জুমবাংলা ডেস্ক: বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রতিনিয়ত মানুষ অধিকার আদায়ের সবচেয়ে কার্যকর পথ হিসেবে রাজপথকেই বেছে নিয়েছে। নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াইটা রাজপথেই যে শুরু করতে হয়, শত শত বছর ধরে তা ইতিহাসের সাক্ষী। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক আগে আমেরিকার নিউ জার্সিতে পথে নামতে দেখা গিয়েছিল বেশ কিছু নারীকে, যারা বক্ষবন্ধনীর বাঁধন থেকে নিজেদের মুক্ত করে তা হাতে নিয়ে মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন। ছুঁড়ে দিয়েছিলেন শূন্যে। পরে সেই ব্রা তারা ফেলে দিয়েছিলেন ‘ফ্রিডম ট্র্যাশ ক্যানে’।
কার্যত মিথে পরিণত হয়ে যাওয়া সেই আন্দোলন জন্ম দিয়েছে কল্পকথারও। বলা হয়েছিল, সেদিন আন্দোলনরত নারীরা নাকি তাদের অন্তর্বাস পুড়িয়ে দিয়েছিলেন! কিন্তু সত্যিটা হল নারীবাদীরা সেদিন তাদের ব্রা পোড়াননি। তবে বাকিটা সত্যি। নিজেদের উপর হতে থাকা অবদমন ও পীড়নকে ছুঁড়ে ফেলে প্রকৃত স্বাধীনতার সন্ধানেই তারা একত্রিত হয়েছিলেন।
১৯৬৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। ইতিহাস মনে রেখেছে সেই দিনটির কথা। কেবল বক্ষবন্ধনী বা ব্রা নয়, হাই হিল জুতা থেকে লিপস্টিক কিংবা ঘর মোছার মপ- সবই সেদিন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন নারীবাদীরা। জনমানসে বিপুল প্রভাব ফেলে দিয়েছিল সেদিনের সেই আন্দোলন। কিন্তু কেন এমন এক আন্দোলন দানা বাঁধলো। কী তার প্রেক্ষাপট? এর পরিণতিই বা কী হয়েছিল? সেকথা বলার আগে একবার ছুঁয়ে দেখা যাক নারীবাদী আন্দোলনের সামগ্রিক রূপরেখাকে।
নারীবাদী আন্দোলন ও তিনটি ঢেউ
‘নারীবাদ’ শব্দটির জন্ম ১৮৩৭ সালে। ফরাসি দার্শনিক চার্লস ফুয়েরার এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’ নামের বিখ্যাত বইয়ের লেখিকা মেরি শেলির মা মেরি উলস্টোনক্রাফটকেই আধুনিক নারীবাদের সূচনাকারী হিসেবে ধরা হয়।
পাশ্চাত্যের আধুনিক নারীবাদী আন্দোলনকে ভাগ করা হয় মূলত তিনটি ঢেউয়ে। প্রথম ঢেউয়ের সময়কাল ঊনবিংশ শতক ও বিংশ শতকের প্রথম ভাগ। তৃতীয় ঢেউ বিংশ শতকের নয়ের দশক (১৯৯২ সাল নাগাদ)। দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথাই আমরা এই লেখায় বলতে চাইছি। সেই সময় নারীর সামাজিক সমতা লাভের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন নারীবাদীরা। যৌন স্বাধীনতা থেকে সম্পর্ক, আর্থিক বৈষম্য- এককথায় দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যে নানাবিধ সমস্যায় দীর্ণ হতে হয় মেয়েদের, সেই সব কিছুর বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ানোর সংকল্প করেছিলেন তারা। কারও কারও মত, সেটাই ছিল নারীবাদী আন্দোলনের আসল ঢেউ।
এই আন্দোলনকে এককথায় বলা হয় ‘বার্ন দ্য ব্রা’ আন্দোলন। সত্যি সত্যি ব্রা না পোড়ানো হলেও এমন নামকরণ থেকে সহজেই অনুমেয়, ব্রা অর্থাৎ বক্ষবন্ধনী এখানে একটি বন্ধনেরই প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে। ছয়ের দশকে কিংবদন্তি নারীবাদী জারমাইন গ্রির বলেছিলেন, ‘ব্রা একটি হাস্যকর উদ্ভাবন।’ এই কথাটিই যেন হয়ে উঠেছিল ১৯৬৮ সালের আন্দোলনের মূলমন্ত্র।
লিভিং রুম থেকে রাজপথে যেভাবে
