আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতে করোনা সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভে যখন রোজ নতুন রেকর্ড ভাঙছে- তখন সারা দেশ জুড়ে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় দুটি জিনিসের জন্য হাহাকার চরমে পৌঁছেছে। খবর বিবিসি বাংলার।
আর এই দুটো জিনিস হল, রেমডেসিভির ড্রাগ আর মেডিক্যাল অক্সিজেন।
রেমডেসিভির জোগাড় করার জন্য রোগীর পরিজনরা হন্যে হয়ে ঘুরছেন, সরকার এই ওষুধটির দাম বেঁধে দিয়েও চাহিদা কুলিয়ে উঠতে পারছে না।
অন্যদিকে কোভিড রোগীদের জন্য অক্সিজেনের জোগান নিয়ে রাজনীতি, আইন আদালত কিছুই বাদ যাচ্ছে না- হাসপাতালগুলো অক্সিজেন পেতে হিমশিম খাচ্ছে, বহু কোভিড রোগী শুধুই অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছে।
বস্তুত কোভিড রোগীর পরিজনরা একটা প্রেসক্রিপশন নিয়ে রেমডেসিভির জোগাড় করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন কিংবা অক্মিজেন সিলিন্ডার পেতে জুতোর শুখতলা ক্ষইয়ে ফেলেও রোগীকে বাঁচাতে পারছেন না। এই মর্মান্তিক দৃশ্যগুলোই এখন ভারতে সেকেন্ড ওয়েভের ‘ডিফাইনিং ইমেজ’ বা নির্ণায়ক ছবি হয়ে উঠেছে।
মুম্বাইতে একাধিক কোভিড হাসপাতালের পরিচালক আফজল শেখ স্বীকার করছেন, এই ওষুধটির তীব্র আকাল আছে- সহজে মিলছেই না। বড় হাসপাতালগুলো কোনওক্রমে পেলেও ছোট হাসপাতালে রেমডেসিভির নেই, সেখানে ভর্তি রোগীর আত্মীয়স্বজনরা রাস্তায় দিশেহারা হয়ে ঘুরছেন।
রেমডেসিভির চড়া দামে কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে, এই খবর বেরোনোর পর কেন্দ্রীয় সরকার এর দাম বেঁধে দিয়েছে ঠিকই- কিন্তু তাতে জোগান বাড়েনি।
ওষুধটি যাতে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা যায়, তার জন্য ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন কেন্দ্রের অনুমতি চেয়ে চিঠিও লিখেছেন।
কলকাতার সুপরিচিত চিকিৎসক দ্বৈপায়ন ঘটক বলছিলেন, এই ওষুধটি কতটা কার্যকরী তা একশোভাগ নিশ্চিত না হলেও রোগীরাই কিন্তু এটি প্রেসক্রাইব করার জন্য ডাক্তারদের জোরাজুরি করছেন।
ডা: ঘটক বলছিলেন, এটি একটি অ্যান্টি-ভাইরাল ড্রাগ। ফার্স্ট ওয়েভে যে রোগীদের ওপর এটি প্রয়োগ করা হয়েছিল দেখা গেছে অনেক ক্ষেত্রে তাদের রোগের সিভিয়ারিটি বা তীব্রতা কম ছিল।
তিনি বলেন, তবে এটাকে বড়জোর বলা যেতে পারে একটা ক্লিনিক্যাল ওপিনিয়ন। কেস কন্ট্রোল স্টাডি ছাড়া নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় রেমডিসিভির আদৌ কোভিড রোগীদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে কি না!
