মহাবিশ্বের সবচেয়ে ঘন বস্তুর নাম ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। ঘনত্ব বেশি হওয়ায় এর চারপাশের স্থানকালের চাদর প্রচণ্ডভাবে বেঁকে যায়। ফলে এমন কিছু তৈরি হয়, যাকে অন্ধকার গর্তের সঙ্গে তুলনা করা চলে। এর আকর্ষণ বল এতই বেশি হয় যে, ঘটনা দিগন্তের ভিতরে কোনকিছু ঢুকে গেলে সেটা আর বেরিয়ে আসতে পারে না। মহাবিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল আলোও এর ব্যতিক্রম নয়।
ছোট বড় অসংখ্য ব্ল্যাকহোল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মহাকাশ জুড়ে। কিছু যেমন সূর্যের তুলনায় শত কোটি গুণ ভারী, তেমনি কিছু আছে সূর্যের চেয়ে মাত্র কয়েকগুণ ভারী। জ্যোতিঃবিজ্ঞানীরা মোটা দাগে ব্ল্যাকহোলকে ভাগ করে দুইভাগে। নক্ষত্রভর বা স্টেলার ম্যাস ব্ল্যাকহোল এবং অতিভারী বা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল।
সুপারম্যাভিস ব্ল্যাকহোল কীভাবে তৈরি হয়, তা এখনও জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক বিশাল রহস্য। সাধারণত বিভিন্ন গ্যালাক্সির কেন্দ্রে দানবীয় এসব ব্ল্যাকহোলের অবস্থান। একাধিক স্টেলার ম্যাস ব্ল্যাকহোল একত্রিত হয়ে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল তৈরি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু সে প্রমাণ এখনও মেলেনি।
অন্যদিকে স্টেলার ম্যাস ব্ল্যাকহোলের জন্মকাহিনি কিছুটা জানা আমাদের। নক্ষত্রের ভর অনেক বেশি হলে, জীবনীকালের শেষ পর্যায়ে সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে পরিণত হয় ব্ল্যাকহোলে। তবে, ঠিক কতটা ভর থাকলে একটি নক্ষত্র ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
নক্ষত্রের ঘূর্ণন, চারপাশের মহাকর্ষ ক্ষেত্র এরকম বেশকিছু বিষয় এর সাথে জড়িত। তবে চন্দ্রশেখর সীমা অনুযায়ী, কোন নক্ষত্রের ভর ১.৪ সৌরভর তার কম হলে, তা শ্বের বামন নক্ষত্রে পরিণত হবে। বেশি হলে পরিণত হবে তা নিউট্রন স্টার অথবা ব্ল্যাকহোলে। ভর তুলনামূলক কম হলে বিস্ফোরণের পর নক্ষত্র পরিণত হবে নিউট্রন স্টারে।
এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের শনাক্ত করা সবচেয়ে ছোট ব্ল্যাকহোলটির ভর, সূর্যের মাত্র তিনগুণ। দূরত্বের হিসেবে এটা আমাদের সবচেয়ে কাছের ব্ল্যাকহোল। বিজ্ঞানীরা একে ডাকছেন, ইউনিকর্ন নামে। পৃথিবী থেকে মাত্র দেড় হাজার আলোকবর্ষ দূরে মনোসেরোস তারামণ্ডলের ব্ল্যাকহোলটির অবস্থান। গ্রিক শব্দ মনোসেরোসের ইংরেজি অর্থ ইউনিকর্ন।
ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ ব্যবহার করে ব্ল্যাকহোলটি আবিষ্কার করেন যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী। এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল জার্নাল -এ প্রকাশিত হয় ২০২১ সালে।
ব্ল্যাকহোল খুঁজে পাওয়াও সহজ কাজ নয়। কারণ এখান থেকে অতিসামান্য দৃশ্যমান আলো নিঃসৃত বা প্রতিফলিত হয় না। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আশেপাশের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে ব্ল্যাকহোল আবিষ্কার করেন। পৃথিবী থেকে প্রায় দেড় হাজার আলোকবর্ষ দূরে জোড়ানক্ষত্র সিস্টেম ভি৭২৩ মন পর্যবেক্ষণ করার সময় দেখা যায় এর লোহিত দানব নক্ষত্রটি অদৃশ্য ভারী কোন বস্তুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেন, অদৃশ্য বস্তুটির ভর প্রায় তিন সৌরভরের সমান। এর প্রকৃতি ব্ল্যাকহোলের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। এত কম ভরের ব্ল্যাকহোলের মহাকাশে এর আগে দেখা না গেলেও কয়েক দশক আগে বিজ্ঞানীরা এর ধারণা পেয়েছিলেন।
১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে স্টিফেন হকিং ধারণা করেন, ব্ল্যাকহোলের ভর নক্ষত্রের ভরের চেয়েও কম হতে পারে। অন্তত তাত্ত্বিক গবেষণা সেটাই বলছিলো। এর কারণ, হকিং রেডিয়েশন। ব্ল্যাকহোল এই বিকিরণ নির্গত করতে করতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে।
হকিং রেডিয়েশন নির্গত এবং ব্ল্যাকহোল নিঃশেষ হওয়ার হার নির্ভর করে ব্ল্যাকহোলের পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফলের উপর। সম্পর্কটা ব্যস্তানুপাতিক। ব্ল্যাকহোল যত বড় হবে, রেডিয়েশন নির্গত করে নিঃশেষ হবে তত ধীর গতিতে। স্টিফেন হকিংয়ের মতে, বিগব্যাংয়ের ঠিক পরপরই যদি কিছু নাক্ষত্রিক ভরের ব্ল্যাকহোল তৈরি হয়, তাহলে বর্তমানে সেগুলো খুবই ছোট ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। এদেরকে বলা হয়, মাইক্রো ব্ল্যাকহোল। মাইক্রো ব্ল্যাকহোলের ভর সূর্যের ভরের চেয়েও কম হতে পারে।
ব্ল্যাকহোল হওয়ার প্রধান শর্ত হচ্ছে, বস্তুর ঘনত্ব প্রায় অসীম হতে হবে। বস্তুর আকার বা ভর এখানে মূল শর্ত নয়। তাত্ত্বিকভাবে তাই যেকোনো কিছুকেই ব্ল্যাকহোলে পরিণত করা সম্ভব। শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ হিসেব করে দেখা যায়, পৃথিবীকে ব্ল্যাকহোলে পরিণত করা হলে তার ব্যাসার্ধ দাঁড়ায় এক ইঞ্চিরও কম।
অর্থাৎ আকারটা হবে একটা পিংপং বলের চেয়েও ছোট। প্রচণ্ড চাপে বস্তুর ভরকে সংকুচিত করে ঘনত্ব অসীম করে ফেলতে পারলে পৃথিবী বা অন্য যেকোন বস্তু ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। তবে এজন্য যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হবে তার যোগান দেওয়া বাস্তবে আমাদের পক্ষে আপাতত অসম্ভব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।