সবকিছুই ভেতরে আটকে রাখে ব্ল্যাকহোল। এমনকি আলোও বেরিয়ে আসতে পারে না এর ঘটনা দিগন্ত পেরিয়ে। ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে এমন নানা কথা আমরা সবাই কম-বেশি শুনেছি। কথাটি সঠিক। আবার এটাও জানি যে আলোর কণা ফোটনের কোনো স্থির ভর বা রেস্ট ম্যাস নেই।
স্থির ভরশূন্য কোনো কিছু কীভাবে কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে হারিয়ে যায়? ব্ল্যাকহোল কি আসলেই আলো শুষে নেয়? নাকি অন্য কিছু ঘটে? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে আগে তিনটা জিনিস আরেকবার দেখে নিতে হবে। আলোর পরিচয়, মহাকর্ষ আর ব্ল্যাকহোল—বিষয়গুলো আসলে কী?
প্রথমে আলোর কথায় আসা যাক। সরল কথায় আলো একধরনের শক্তি। এই শক্তির অগণিত রূপ আছে। সব রূপ আমরা চর্মচোখে দেখতে পাই না। কিন্তু সেগুলো অন্যভাবে শনাক্ত করতে পারি। প্রয়োজনে ব্যবহারও করতে পারি। উদাহরণ হিসেবে অতিবেগুনি আলোকরশ্মির কথা বলা যেতে পারে। এ আলো আমরা দেখতে পাই না। কিন্ত সূর্য থেকে আসা এ আলোকরশ্মি আমাদের ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি করে। এ কারণে প্রখর রোদে মানুষ আলখেল্লা পরেন বা সানস্ক্রিন লোশন মাখেন গায়ে।
আগেই বলেছি, আলোর কোনো স্থির ভর নেই। তবে এর ভরবেগ আছে। এ কারণে গতিশীল অবস্থায় আলো এই মহাবিশ্বের সাধারণ আর সব কণার মতোই আচরণ করে, মেনে চলে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র।
আলো যে ধরনেরই হোক না কেন, অর্থাৎ তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা রূপ যা-ই হোক, তা পদার্থবিজ্ঞানের কিছু সূত্র মেনে চলে। চলতে বাধ্য হয়। এর একটা হলো, আলো চলাচলের জন্য সবসময় সবচেয়ে কম দূরত্বের পথটা অনুসরণ করে। দ্বিমাত্রিক সমতলের জন্য এই পথটা হলো সরলরেখা। সে জন্য ছোটবেলায় আমাদের পড়ানো হয়েছে, আলো সরল পথে চলে।
এবারে আমাদেরকে মহাকর্ষ বিষয়টির গভীরে উঁকি দিতে হবে আরেকবার। সে জন্য আরও একটি বিষয় জানতে হবে—স্থান-কাল।
মহাকর্ষের কারণেই পৃথিবী বাসযোগ্য। একই কারণে পৃথিবী ও তার সহোদরেরা ঘুরছে সূর্যের চারপাশে। কিন্তু মহাকর্ষ বিষয়টা আসলে কী? অনেক বিজ্ঞানীই কালে কালে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। পেয়েছেনও কিছু কিছু। তবে সবটা পাননি। মহাকর্ষ আজও আমাদের জন্য অন্যতম বড় রহস্য। তবে এ রহস্যের ব্যাপারে আমরা যতটা জানি, তার জন্য আপনি চোখ বুজে আলবার্ট আইনস্টাইনকে দায়ী করতে পারেন, কিংবা ধন্যবাদ জানাতে পারেন প্রাণখুলে।
১৯১৫ সালে এই জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করেন। বদলে যায় মহাকর্ষের ধারণা। তখন থেকে আমরা মহাকর্ষের ব্যাপারে খানিকটা বুঝতে শুরু করেছি। তাঁর হাত ধরে এ বিষয়ে আমাদের ধারণা অনেকখানি পরিষ্কার হয়েছে। আমরা জেনেছি, এই বল কীভাবে মহাবিশ্বকে প্রভাবিত করে।
আইনস্টাইন প্রথমবারের মতো স্থান-কালের ধারণা গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেন। বোঝার সুবিধার জন্য স্থান-কাল বিষয়টিকে চার কোণায় বাঁধা একটুকরো কাপড়ের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। কাপড়ের মতোই এটি বেঁকে যায়, প্রসারিত হয়। ভারী কোনো বস্তু এ কাপড়ের ওপর রাখলে সেটা দেবে যায় নিচের দিকে।
এবার মহাবিশ্বকে বিশাল এক স্থান-কালের চাদর হিসেবে ভাবুন। কাপড়ের ওপরে রাখুন সূর্যটাকে। দেখবেন, সূর্যের নিচে কাপড়টা একটু দেবে গেছে। এটাই মূলত মহাকর্ষ। ভরযুক্ত যেকোনো কিছু স্থান-কালের চাদরে এমন বক্রতা তৈরি করে। আর ভরের কারণে স্থান-কাল যখন বেঁকে যায়, তখন সরলরেখাও বেঁকে যায় কিছুটা।
এই ‘বক্র’ সরলরেখা বা ত্রিমাত্রিক স্থানের ন্যূনতম দূরত্ব বা সবচেয়ে ছোট পথটিকে বলা হয় জিওডেসিক। কাপড়ের ওপরে এবারে সূর্যের পাশে যদি কিছু রাখেন, দেখবেন এই ন্যূনতম বক্ররেখা ধরে বস্তুটা সূর্যের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। আর যদি কোনোভাবে সূর্যের ওপরে একটা খুঁটি গেড়ে, ওটায় সুতো দিয়ে বেঁধে সূর্যের চারপাশে বস্তুটাকে ঘুরিয়ে দেন, তাহলে দেখবেন কাপড়ের ওপরের বাঁকা সরলরেখা ধরেই বস্তুটি ঘুরছে।