ভারতে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের নির্দেশিকাও বলছে, রোগীরা কোভিড আক্রান্ত হওয়ার তিন থেকে পাঁচদিনের মধ্যে রেমডেসিভির দিলে হয়তো রোগীর অবস্থার উন্নতি হতে পারে।
কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার সাতদিন বা দশদিন পরেও রোগীদের রেমডেসিভির দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের ওপর চাপ আসছে, অনেক ক্ষেত্রে তারা লিখছেনও। ফলে এই ওষুধ বা ইনজেকশনটির চাহিদাও হু হু করে বাড়ছে।
এই বহুল আলোচিত ওষুধটি ছাড়াও আর একটি পরিচিত ও সাধারণ চিকিৎসা সরঞ্জাম এখন চাহিদার তুঙ্গে- সেটি হল অক্সিজেন।
গুজরাটে সুরাট সিভিল হাসপাতালের ড: পারুল ভাডগামা বলছিলেন, গত বছরের তুলনায় এবার কোভিড রোগীদের অক্সিজেনের চাহিদা অন্তত পাঁচগুণ বেশি। ওপিডি-তে যে রোগীরা আসছেন তাদের নব্বই শতাংশই আসছেন স্ট্রেচারে করে। আর তাদের সবারই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে।
মুম্বাইয়ের একটি কোভিড হাসপাতালের প্রধান নার্স জানান, আমাদের ২৫ বেডের ওয়ার্ডে ৩৩জন ভর্তি আছেন, আর তাদের সবারই অক্সিজেন লাগছে। সিলিন্ডার জোগাড় করতে আমাদের কর্মীরা, ওয়ার্ড বয়রা বহু দূর দূর যাচ্ছেন। এদিকে প্রতি ঘন্টায় চারটে করে সিলিন্ডার শেষ হয়ে যাচ্ছে!
অক্সিজেনের সঙ্কট সরকারকেও বিপদে ফেলেছে। এরই মধ্যে রোগীদের পরিমিত পরিমাণে অক্সিজেন দেওয়ার কথা বলে বিতর্ক বাড়িয়েছেন ক্যাবিনেট মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল।
তার বক্তব্য ছিল, বহু জায়গায় অক্সিজেনের অপচয় হচ্ছে এবং দরকার না থাকা সত্ত্বেও রোগীদের অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে বলে আমরা খবর পাচ্ছি।
এদিকে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে গত রাতে রিলায়েন্স গোষ্ঠীর পাঠানো ৬০ টন অক্সিজেনের ট্রাক দু ঘন্টা ধরে আটকে রেখে বিজেপি নেতারা পুজোআচ্চা করিয়েছেন, মিডিয়াকে ডেকে ছবিও তুলিয়েছেন।
সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়ার পর ওই রাজনৈতিক নেতারা যথারীতি বিতর্কের মুখে পড়েছেন।
ওদিকে মুম্বাই শহরতলির দর্জি রামবাবুর মেয়ে ললিতা বলছেন, নার্সিং হোমে অক্সিজেন সিলিন্ডার খুলে নেওয়াতেই তার বাবার মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার (১৯ এপ্রিল) একই ধরনের অভিযোগ এসেছে মধ্যপ্রদেশের শাহডোল থেকেও, যেখানে ভোররাতে দশজন কোভিড রোগী একসঙ্গে অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন বলে বলা হচ্ছে।
দিল্লির একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক নিদা আহমেদ তার চাচার জন্য অক্সিজেন-ওলা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড়ই করতে পারেননি।
নিদা বলেন, অক্সিজেন নেই বলে একের পর এক হাসপাতাল আমাদের গেট থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছে, চাচা চোখের সামনে এক রকম বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন।
এরই মধ্যে দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষজন অক্সিজেন মজুত করার চেষ্টা করে সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলছেন, বলছিলেন দ্বৈপায়ন ঘটক।
তার কথায়, লোকে এখন বাড়িতেও অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত করছে। হোর্ডিং করছে। যদি পরে লাগে, এই ভেবে যার সুযোগ আছে সেই দুটো সিলিন্ডার বাড়িতে এনে রেখে দিচ্ছে।
তিনি বলেন, অনেকে আবার বাড়িতে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর কিনেও রেখে দিচ্ছে। আরে বাবা, অক্সিজেনের উৎপাদন তো অফুরন্ত নয়- তার ওপর এভাবে প্যানিক হোর্ডিং করলে আকাল তো হবেই।
দ্বৈপায়ন ঘটক বলেন, আর একটা জিনিস সাধারণ লোককে বোঝাতে পারছি না, একজন কোভিড রোগীর মিনিটে কুড়ি লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন লাগতে পারে। সেখানে একটা সিলিন্ডারে মাত্র বারোশো লিটার অক্সিজেন থাকে। তো তা দিয়ে কতক্ষণ চালানো যাবে যে মানুষ সিলিন্ডার কিনে রাখছে?
ফলে দ্বিতীয় ধাক্কার কোভিড ‘সুনামি’কে ভারতে এভাবেই আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে রেমডেসিভির আর অক্সিজেনের তীব্র আকাল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।