চীনের তিয়ানজিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ঘন্টাখানেক বৈঠক হয়েছে। বৈঠক সংক্রান্ত একটি ভিডিও সমাজ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
মোদি বলেন, গত বছর কাজানে ভারত এবং চীনের মধ্যে খুবই সদর্থক আলোচনা হয়েছিল, যা আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ইতিবাচক দিকে চালিত করেছে। সীমান্তে সেনা প্রত্যাহারের পরে শান্তি এবং স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে আসে মানস সরোবর যাত্রা থেকে চীনের সঙ্গে সরাসরি বিমান পরিষেবা চালুর প্রসঙ্গও। গালওয়ানে ভারত ও চীনের সীমান্ত সংঘাতের পরে এটি প্রথম শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক। আলোচনায় অংশ নেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। সংঘাতের পর্ব পেরিয়ে এই বৈঠকে মৈত্রীর সুর স্পষ্ট শোনা গিয়েছে।
চীনের প্রতি বার্তা দিয়ে মোদি বলেন, আমাদের সংহতির ওপরে ভারত এবং চীনের ২০৮ কোটি মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। এতে সারা পৃথিবীর মঙ্গল হবে। পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্মান এবং সংবেদনশীলতার ভিত্তিতে আমরা এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
চলতি পরিস্থিতিতে ভারত ও চীনের মধ্যে সুসম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন চীনা প্রেসিডেন্ট। তিনি সৌহার্দ্যের বার্তা দিয়ে বলেন, এসসিও সম্মেলনের জন্য চীনে আপনাকে (মোদি) স্বাগত জানাই। গত বছর কাজানে আমাদের বৈঠক সফল হয়েছিল। বিশ্ব একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে। চীন এবং ভারত সভ্য দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, বিশ্বের দুটি সবচেয়ে জনবহুল দেশ। আমাদের বন্ধুত্ব, প্রতিবেশী হিসাবে একে অপরের পাশে থাকা জরুরি। ড্রাগন এবং হাতির একজোট হওয়া প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
এসসিও বৈঠকে অংশ নেবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনও। ভারত ও চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার উপস্থিতিটাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত যেখানে রাশিয়ার থেকে তেল আমদানি করার কারণে ভারতের ওপরে শুল্ক চেপেছে। এর ফলে এশিয়া মহাদেশে কূটনৈতিক সমীকরণে কিছুটা বদল আসার সম্ভাবনা।
দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক মইদুল ইসলাম বলেন, প্রতিবেশীকে আপনি পরিবর্তন করতে পারবেন না। ফলে তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা দুটি দেশের জন্যই ভালো। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে ট্রাম্প যেভাবে ভারত ও চীনের ওপরে শুল্কের বোঝা চাপিয়েছেন, এতে পরিস্থিতির বদল হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প যে মধ্যস্থতার দাবি করেছেন এবং পরবর্তীকালে ভারতের ওপরে যেভাবে শুল্কের বোঝা চাপিয়েছেন, তাতে নয়াদিল্লি নিজেদের বঞ্চিত মনে করেছে। আলোচনার পরেও ভারতের ওপরে চড়া হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ততটা চাপ তৈরি করা হয়নি। চীনের ক্ষেত্রে আরও চড়া হারে শুল্ক আরোপ করার সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত ও চীনের কাছাকাছি আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি ব্লুমবার্গের একটি রিপোর্ট দাবি করছে, এই বছরের গোড়ায় ডনাল্ড ট্রাম্প যখন চীনের বিরুদ্ধে শুল্ক যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, তখন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে একটি ব্যক্তিগত চিঠি লিখেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট। বেজিংয়ের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ আগেই নেওয়া হয়েছে।
সিনিয়র সাংবাদিক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী বলেন, এখন যে ঘটনাপ্রবাহ চলছে, মৈত্রীর উদ্যোগ খুব স্বাভাবিক। শত্রুর শত্রু আমার মিত্র। চীনের সঙ্গে ভারতের মাঝখানে প্রবল দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। চীন পাকিস্তানের হয়ে কাজ করছিল। সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে তারা বিবৃতি দিয়েছে। এখন চীন বিষয়টা বুঝতে পেরেছে, তাই আমাদের প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি প্রসঙ্গে চলতি পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ট্রাম্প নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনছেন। যেটা তিনি করে চলেছেন, তার ফলে আমেরিকা ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে বাকি বিশ্ব থেকে। এতে সে দেশের অর্থনীতি ধাক্কা খাবে। ভারত থেকে অনেক বেশি পরিমাণ তেল চীন কিনছে রাশিয়ার কাছ থেকে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ওপরে ট্রাম্প শুল্কের বোঝা চাপাচ্ছেন না। তিনি টার্গেট করছেন ভারতকে। তিনি বন্ধুত্ব করেছেন পাকিস্তানের সঙ্গে। ফলে তার একটি অশুভ অ্যাজেন্ডা রয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। সে কারণেই ভারত নিজের পথ খুঁজছে।
আমেরিকার অভিযোগ, রাশিয়ার থেকে তেল কেনার জন্যই ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছে তারা। তাদের অভিযোগ, রাশিয়া যে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তার নেপথ্য কারণ ভারত। অন্যদিকে আমেরিকা চীনের ওপর ৩১ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছে। এবার চীন যদি বিরল আর্থ ম্যাগনেট রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে সেই শুল্কের চাপ অনেক বাড়বে। ট্রাম্প তখন ২০০ শতাংশ আমদানি শুল্ক চাপানোর দিকে হাঁটতে পারেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, ট্রাম্পের যুক্তিতে গলদ দেখা যাচ্ছে। ভারতকে উনি নিশানা করছেন। কিন্তু রাশিয়ার প্রতি আমেরিকা ততটা বিরূপ নয়। ট্রাম্প এমন একটা খেলায় মেতেছেন, যেটা আগামী দিনে ভারতের পক্ষে ভয়ংকর হতে পারে। ভারত ও চীনের মধ্যে ব্যবসা যদি বাড়ে, তাহলে আমেরিকার ওপরে নির্ভরতা কমতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে।
বাকৃবি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ, শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ
ব্রিকস সংগঠনের প্রসঙ্গ টেনে রাজাগোপাল বলেন, অতীতে ব্রিকস মুদ্রার কথা ভাবা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই ভাবনা থেকে ব্রিকস গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলো সরে আসে। সেই সময় আমেরিকার চাপ ছিল। তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, যারা ব্রিকস মুদ্রা ব্যবহার করবে তাদের সঙ্গে আমেরিকা সম্পর্ক রাখবে না। বিশ্বের ৬৫ শতাংশ ব্যবসায় লেনদেন মার্কিন ডলারের মাধ্যমে হয়। তাদের বাণিজ্যে বিপুল ঘাটতি থাকলেও ডলার ছাপানোর সুযোগ থাকায় তারা যা খুশি করছে। ভারত, চীন, রাশিয়া যদি ডলারের ওপরে নির্ভরতা কমাতে পারে, একটি অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তাহলে আমেরিকার ওপরে চাপ তৈরি করা যাবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।