আন্তর্জাতিক ডেস্ক : একমাসের বেশি সময় ধরে ভারত জুড়ে পুরুষ ও নারীরা, তরুণ ও বৃদ্ধরা, সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন, যাকে তারা বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন।
সেখানে তারা সংবিধানের স্তুতি করছেন, যেখানে রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান হিসাবে ন্যায়বিচার, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের কথা বলা হয়েছে।
সংবিধানের এই ব্যাপক পঠনে একটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে। তা হলো, সাধারণ মানুষ সংবিধান নিয়ে যতটা ভাবে বলে মনে করা হয়, তার চেয়ে তারা এ বিষয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ।
বেশিরভাগ মানুষ করেন যে, সাধারণ শ্রেণীকক্ষের বাইরে মানুষজন সংবিধান নিয়ে খুব একটা ভাবে না।
চার বছর ধরে লেখা ভারতের সংবিধান বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠা দলিল।
একশো কোটির বেশি মানুষকে নিয়ন্ত্রণকারী এই দলিল, যা প্রধান সবগুলো ধর্মেই অনুসরণ করা হয়- ঔপনিবেশিক উত্তর সময়ে সবচেয়ে টিকে থাকা দলিল।
এই দলিলে ৪৫০টি আর্টিকেল, ১২টি তালিকা রয়েছে এবং সবকিছু বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। অনেক স্থানে এই বর্ণনা করতে গিয়ে বাক্যের ব্যবহার করা হয়েছে ভিন্নভাবে।
আইন বিষয়ক পণ্ডিত উপেন্দ্র বক্সীর বক্তব্য অনুযায়ী, ”এখানে অতুলনীয়ভাবে শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন বিদেশী রাষ্ট্র বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ”ভারত ব্যতীত অন্য কোন দেশ।”
১৯৫০ সালের পর সংবিধান একশো বারের বেশি সংশোধিত হয়েছে।
রক্তাক্ত দেশবিভাগ এবং স্বাধীনতার পরে ধর্মীয় এবং জাতিগত বিভেদ থাকলেও, ভারতের যেমন হওয়া উচিত, সেটা বিবেচনায় রেখেই সংবিধানটি রচিত হয়েছে।
জাতীয় একটি পরিচয় তৈরির চেষ্টায় সংবিধানের খসড়া নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়েছিল এবং বহু জাতির এই দেশে কীভাবে একটি জাতীয় পরিচয় তৈরি করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিল।
সমালোচকরা বলেন, এই সংবিধানটি মূলত পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং পশ্চিমে শিক্ষিত অভিজাত ব্যক্তিরা লিখেছেন।
পণ্ডিতদের মতে, বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং স্বার্থের সমঝোতা হিসাবে সংবিধানটি নিজেকে উপস্থাপন করছে যেখানে অনেক ঔপনিবেশিক আইনের প্রতিফলন রয়েছে।
সত্তর বছর পরে দেখা যাচ্ছে , সংবিধানটি সাধারণ ভারতীয়দের এমন ভাবে জাগিয়ে তুলেছে যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি বা সাম্প্রতিককালে শোনা যায়নি।
তবে অনেক পণ্ডিত মনে করেন, এই নথিটির সঙ্গে সবসময়েই সাধারণ ভারতীয়দের গভীর সম্পৃক্ততা ছিল।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রোহিত দে তার ‘ এ পিপল’স কন্সটিটিউট’ বইয়ে বলেছেন, সংবিধানটি সাধারণ নাগরিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং সাংবিধানিক কর্মকাণ্ডে অনেক সাধারণ নাগরিকের অংশগ্রহণ ছিল, যাদের মধ্যে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর বাসিন্দারাও রয়েছে।
