জুমবাংলা ডেস্ক : রেলওয়ের ব্যয়বহুল তিন প্রকল্প থেকে ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ফেরত যাচ্ছে। প্রকল্পে এ সব টাকা ব্যবহার না হওয়ায় ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জনকণ্ঠের করা প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
প্রকল্প তিনটি হলো- পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ ও যমুনা সেতু নির্মাণ প্রকল্প। এর মধ্যে গত বছর নভেম্বরে শেষ হয়েছে কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণকাজ। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে বাকি দু’টি প্রকল্পের কাজ। এসব প্রকল্প থেকে প্রায় ৭ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত রয়েছে বলে রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান।
তবে বিবেচনা ছাড়া প্রকল্পে এই অতিরিক্ত ব্যয় নির্ধারণের কারণে প্রকল্প কর্মকর্তা ও পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও প্রতিটি সেক্টরে লাভের অংশ বণ্টনের কারণে প্রকল্পের ব্যয় অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে গেছে বলে জানান তারা। এ ছাড়া পদ্মারেল সংযোগ ও কক্সবাজারে ডাবল লাইন নির্মাণ না করার কারণে রেলযাত্রীরা প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে জানান গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘বর্তমান সরকার প্রকল্পের ব্যয় কমানোর জন্য যেভাবে তাগাদা দিচ্ছেন। আগের সরকার ছিল পুরো উল্টো। তখন প্রকল্পের খরচ কমানোর বিষয়ের কারও দায়বদ্ধতা ছিল না। বেশি খরচে বড় প্রকল্প নেওয়া হলে সবাই এখান থেকে নিজের লাভের আশা করত।
তিনি বলেণ, পরিকল্পনা কমিশন থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টরে লাভের অংশ বণ্টন করা হতো। এটা দাতাসংস্থা বুঝতে পারত। তাই প্রকল্পের খরচ কমানোর বিষয়ে কেউ উদ্যোগী হয়নি। ফলে আমাদের কর্মকর্তারা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। জবাবদিহিতা না থাকার কারণে প্রতিটি প্রকল্পে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে।’ তাই বিবেচনা ছাড়া প্রকল্পে এই অতিরিক্ত ব্যয় নির্ধারণের কারণে প্রকল্প কর্মকর্তা ও পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার পরামর্শ দেন তিনি।
দুই প্রকল্পে হয়নি ডাবল লাইন : রেলওয়ে সূত্র জানায়, ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পটি। এই প্রকল্পের একটি অংশ ঢাকা থেকে ভাঙা পর্যন্ত গত বছর ১ নভেম্বর চালু করা হয়েছে। বাকি অংশ ভাঙা থেকে যশোর পর্যন্ত আগামী নভেম্বরে চালু হবে বলে রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানান।
এ ছাড়া গত বছর নভেম্বরে কাজ শেষ হয়েছে দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তবে এত টাকা ব্যয় করে এই দুই রেলপথ নির্মিত হয়েছে সিঙ্গেল (একক) লাইনে। তাই প্রশাসনিক অদক্ষতা ও অক্ষমতায় কারণে এটা রয়েছে। কারণ পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্প ও কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের যে টাকা ব্যয় হয়েছে তা দিয়ে এই পথে ডাবল রেলপথ নির্মাণ করা যেত বলে জানান গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘আমাদের অক্ষমতা ও দুর্বলতার কারণে পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্পটি ডাবল লাইন নির্মাণ করা যায়নি। আমাদের আশপাশের দেশে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে যে খরচ হয় তা বিবেচনা করেই পরিকল্পনা নেওয়া হলে এই খরচেই পদ্মাসেতুসহ যশোর পর্যন্ত পুরো রেলপথটি ডাবল লাইন করা যেত। এটা না করায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ পুরো রেলসেবা থেকে বঞ্চিত হবে।
তিনি বলেন, একই অবস্থা কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রেও। সেখানে ঝিনুকের মতো দেখতে সুন্দর একটি রেল স্টেশনর নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু রেলপথটি ডাবল লাইন করা হয়নি। এছাড়া যাত্রীদের চাহিদা থাকার পরও পর্যাপ্ত ট্রেন দিতে পারছে না কক্সবাজার রুটে। তাহলে এত টাকা খরচ রেলপথ বানিয়ে কী লাভ হলো। শুধু রেলপথ নির্মাণ করেই শেষ। লাইন দিয়ে ট্রেন চালানোর জন্য পর্যাপ্ত কোচ ও ইঞ্জিন নেই রেলওয়ের।’ তাই অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে রেলযাত্রীরা প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তিন প্রকল্পে যেভাবে বেড়েছে ব্যয় : রেলওয়ে সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে রেলওয়ে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প হলো পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পটি। পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার সিঙ্গেল (একক) রেলপথ নির্মাণ করা হয় এই প্রকল্পে।
যা চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রকল্পের অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। পরিবর্তীতে ডিপিপি সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ানো হয়। সর্বশেষ প্রকল্প রিভিউর মাধ্যমে প্রায় ৬২১ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
রেলওয়ের দ্বিতীয় ব্যয়বহুল প্রকল্প হলো চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি। ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি গত বছর নভেম্বরে শেষ হয়। প্রকল্পটি ২০১০ সালের ১ জুলাই শুরু হয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ডিপিপি অনুমোদনের সময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়।
এ প্রকল্পের আওতায় দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার এবং রামু থেকে ঘুনধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার নতুন রেললাইন স্থাপন করার কথা ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে রামু থেকে ঘুনধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ কাজ বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যয় না কমিয়ে উল্টো বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সর্বশেষ রিভিউর মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৬ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানায়।
রেলওয়ের তৃতীয় ব্যয়বহুল প্রকল্প যমুনা রেল সেতু। যমুনা ইকোপার্কের পাশ দিয়ে বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সড়ক সেতুর পশ্চিম অংশে নির্মাণ করা হচ্ছে যমুনা রেলসেতুটি। প্রায় ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় ব্যয় ধরা হয় ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দেয় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। বাকি ৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।
প্রকল্পের ডিপিপি এক দফা সংশোধন ২০২০ সালের ৩ মার্চ একনেক সভায় অনুমোদন করা হয়। ইতিমধ্যে রেল সেতুটির ৯৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে সেতু নির্মাণকাজ শেষ হবে। এই প্রকল্প থেকেও ১০০ কোটি টাকা বেশি উদ্বৃত্ত থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানায়।
এ বিষয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক সরদার সাহদাত আলী বলেন, ‘ইতিমধ্যে পদ্মারেল সংযোগ প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হয়েছে। এ বছরের শেষ দিকে ভাঙ্গা-যশোর অংশে ট্রেন চলাচল শুরু করা যাবে। এ ছাড়া রেলওয়ের আরেকটি মেগা প্রকল্প যমুনা রেলসেতুর কাজও শেষ পর্যায়ে। এ বছরের মধ্যে যমুনা রেলসেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু করা যাবে।’ তবে প্রকল্প দু’টি উদ্বোধনের দিন তারিখ এখনো ঠিক হয়নি বলে জানান তিনি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।