সোনার ধানে ভাটির জনপদে অন্যরকম আনন্দ
জুমবাংলা ডেস্ক : পুরো সিলেট অঞ্চলে গত বছর প্রলয়ংকরী বন্যা হয়েছিল। সেই বন্যায় তীব্র কষ্ট ও ভোগান্তি সহ্য করেছেন এ অঞ্চলের মানুষ। তবে এ বছরের বোরোর বাম্পার ফলনে ভাটির জনপদের মানুষ ভুলে গেছেন পেছনের দুঃখের কথা। তাদের মধ্যে প্রাণস্পন্দন ফিরে এসেছে। বৃহত্তর সিলেটের মাঠ থেকে প্রায় ২০ লাখ মেট্টিক টন চাল গোলায় ওঠার স্বপ্নে বিভোর এখন হাওরপাড়ের মানুষ।
সিলেটের বিভিন্ন স্থানে ব্রি-২৮ জাতের ফলনে ব্লাস্টার রোগ, ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে ১৭ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পরও এবার চলতি বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। হাওর পাড়ের মানুষ এখন উৎসবে মাতোয়ারা। এ বছর বৃষ্টিপাত হয়েছে পরিমিত। আবহাওয়া ছিল রৌদ্রকজ্জ্বোল। এই অনুকূল আবহাওয়ায় ফলন হয়েছে ভালো।
এদিকে কড়া রোদ ঠেকাতে মাথায় গামছা বেঁধে ধান কাটা-মাড়াই দিচ্ছেন কৃষক। বিভিন্ন স্থানে কিষানিরা হাওরপাড়েই নাড়ার আগুনে বড় বড় ডেগে কেটে আনা ধান সিদ্ধ দিচ্ছেন। আর সুর করে তারা গীত করছেন। সিলেটের সব কটি হাওরে যেন ‘শুধু ধান তোলার কাব্য’।
মাঠে কৃষকদের সঙ্গে জনপ্রতিনিধি ও ছাত্রলীগের কর্মীরা ধান কাটায় যোগ দেওয়ায় অন্যরকম এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। গতকাল শনিবার জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিখন আহমেদের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা সুনামগঞ্জের লালপুর গ্রামের কৃষক রহমত আলীর তিন বিঘা জমির বোরো ধান কেটে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন।
শাল্লা উপজেলা চেয়ারম্যান আল-আমিন চৌধুরী বলেন, ‘কৃষকদের আনন্দে ঘরে থাকা যায় না, উত্সাহ দিতে শুরু থেকেই মাঠে আছি তাদের সঙ্গে। এবারের বাম্পার ফলনে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।’
তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী শনির হাওরে কৃষকদের উত্সাহ দিতে খলায় ধান শুকাতে ব্যস্ত। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জের বোরো ধান সারা দেশের প্রাণ। সবাই খুশিতে ধান তুলছেন। কিন্তু বিশাল ‘মাঠিয়াইন’ ও ‘শনির’ হাওর থেকে সোনার ফসল ঘরে নিয়ে আসতে ‘জাঙ্গাল’ (জামির মধ্যখানে প্রশস্ত রাস্তা) নেই । তিনি বলেন, তাহিরপুরেই ৫২ হাজার মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপন্ন হয়। যার আর্থিক মূল্য ২০০ কোটি টাকা। হাওরের মধ্য দিয়ে কৃষির উন্নয়নের স্বার্থে সাবমর্জেবল রোড নির্মাণের দাবি জানান তিনি। এদিকে স্থানীয় প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, কৃষি কর্মকর্তারাও ধান ঘরে তুলতে কৃষকদের উত্সাহ দিয়ে চলছেন। মৌলভীবাজরের ‘কাউয়াদীঘি’ হাওরের ধান কেটে নিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং চলছে। অন্যদিকে হবিগঞ্জে শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটা ব্যাহত হচ্ছে।
গড়ে ৬৫ শতাংশ কর্তন শেষ :সিলেট কৃষি বিভাগ জানায়, সিলেটের চার জেলায় শুক্রবার পর্যন্ত গড়ে ৬৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে। সিলেটে ৭০ দশমিক ৩ শতাংশ, মৌলভীবাজারে ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ, হবিগঞ্জে ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ, সুনামগঞ্জে ৭৮ দশমিক ৪ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। সূত্রমতে, শুধু হাওরে ৮৮ শতাংশ ধান কাটা হলেও হাওর নয় এমন জমিতে ৩৫ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। হাওরের বাইরে ধান বপন দেরিতে হয়। তাই ধান পাকতে দেরি হয়। আগামী ১০-১২ দিনের মধ্যে হাওরে ধান কাটা শেষ হবে। হাওর ছাড়া অন্য জমির ধান কাটা শেষ হতে পুরো মে মাস লাগবে। এ বছর রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া থাকায় প্রত্যেকে খুশি মনে কাজ করছেন বলে জানান কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম।