মি. দে লিখেছেন, কীভাবে হাজার হাজার সাধারণ ভারতীয় তাদের জীবনযাপনের নানা দরকারে সংবিধানের সহায়তা নিতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। প্রথম সেটা শুরু হয় ১৯৫০ সালে যখন উত্তর ভারতের সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ করেন যে, একজন ব্যবসায়ী হিসাবে সংবিধানে দেয়া অধিকার কর্তৃপক্ষের দ্বারা লঙ্ঘিত হচ্ছে, কারণ তারা একজন ব্যবসায়ীকে সব সবজি ব্যবসার একচেটিয়া অধিকার দিয়েছে।
কিন্তু এবারের আন্দোলনে তা অনেক বিস্তৃত হয়েছে।
”এখানে দুইটি বিষয় রয়েছে, যা বর্তমান বিষয়টিকে অনেক বেশি উল্লেখযোগ্য করে তুলেছে। প্রথমত এটা অনেক বেশি বিস্তৃত, পুরো দেশজুড়ে ছড়িয়ে গেছে। ১৯৫০ এর দশকে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী দাবি করতো যে, সংবিধান তাদের রক্ষা করছে। কিন্তু এখন ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে অনেক মানুষ দাবি করছে যে, সংবিধান তাদের রক্ষাকবচ। দ্বিতীয়ত, এটা বিশেষ কিছু অধিকারের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে,” ড. দে বলছেন।
তিনি বলছেন, এটা যেন ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়, যখন ভারতীয়রা মিছিল করেছে, গান গেয়েছে এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।।
”বিক্ষোভকারীরা বলছেন, ক্ষমতা শুধুমাত্র দেয়াই নয়, দরকার হলে জনতা কেড়েও নিতে পারে।”
অনেকে বিশ্বাস করেন, নাগরিকরা সংবিধানের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন, কারণ নরেন্দ্র মোদী নেতৃত্বাধীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার প্রায় সকল বিরোধীদের ‘জাতীয়তা বিরোধী’ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে।
”কিন্তু সংবিধানকে তুলে ধরে বিক্ষোভকারীরা তাদের দেশপ্রেম প্রমাণ করতে পারছে, জাতীয় একটি প্রতীক এবং গান ব্যবহার করতে পারছেন এবং সংবিধানের বর্ণনাকে ব্যবহার করে অজাতীয়তাবাদকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছেন,” তিনি বলছেন।
অনেকে বিশ্বাস করেন, অনেকেই সংবিধানের বিষয়গুলোকে তুলে ধরছেন কারণ তারা আদালতের ব্যর্থতায় অসন্তুষ্ট, বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্ট- যথার্থ স্বচ্ছ নয় এবং সাধারণ নাগরিকদের অধিকারের রক্ষার ব্যাপারে তাদের রেকর্ড দুর্বল।
তারা বলছেন, সর্বোচ্চ আদালত, শাসকদের হাত থেকে যাদের সংবিধান রক্ষা করার কথা, দেখা যাচ্ছে তারা বিজেপির মতো ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসকদের মোকাবেলা করতে গিয়ে নীরব হয়ে থাকছে।
ড. দে বলছেন, ”সাধারণ নাগরিকদের অধিকার রক্ষা ও সাংবিধানিক ব্যাপারে আদালতের অনুপস্থিতির কারণে সাধারণ নাগরিকরা সামনে এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন এবং সংবিধানকে আঁকড়ে ধরেছেন।”
গত মাসে ৪০জন আইনজীবী দিল্লির সুপ্রিমকোর্টের বাগানে সমবেত হয়ে সংবিধান পাঠ করেছেন।
দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালায় কমিউনিস্ট সরকার ঘোষণা করেছে যে, বিদ্যালয়ের সকালের সমাবেশের সময় তারা সংবিধানের নানা বিধান পাঠ বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে।
”এই সব কিছুই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মূল বিষয়গুলোকে সম্পৃক্ত করা এবং ছড়িয়ে দেয়া,” বলছেন আইন বিষয়ক একজন পণ্ডিত ও ইন্ডিয়া’স ফাউন্ডিং মোমেন্টের লেখক মাধব খোসলা।
”সংবিধান হচ্ছে সবচেয়ে অবাক করা গণতন্ত্র, আমি মনে করি না এর আর কোন নজির আছে,” তিনি বলছেন। সূত্র : বিবিসি বাংলা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।