জুমবাংলা ডেস্ক: ব্যাংকে টাকা নেই—এমন একটি প্রসঙ্গ আলোচনায় আসার পর গ্রাহকেরা আতঙ্কে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। তিনি বলেছেন, ‘ব্যাংকে টাকা নেই, এটা বলার পর সত্যিকারের একটা ইমপ্যাক্ট হয়েছিল। প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা মানুষ উইথড্র করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কিন্তু তাতে বাধা দেয়নি। এখন সবাই টের পেয়েছে, আরে! এটা তো ভুল করেছি। এখন সবাই টাকা ফেরত দিতে শুরু করেছে। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখেন। এখন কিন্তু সবাই আবার ফেরত দিচ্ছে।’ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তিন দিনব্যাপী বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে গতকাল আমন্ত্রিত অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রসঙ্গে ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘ভালো গ্রাহকদের ডেকে ডেকে ঋণ দেয় তারা। কয়েক মাস আগে আইএমএফের নিয়মিত একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছিল। তখন তারাই বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। যেহেতু ডলার নিয়ে একটা অস্থিরতা চলছে, তাই বাংলাদেশ আইএমএফের ঋণ নিতে রাজি হয়েছে।’
সরকারের বিনিয়োগ নিয়ে ওঠা সমালোচনা প্রসঙ্গে মুখ্য সচিব বলেন, ‘লার্জ স্কেল ইনভেস্টমেন্ট থেকে সরকার সরে এসেছে বলে একটি প্রসঙ্গ আলোচনায় এসেছে। কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। বাংলাদেশে লার্জ স্কেল ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেটি হচ্ছে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়োরিটি নির্ধারণ করা। সে অনুযায়ী কাজ করা, যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ দ্রুত শেষ হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা। লার্জ স্কেল ইনভেস্টমেন্ট থেকে বাংলাদেশ কখনো সরেনি, এখনো সরবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও নিয়ে সব সময় আমার ভিন্নমত আছে। একটা বিশাল বড় ইনসেনটিভ আমরা গার্মেন্ট শিল্পকে দিই, তা হলো ট্যাক্স ইনসেনটিভ। এটার জন্য যদি তারা গ্রো করতে পারে তাহলে কেন দেব না।’
‘ইকোনমিক পলিসি: অ্যাড্রেসিং পোস্ট কভিড চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। এছাড়া অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব তপন কান্তি ঘোষ, পরিকল্পনা সচিব মো. মামুন আল রশীদ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খান, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও মোস্তাফিজুর রহমান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান জায়েদী সাত্তার, ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দীন, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুস সাত্তার মন্ডল, অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ প্রমুখ।
ড. মসিউর রহমান বলেন, ‘আমার বাড়িতে যে মালির কাজ করে তার ১ টাকা এবং আমার ১ টাকা মূল্য একই। এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রেও যে-ই আয় বা খরচ করুক তার মূল্য একই। সেখানে একাধিক মূল্য নির্ধারণ করা কতটুকু যুক্তিসংগত?’ তিনি বলেন, ‘টাকা যদি ওভারভ্যালু হয়, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটা এক্সপোর্টের বিরুদ্ধে চলে যায়। যদি এক্সপোর্ট নেট গ্রোথ বা ট্রেড নেট গ্রোথের দিকে যায় তাহলে ওই দিকটায় আমাদের খেয়াল করতে হবে। এক্সচেঞ্জ রেট দুই মাস পরপর বদলানোও ঠিক হবে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইন্টারেস্ট রেটে একসময় অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল এবং ব্যাংকগুলো যখন সুপার প্রফিট করছিল সেটা বিজনেসের জন্য খারাপ ছিল। ফলে তখন একটা ইন্টারেস্ট রেট বেঁধে দেয়া হয়। এখন প্রশ্ন হলো শর্টটার্ম ইন্টারেস্ট রেট কীভাবে ঠিক করা হয়? তার মানে এটার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরো বেশি মানি ইনজেক্ট করছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশি মানি ইনজেক্ট করা মানে তারা মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতেও ফুয়েল দিচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘সাবসিডিকে যদি ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে দেখা হয়, তাহলে এটা ডিসরেসপেক্টফুল অ্যাটিটিউডদের দিকে চলে যায়। যে চাইল বা যার ব্যবসা ভালো হচ্ছে না তাকে দিয়ে দিলাম, এটা ঠিক না। সাবসিডিকে বিজনেস সাপোর্ট বললে ভালো হয়। অর্থাৎ সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে সেটা সঠিক জায়গায় যাচ্ছে কিনা বা সঠিক উদ্দেশ্য সম্পাদন করছে কিনা, সেটাও দেখতে হবে। অর্থনীতির বিচারে এটাও গুরুত্বপূর্ণ।’