১২ লাখ ৮৫ হাজার পরিবার বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল
সিলেটে বিভাগের ১২ লাখ ৮৫ হাজার পরিবার সরাসরি এই বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। এ বছর ৪ লাখ ৯০ হাজার ৫৭৭ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়। এতে উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয় ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮২১ মেট্রিক টন চাল। সবচেয়ে বেশি বোরো উৎপাদন হয় সুনামগঞ্জ জেলায়। এখানে এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৫৭৫ হেক্টর জমিতে বোরা চাষ হয়েছে। এতে আশা করা হচ্ছে এ জেলায় সাড়ে ১৩ লাখ টন চাল কৃষকের গোলায় উঠবে।
১২০০ হারভেস্টার মেশিন মাঠে
কর্মকর্তারা জানান, বৃহত্তর সিলেট বিভাগের কৃষকদের সঙ্গে অন্তত ১ হাজার ২০০ হারভেস্টার মেশিন নেমেছে ধান কাটতে। সরকারি ভর্তুকি মূল্যে মেশিনগুলো দিনরাত ধান কাটছে। কিষান-কিষানিরাও নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।
বোরো ফসলকে ঘিরে যত স্বপ্ন
বোরো ফসলকে ঘিরেই সিলেটের অর্থনীতি ও সমাজনীতি। সন্তানের লেখাপড়া, বিয়েসাদি—সবকিছু। সারা বছরের খোরকি বোরো ধান গোলায় না উঠলে সেই গোলা পূর্ণ হয় অভাব অনটন ও ঋণের বোঝায়। তবে এবার বাম্পার ফলনে হাওরের গল্প ভিন্ন।
ফসলে ব্লাস্ট রোগে হাহাকার
এবার সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বোরো ফসলের খেতে ব্লাস্টার রোগ দেখা দেয়। কৃষকরা বলেন, সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিস এই জাতের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার করেনি। কৃষি কর্মকর্তারা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তারা সতর্ক করেছেন। অনেকেই তা শুনেননি। তাছাড়া প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে অনেক স্থানে ব্রি-২৮ জাতে ধানের ফলন ভালো হয়নি।
ফরিয়াদের খপ্পরে কৃষক
সরকারিভাবে ধান কিনতে দেরি হওয়ায় ফরিয়াদের খপ্পরে পড়েছেন কৃষকরা। সব ধান চলে যাচ্ছে ফরিয়াদের গুদামে। ৯৫০ টাকা মণ দরে ফরিয়ারা খলা থেকে ধান কিনে নিচ্ছে। শাল্লা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছত্তার মিয়া জানালেন, হীরা ধান (মোঠা ধান) ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায় খলা থেকেই বিক্রয় হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার ধান কেনা শুরু করলে ধানের দাম বেড়ে যেত।
মধ্যনগরের আড়ত হয়ে ধান যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে
সুনামগঞ্জ জেলায় ধানের সবচেয়ে বড় আড়ত মধ্যনগরের এক আড়তদার বললেন, মধ্যনগরে প্রতিদিন ২৫-৩০ হাজার মণ ধান কিনছেন ৩৪ জন আড়তদার। এই ধান নৌপথে শানবাড়ী, জয়শ্রী, গাগলাজোড়, ইটনা-মিঠামইন হয়ে আশুগঞ্জ পৌঁছায়। মুন্সীগঞ্জ ও মদনগঞ্জে যাচ্ছে এখানের ধান। এখানকার ৭৫ শতাংশ ধান আশুগঞ্জে বিক্রি হয়।
সুনামগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মইনুল ইসলাম ভূঁইয়া জানান, সুনামগঞ্জসহ ১০ জেলায় আগামী ৭ মে ধান কেনা ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করবেন খাদ্যমন্ত্রী। ধান প্রতি কেজি ৩০ টাকা, চাল প্রতি কেজি ৪৪ টাকা দরে কেনা হবে। ধান কৃষকদের কাছ থেকে, চাল চুক্তিবদ্ধ মিলারদের কাছ থেকে কেনা হবে। কৃষকরো বলেন, ২৫ এপ্রিল থেকে ধান কেনা শুরুর কথা বলেছিলেন কৃষিমন্ত্রী। কিন্তু কী কারণে দেরি হচ্ছে তা তারা জানেন না। এখন কৃষকরা ফরিয়াদের কবলে ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।