আসলে প্রতিবাদটা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন মুলুকের নারীরা কারও লিভিং রুমে যখনই একত্রিত হতেন, উঠে আসত ‘মেয়েলি’ সমস্যার কথা। মাসিক বা সাপ্তাহিক সেই গসিপগুলোই কার্যত মুখে মুখেই এত বড় আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করে ফেলেছিল। যা বুঝিয়ে দেয়, ভেতরে ভেতরে বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা কতটা প্রবল হয়ে উঠেছিল সেদিনের মার্কিন নারীদের। ‘দ্য পার্সোনাল ইজ পলিটিক্যাল’ অর্থাৎ ‘ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক’ কথাটা হয়ে উঠেছিল একটা বার্তা। যা কিছু ব্যক্তিগত বলে গোপন রাখাই শ্রেয় বলে মনে করা হত, সেটাই সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইলেন অবদমিত নারীরা। আর তার ফলেই সেগুলো হয়ে উঠল সামাজিক। সেই সময় মার্কিন সমাজে অ্যাবরশন ছিল বেআইনি। পিল কিংবা আইইউডি ছিল নিরাপদ যৌনতার উপকরণ। কিন্তু তার ভারও ছিল মেয়েদের কাঁধেই। এভাবেই ক্রমান্বয়ে জমতে থাকা ক্ষোভের ফুলকি জমছিল। যা বিস্ফোরিত হল ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৮ সালে।
এই আন্দোলনের জন্য তারা বেছে নিলেন সেই বছরের ‘মিস আমেরিকা’ প্রতিযোগিতার। আমেরিকার দুই-তৃতীয়াংশ টিভিতে সেই সময় ওই অনুষ্ঠানই চলছিল। নারীবাদীরা দেখলেন এটাই সঠিক ইভেন্ট, তাদের প্রতিবাদ দেখানোর জন্য। আন্দোলনকারীদের অধিকাংশেরই বয়স কুড়ির ঘরে কিংবা তিরিশের একেবারে গোড়ায়। কিন্তু তাদের সঙ্গেই তাদের মা-দাদিরাও পা মিলিয়েছিলেন মিছিলে। ফ্লো কেনেডির মতো আইনজীবীও ছিলেন সেই আন্দোলনে।
‘মিস আমেরিকা’ বিতর্ক ও আন্দোলন
১৯২১ সালে শুরু হওয়া ‘মিস আমেরিকা’ প্রতিযোগিতায় কেবল শ্বেতাঙ্গ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারিণীদেরই সুযোগ দেওয়া হত প্রথম দিকে। পরে সেই ট্যাবু ভাঙলেও কিন্তু অশ্বেতাঙ্গ কাউকে শিরোপা জিততে দেখা যায়নি সেই সময় পর্যন্ত। আর তাই প্রতিযোগিতার যেখানে আয়োজন হয়েছিল, তারই বাইরে পথে একটি অতিকায় পুতুল সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন প্রায় চারশো নারীবাদী। সঙ্গে স্লোগান, ‘আমাদের এভাবে ব্যবহৃত হতে দেব না।’
এখানেই শেষ নয়। একটি ভেড়াকে ‘মিস আমেরিকা’ সাজিয়েও মিছিলে নিয়ে আসা হয়েছিল। নারীদের নিছক ‘মাংস’ তথা ‘সেক্স অবজেক্ট’ হিসেবে ব্যবহার করার প্রতিবাদ হিসেবেই ভেড়ার অবতারণা। দেখা গেল নারীরা তাদের ব্রা খুলে পোশাকের আড়াল থেকে বের করে এনে হাতে নিয়েই হাঁটছেন মিছিলে। তারপর একসময় সেগুলো তারা ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন ‘ফ্রিডম ট্র্যাশ ক্যানে’। আশপাশে ভিড় করা কৌতূহলী জনতাকেও আন্দোলনে শামিল হওয়ার ডাক দেওয়া হয়েছিল। আন্দোলন কভার করতে আসা কোনো পুরুষ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি আন্দোলনকারীরা। কেবল নারী সাংবাদিকদের সঙ্গেই কথা বলেছিলেন তারা। আসলে নারীবাদীরা চেয়েছিলেন, এই খবর প্রকাশিত হোক সাংবাদিকদেরই বাই লাইনে।
সেদিনের সেই আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল যে ঢেউয়ের, তা স্থায়ী হয়েছিল প্রায় দুই দশকের কাছাকাছি সময়ে। আটের দশকের শুরুতে নারীবাদীদের মতপার্থক্য হয় যৌনতাকে ঘিরে। এটি ‘ফেমিনিস্ট সেক্সওয়ার্স’ নামে পরিচিত। যৌনতা ও পর্নোগ্রাফি চর্চাকে ঘিরে এই মতপার্থক্যের সূচনা। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে ১৯৯২ সালে আন্দোলনের তৃতীয় ঢেউ। তবে সেটা অন্য আন্দোলন।
বহু পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু হয়, তা যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল তা মনে করিয়ে দিয়েছিল ১৯৬৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বরের কথা। কিন্তু পাঁচ দশক পেরিয়ে এসেও কি নারীবাদীদের সেদিনের দাবিগুলো পূরণ হয়েছে? বিখ্যাত নারীবাদী পেগি ডবিন্সের কথায়, ‘আমূলর পরিবর্তন ঘটিয়ে লিঙ্গ সাম্যের প্রতিষ্ঠা করা কখনও রাতারাতি হওয়া সম্ভবপর নয়। মাত্র তো পঞ্চাশ বছরই পেরিয়েছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।