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যদি আইএমএফের কিতাবি বই বা বিশ্বব্যাংকের কিতাবি প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করি তাহলে আমাদের জন্য কোনো গাইড পাব না। সেজন্য আমাদের সবাই মিলে আনঅর্থডক্স হিসেবে নিজেদের গাইডলাইন ঠিক করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যেসব কাঠামোর ওপর পৃথিবী গড়ে উঠেছিল—ফ্রি ট্রেড, গ্লোবাল ভিলেজ এগুলো সব বিপন্ন। তাই ট্রেড বেজড ইকোনমি এখন কতখানি চলবে তা আমি জানি না। সাবসিডি নিয়েও অনেক কথা হয়, এটা যখন যার লাগবে তার জন্য এটা গ্রহণযোগ্য।’
সালমান এফ রহমান বলেন, ‘কভিডের পর আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। এ সেতুর ফলে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হওয়ায় এটা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। কিন্তু এ সুবিধা নেয়ার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এতে সারা বিশ্বেই জ্বালানি ও শস্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে সারের দামও বেড়ে গিয়েছে। এর বেশ প্রভাব পড়েছে আমাদের ওপর। কারণ কৃষি আমাদের শক্তির জায়গা।’
তিনি বলেন, ‘ডলার এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে আমরা যা ইমপোর্ট কন্ট্রোল করতে শুরু করলাম। আমি একমত যে, লংটার্ম ইমপোর্ট কন্ট্রোল কোনো সলিউশন না। কিন্তু আমাদের হাতে সে সময় অন্য কোনো সুযোগ ছিল না। আমাদের ফরেন রিজার্ভ যে দ্রুত হারে কমছিল তা না করলে খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা তৈরি হতো। একই সময় আমরা আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংও মনিটর শুরু করলাম। তাতে ফলও পেয়েছি। কারণ জানুয়ারিতে আমাদের আমদানি ছিল ৯ বিলিয়ন ডলার কিন্তু গত মাসে করেছি মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলার।’
মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘কভিডের পর আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের কারণে এখন সংকট তৈরি হয়েছে। যেহেতু বৈশ্বিক বাজারে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে গিয়েছে, সে কারণে এফবিসিসিআই থেকে আমরা বলেছিলাম—জ্বালানিতে কীভাবে মাইক্রো ম্যানেজমেন্ট করতে পারি। কারণ উৎপাদন করলে আমাদের খরচ বেশি হয়, যেহেতু জ্বালানির দাম বেশি। তখন বলেছিলাম, এটাকে রেশনিং করা যায় কিনা। আসলে সেভাবে করা যায়নি লোডশেডিং ছাড়া। গ্যাস নিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে। যেহেতু গ্যাসের দাম বেড়েছে সে কারণে আমরা বেশি দাম দিয়ে হলেও গ্যাস নিতে চাই। কিন্তু সরবরাহটা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন করতে না পারলে ডলার সংকট আরো প্রকট হবে।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বড়। সুতরাং এটা ধরে রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান সময়ে অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তই চ্যালেঞ্জিং। ফিসক্যাল ও মনিটারি পলিসির মধ্যে কো-অর্ডিনেশন জরুরি। ফুয়েলের দাম বাড়ানো হয়েছে। চালের ক্ষেত্রে যেভাবে শুল্ক কমানো হয়েছে। ফুয়েলেও সে সুযোগ দেয়া দরকার। এগুলো রিভিজিট করতে হবে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের অর্থনীতির এখনো ৭০ শতাংশ ডমেস্টিক অর্থনীতি। এর ব্যত্যয় যেন না হয়। কারণ এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। ডমেস্টিক অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে ইন্টারেস্ট কমানোসহ যা যা করা দরকার ব্যবস্থা নিতে হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত জরুরি। তাছাড়া কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। কী লাভ হয়েছে? কত টাকা ফেরত এসেছে?’
ব্যবসায়ী নেতা আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, ‘কভিডের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরো বেশি সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তেল-গ্যাসের সরবরাহে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। ফলে সব দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। সেটি নিয়ন্ত্রণে তারা সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান কমে গিয়েছে। আমাদের এখন শিল্প, রেমিট্যান্স, ট্যাক্স সংগ্রহের দিকে নজর দিতে হবে। ডমেস্টিক এনার্জি, খাদ্যশস্য, রফতানি ও উদ্যোক্তাদের শ্রম—এগুলো বাংলাদেশের শক্তি। এসব ধরে রাখতে হবে।’ দেশের ব্যাংক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পাচ্ছে। কারণ ব্যাংক আয়করের সনদ চাচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংকে টাকা নেই। মানুষ বালিশের নিচে টাকা রাখছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।