজেলায় এক হাজার ৭৫৩ হেক্টর, গুরুদাসপুরে ৯৮০ হেক্টর, বাগাতিপাড়ায় ৫৫০ হেক্টর ও লালপুরে ৬১০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে।
সাধারণত বছরের নভেম্বর মাসে সরিষার বীজ বপন করা হয়। জাত ভেদে বীজ বপন থেকে ৭০ হতে ১২০ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা যায়। এবার সবচেয়ে বেশি চাষাবাদ হয়েছে বারি সরিষা-১৪ জাত। যার গড় ফলন প্রতি হেক্টরে এক দশমিক চার থেকে ৬ মেট্রিক টন। এছাড়া বারি সরিষা-১৮, ৮, ৯, ১৫, ১৭ জাত ও সরিষা উন্নত জাত এবং বিনা সরিষা-৯ জাত চাষাবাদ হয়েছে। এবার সরিষা চাষাবাদের জন্য আবহাওয়া অনুকূলে ও পরিবেশ ভালো ছিল। ফলে ফসলের অবস্থাও বেশ ভালো।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ইতোমধ্যে অধিকাংশ স্থানে সরিষায় ফল এসেছে, যা কাটার উপযোগীও হয়ে উঠেছে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সরিষা ঘরে তোলার জন্য পুরোদমে কাটার কাজ শুরু হবে। কোথাও কোথাও অবশ্য সরিষা কাটা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে উঁচু এলাকায় যে সমস্ত জমিতে আগে চাষাবাদ শুরু হয়েছিল, সে সমস্ত এলাকায় ফসল কাটা চলছে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানভেদে বিঘা প্রতি ফলন হচ্ছে সাড়ে তিন মণ থেকে সাড়ে চার মণ হারে। নলডাঙ্গা উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের কৃষক মো. খোরশেদ আলম এ বছর ৫০ শতাংশ সরিষার আবাদ করেছেন। এবার তার বিঘা প্রতি সাড়ে চার মণ হারে ফলন হয়েছে। হলুদঘর, সড়কুতিয়া, মাধনগরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের কৃষকেরা প্রায় একই ফলনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। অনুকূল পরিবেশ থাকায় এবার ফলন ভালো বলে জানান তারা।
দেশের বৃহত্তম চলনবিল ও হালতিবিলে ব্যাপক সরিষার চাষাবাদ সম্পর্কে কৃষকরা বলেন, বন্যার পানি আগাম নেমে যাওয়ার ফলে বোরো চাষাবাদ আরও দেরিতে শুরু হবে। তাই তারা কৃষি বিভাগের সঙ্গে পরামর্শ করে স্বল্প সময় ও অল্প খরচে সরিষার চাষ বেছে নেন। খরচ কম ও সময়ও সাশ্রয় হওয়ায় বিল এলাকার কৃষকরা আগ্রহ নিয়ে এ ফসলের চাষ করেছেন। একই জমিতে সরিষা ও বোরো ধান আবাদের পরিবেশ আগে ছিল না। কারণ, এ এলাকায় আগে বোরো ছাড়া অন্য কোনো ফসলের আবাদ হতো না।
সরিষা ছাড়াও এ অঞ্চলে এখন গম, ভুট্টা, কাদায় রসুন, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ হচ্ছে। হালতিবিল সংলগ্ন খাজুরা গ্রামের কৃষক সাদেক আলী, চলনবিলের কৃষক সামসুল ইসলাম, শুকুর আলী, আব্দুল বাতেন, সোনা মিয়ারা জানান, বোরোর আবার আরও পরে শুরু হবে। তবে, সরিষার ফলন যে সমস্ত জমি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, সেখানে এখনই বোরোর বীজতলা তৈরি করা হচ্ছে।
নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার ফৌজিয়া ফেরদৌস বলেন, এ উপজেলায় সরিষার চাষাবাদ ভালো হয়েছে। এবারও বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশ স্বাধীনের পর মির্জাপুর তেঘরপাড়া গ্রামে আমন ধান করার পর জমি পতিত থাকতো। এখন সেখানে আমনের পর সরিষার আবাদ হচ্ছে। পাশাপাশি বোরোর চাষাবাদও হচ্ছে।
তার মতে, সময় মতো কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া আর কৃষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে সেখানে নতুন ফসল হিসেবে সরিষা যুক্ত হয়েছে। ফসলও ভালো হয়েছে এবং আশানুরূপ ফলনও হবে।
নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, এবার সরিষা চাষাবাদের জন্য আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূলে রয়েছে। ফলে জেলার সর্বত্রই সরিষার আবাদ ভালো হয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে মাঠে মাঠে মনিটরিং করা হচ্ছে। কৃষকদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশে সরিষা চাষাবাদের জন্য সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং ক্রমাগতভাবে আবাদের পরিধি বাড়ছে, তাতে মানুষের ভোজ্য তেলের চাহিদা মিটবে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে তেলের আমদানি নির্ভরতা কমবে এবং স্বল্প ও সাশ্রয়ী মূল্যে মানুষ খুব সহজেই ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটাতে পারবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।