জুমবাংলা ডেস্ক : একসময় চলতে হতো কুঁজো হয়ে। দীর্ঘদিন স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারেননি। এর মধ্যেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। লিখিত পরীক্ষায় ভালো করেও অনেক চাকরির ভাইভা বোর্ড থেকে চোখের জল মুছতে মুছতে বেরোতে হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের হিসাব সহকারী পদে সারা দেশে প্রথম হলেন দাউদ নবী। জীবনযুদ্ধের গল্প শোনালেন দেশের জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকার প্রতিবেদক পিন্টু রঞ্জন অর্ককে।
খুব ডানপিটে ছিলাম। এ জন্য মায়ের কাছে নালিশও কম আসেনি। তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন মাঠে খেলছিলাম।
হঠাৎ পা ফেলতে সমস্যা হচ্ছিল। রাতে বাঁ পায়ের হাঁটু ফুলতে থাকল। অসহ্য ব্যথা। তখন থেকে শয্যাশায়ী। এভাবে কাটল প্রায় তিন মাস। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সেরে উঠলাম।
সমস্যাটা ধরা পড়ল
তিন মাস স্কুলে যেতে পারিনি। তবু এসএসসি দিলাম। এর পরপরই ২০০৮ সালের মে মাসে আবারও হাঁটু ফুলতে লাগল। আবার শয্যাশায়ী। বিছানায় শুয়েই খবর পেলাম এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছি। সেদিন খুব কেঁদেছিলাম। তিন মাস গেলেও হোমিও ওষুধে আর কাজ হচ্ছিল না। রিপোর্ট দেখে একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, আমার বাতজ্বর হয়েছে। তাঁর পরামর্শে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাতজ্বরের ওষুধ সেবন করি। এইচএসসির ঠিক আগে আগে আবারও অসুস্থ হলাম। অবস্থা আগের থেকে খারাপ হলো। তবু দৈনিক দুটি ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে কোনো রকমে পরীক্ষা দিলাম। পরে ঢাকায় ডাক্তার এ বি এম আবদুল্লাহর শরণাপন্ন হলাম। তিনি জানালেন, মূলত পুষ্টির অভাবে রোগটা এত দূর এসেছে। প্রতিদিন কমপক্ষে এক লিটার দুধ ও তিনটি ডিম খেতে হবে।
কিন্তু তখন অবস্থা এমন যে এসব খাবারের কথা কল্পনাও করতে পারিনি। বাবা ছিলেন মাটি কাটা শ্রমিক। আমার পাঁচ বছর বয়সেই এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন তিনি। ভাইয়েরা সবাই দিনমজুর। বড় আপার স্বামী মারা গেছেন। আপার তিন সন্তান ও মাকে নিয়ে আমার পরিবার। চলে আমার স্কলারশিপের টাকায়।
হাসপাতালে ভর্তি হলাম
আবদুল্লাহ স্যারের পরামর্শে পিজি হাসপাতালে ভর্তি হলাম। হাসপাতালের বেডে শুয়েই সেবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলাম। জিপিএ ৩.৬০ পেলাম। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়ে আমি আঙ্কাই লজিং স্পন্ডোলাইটিসে ভুগছি। ডাক্তারদের কথা শুনে বুঝলাম, অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভুল ট্রিটমেন্টের কারণে মেরুদণ্ডের প্রতিটি জয়েন্টের মাঝখানের লালাজাতীয় পদার্থ শুকিয়ে গেছে। ফলে ডিস্কগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে জোড়া লেগে যেতে থাকে। ডাক্তারদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেবার বেশ ভালো বোধ করলাম। হাসপাতাল থেকে সপ্তাহ তিনেক পরে গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ফিরলাম। ২০১১ সালে এইচএসসিতে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিয়ে ৪.৪০ পেলাম।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে
একই বছর ভর্তি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সি’ ইউনিটে মেধাতালিকায় ১২৪তম এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩তম হলাম। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্সে ভর্তি হলাম। আনন্দময় ছিল ক্যাম্পাসজীবনের শুরুটা। কিন্তু পোড়া কপাল। সুখ সইল না। ২০১৩ সাল থেকে আবারও অসুস্থ হলাম। এবার ধীরে ধীরে কুঁজো হতে থাকি। মনে হলো, এ দুনিয়ায় আমার মতো অসহায় আর কেউ নেই।
ছয় বছর স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারিনি
ডাক্তার বলেছিলেন, টানা ৩০ মিনিটের বেশি পড়ার টেবিলে বসে থাকা নিষেধ। তাই পড়ালেখা করা কঠিন হয়ে পড়ল। কিন্তু মূল সমস্যা দেখা দিল ঘুমানোর সময়। মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারতাম না। চিৎ হয়ে শুতে গেলে জান বেরিয়ে যেত! হাঁটু ভাঁজ করে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতাম। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটি রাতও সোজা হয়ে ঘুমাতে পারিনি! বেশির ভাগ সময় বসে বসে ঘুমিয়েছি। তাও ব্যথায় হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেত। মানুষ ওপরওয়ালার কাছে কত কিছুই চায়। আমি শুধু প্রার্থনা করতাম, যেন ঠিকমতো এক রাত ঘুমাতে পারি! এটা ছিল জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। একদিকে পারিবারে আর্থিক অনটন, অন্যদিকে শারীরিক অক্ষমতা—এ দুই নিয়ে চলতে থাকে আমার জীবন। এমন অনেক রাত গেছে কিছুক্ষণ সোফায়, কিছুক্ষণ চেয়ারে আর কিছুক্ষণ খাটে একদিকে শুয়ে কাটিয়েছি; কিন্তু ঘুমাতে পারিনি। প্রায়ই ক্লাসে বসে বসে ঝিমাতাম। একটি রাতের কথা না বললেই নয়। পরদিন অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার শেষ দিন। কিন্তু ব্যথার জন্য টেবিলে বসে লিখতে পারছিলাম না। রাতভর অন্য এক বন্ধুর সহযোগিতায় অনেক কষ্টে কিছুক্ষণ টেবিলে বসে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, যেভাবে পেরেছি অ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করেছি। আমি ২৩ বছরের তরুণ। কিন্তু কুঁজো হয়ে চলতাম বলে যে কেউ দেখলে হয়তো ভাবত—এই বুঝি বৃদ্ধ হেঁটে যাচ্ছে। যাহোক, ২০১৮ সালে সিজিপিএ ৪-এর মধ্যে ৩.৭০ পেয়ে বিবিএ এবং ২০১৯ সালে ৩.৫২ পেয়ে এমবিএ শেষ করলাম।
আহা! কত দিন পর ঘুমালাম
এর মধ্যে স্যারদের সহযোগিতায় ভারতে গেলাম। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেরুদণ্ডের অপারেশন হলো, যা ছিল আমার কাছে পুনর্জন্মের মতো। এই অপারেশনের পরই জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুমাতে পারছি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কামাল উদ্দিন, পিবিআই ইন্সপেক্টর ওমর ফারুক, শাখাওয়াত ভাইসহ এত এত মানুষের সহযোগিতা ও ভালোবাসা পেয়েছি, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা নেই। এর মধ্যে পে ইট ফরওয়ার্ড বাংলাদেশ এবং এসইএল চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশন অন্যতম।
তুমি কোনো চাকরিরই যোগ্য নও
চাকরির লড়াইয়ে প্রথম পরীক্ষা ছিল বেসরকারি কম্পানিতে। লিখিত পরীক্ষায় প্রথম ১০ জনের মধ্যে আমার অবস্থান। খুব খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে জীবনে প্রথম চাকরির পরীক্ষায় সফল হতে যাচ্ছি, কিন্তু বিধিবাম। ভাইভা বোর্ডে প্রবেশ করলে আমাকে দেখে বোর্ডের চেয়ারম্যান বললেন, ‘তুমি তো অসুস্থ। এখানে কাজ করতে পারবে না। আসলে তুমি কোনো চাকরিরই উপযুক্ত নও। তোমাকে আবেদন করতে কে বলেছে?’ এই বলে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বের করে দিলেন! চোখের জল মুছতে মুছতে ভাইভা বোর্ড থেকে বের হলাম।
এর পর থেকে আরো বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি। সবগুলোতেই মেধাতালিকায় প্রথম দিকে ছিলাম। অনেক আশায় বুক বাঁধি। কিন্তু পরে ই-মেইলে জানতে পারি, আমি বাদ!
সারা দেশে প্রথম হলাম
লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করার পরও চাকরি না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ি। এরই মধ্যে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, গ্যাস কম্পানিসহ বেশ কয়েকটি সরকারি চাকরির ভাইভা দিলাম। সর্বশেষ বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের হিসাব সহকারী পদে সারা দেশে মেধাতালিকায় প্রথম হলাম। গত ৪ তারিখে সেখানেই শুরু হলো আমার পেশাগত জীবন। ৪৩তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা দিয়েছি। আরো বেশ কয়েকটি সরকারি চাকরির পরীক্ষায় ফলের অপেক্ষায় আছি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।