বস্তু যত ভারী হয়, ততই বাড়ে এ বক্রতা। সর্বোচ্চ বক্রতা তৈরি হয় ব্ল্যাকহোলের বেলায়। কারণ এখনও পর্যন্ত আমাদের ত্রিমাত্রিক মহাবিশ্বের সবোর্চ্চ ভারী বস্তু এই ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। নিচের ছবিতে বিষয়টি দেখতে পাচ্ছেন।
অস্ট্রেলিয়ার সুইনবর্ন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিকস অ্যান্ড সুপারকম্পিউটিং বিভাগের পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো সারা ওয়েব। তাঁর মতে, ব্ল্যাকহোল হলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে চমকপ্রদ বস্তু। এটি স্থান-কালের মধ্যে আমাদের জানা সবচেয়ে ঘনবস্তু। এখান থেকে কিছুই পালাতে পারে না।
সাধারণত সূর্যের চেয়ে প্রায় দেড় থেকে তিনগুণ ভারী নক্ষত্র নিজের ভরের কারণেই কেন্দ্রের দিকে ভেঙে পড়ে জীবনের শেষকালে। ফলে তৈরি হয় ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই কৃষ্ণগহ্বরের সবটা ভর এর কেন্দ্রে একটি মাত্র বিন্দুতে জমে থাকে।
ধারে-কাছে আসা যেকোনো বস্তুকে খেয়ে ফেলার ব্যাপারে কৃষ্ণগহ্বরের (কু)খ্যাতি আছে। তবে, কথাটি কিঞ্চিৎ ভুল। আসলে কৃষ্ণগহ্বরের কাছে গেলেই যে সেটা আপনাকে টেনে নেবে, বিষয়টা তা নয়। বরং কৃষ্ণগহ্বরের কবলে পড়তে হলে আপনাকে এর চারপাশের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় যেতে হবে।
কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রের চারপাশের এই নির্দিষ্ট এলাকার নাম ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত। আলো বা অন্য যেকোনো বস্তুই কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তে ঢুকে পড়লে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে ধীরে ধীরে ছুটতে কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রের দিকে।
এতক্ষণে আলো, মহাকর্ষ ও কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল। এবারে আসল প্রশ্নের উত্তরে আসা যাক। ব্ল্যাকহোল কি আলো শুষে নেয়?
আলো কৃষ্ণগহ্বরের কাছাকাছি গেলে অন্য সব পরিস্থিতির মতোই এটিও সবচেয়ে কম দূরত্বের পথ অনুসরণ করতে চায়। অর্থাৎ ‘বক্র’ সরলপথে চলতে চায়। যত ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি যায়, স্থান-কালের বক্রতা তত বাড়তে থাকে। সঙ্গে বাড়তে থাকে আলোর চলার পথের বক্রতা।
আলো যখন ব্ল্যাকহোলের খুব কাছাকাছি চলে যায়, তখন বক্রতা এত বেশি হয় যে চলার পথ পুরো বৃত্তাকার হয়ে যায়। আলো আটকে পড়ে এক অসীম ফাঁদে। চিরকাল ঘুরতে থাকে সেই বৃত্তাকার পথ ধরে। কারণ, আগেই বলেছি, সব বস্তুর মতোই আলো পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে চলে। অনেকটা কুয়োর তলায় পড়ে ঘুরপাক খাওয়ার মতো বিষয়।
মজার বিষয় হলো, আলোর এ ঘটনা শুধু কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গেই ঘটে না। সারা ওয়েবের মতে, মহাকাশে যেকোনো বস্তুর ভর যথেষ্ট পরিমাণ হলে সেটার চারপাশেও আলো এরকম ঘুরপাক খায়। আমাদের সূর্যের চারপাশেও এ ঘটনা ঘটে। তবে এর ব্যাপ্তি খুব কম। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেই বিজ্ঞানীরা আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তত্ত্বের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। তবে বিষয়টা আরও ভালোভাবে বোঝা যায় গ্যালাক্সিপুঞ্জের ক্ষেত্রে।
গ্যালাক্সিপুঞ্জ যে অতিভারী এবং অনেকটা স্থানজুড়ে বিস্তৃত, তা বলা বাহুল্য। স্বাভাবিকভাবেই এ ক্ষেত্রেও আলোর চলার পথ বেঁকে যায়। তবে এ ক্ষেত্রে সব ভর এক বিন্দুতে জমা থাকে না। তাই আলো ফাঁদে আটকা পড়ে না। কিন্তু বক্রপথ অনুসরণ করার ফলে দারুণ একটা বিষয় ঘটে। গ্যালাক্সিপুঞ্জের একদম পেছনে থাকা বস্তুর আলো বক্র পথে চলে আসে পুঞ্জকে পাশ কাটিয়ে। ফলে আমরা পেছনের বস্তুগুলোকেও দেখতে পাই।
মহাকাশের এই ঘটনাকে বিজ্ঞানীরা বলেন মহাকর্ষীয় লেন্সিং। কদিন আগে জেমস ওয়েবের মাধ্যমে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে তোলা চমৎকার কিছু ছবি দেখেছি আমরা। বিজ্ঞানীরা এই মহাকর্ষীয় লেন্সিং ব্যবহার করে সমাধান করেছেন আরও অনেক রহস্য।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।