জুমবাংলা ডেস্ক: গাজীপুর সদর, কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা জুড়ে প্রায় ৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বেলাই বিল। বন্যা ও জলাবদ্ধতা ঠেকাতে এ বিল শত শত বছর ধরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া, এটি দেশি মাছের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। গাজীপুরের মাছের চাহিদার এক তৃতীংশ মেটায় এ জলাশয়। বেলাই বিলকে ঘিরে চার উপজেলার শত শত মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। বিশেষ করে, বর্ষাকালে বিল পাড়ের মানুষের কর্মসংস্থান হয় মাছ ধরে ও শাপলা তুলে। কয়েকটি নদী ও খালের সঙ্গে যুক্ত থাকা বেলাই বিলের পানি দিয়ে চাষাবাদ করেন চার উপজেলার কৃষকরা।কিন্তু, লাখো মানুষের ভরসাস্থল বেলাই বিল আজ ভালো নেই। হুমকিতে এ বিলের পরিবেশ। একদিকে ভূমিখেকো কোম্পানি ও ব্যক্তিদের দখল, অন্যদিকে শিল্প কারখানাগুলোর বর্জ্যের কারণে প্রাণ হারাচ্ছে এ বিল। ধুঁকতে ধুঁকতে এখন ‘আইসিইউ’তে বেলাই বিল।
উচ্চ আদালত এবং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে আবাসন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রাতের আঁধারে চলছে বালু ভরাটের কাজ। এতে একদিকে বেলাই বিলের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে, অন্যদিকে চটকধারী বাহারি বিজ্ঞাপনে প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, টঙ্গী-কালীগঞ্জ-ঘোড়াশাল মহাসড়কের পিপুলিয়া থেকে নলছাটা সংলগ্ন বেলাই বিলের বিশাল এলাকাজুড়ে তেপান্তর, নর্থ-সাউথ গ্রুপ ও কে এম ইউসুফ আলী অ্যান্ড গংয়ের সাইনবোর্ড লাগানো। সড়কের পাশে আছে তেপান্তর গ্রুপের সাইট অফিস। সাইট অফিস সংলগ্ন মহাসড়কের পাশে বেলাই বিলের কিছু অংশ ভরাট করে দুটি স্থানে পাকা স্থাপনা করে তাতে বড় সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে তেপান্তর গ্রুপ। পাশেই নর্থ-সাউথ গ্রুপ বিলের মধ্যে রাস্তা করে পানির ওপর তৈরি করছে পাকা স্থাপনা। একই জায়গায় ‘কে এম ইউসুফ আলী অ্যান্ড গং’ লেখা নতুন সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে সম্প্রতি। পূবাইল ব্রিজের নিচে বালু নদীর ওপর ড্রেজার বসিয়ে সড়কের পাশ দিয়ে বালু উত্তোলনের পাইপ টানা হয়েছে প্রায় এক কিলোমিটার। ইতোমধ্যে বিলের মাঝখানে বেশখানিকটা জায়গা ভরাট করা হয়েছে। ওই ভরাট অংশে গড়ে উঠেছে কাশবন।
স্থানীয়রা জানান, কাশবনের ওই জায়গা কয়েক বছর আগেই ভরাট করা হয়েছে। এর পর উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রশাসনের লোকজন এসে ড্রেজার বন্ধ করে দেয় এবং কিছু সাইনবোর্ড উঠিয়ে ফেলা হয়। প্রশাসনের লোক চলে গেলে আবার সাইনবোর্ড লাগানো হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবারও ওই চক্র রাতের আঁধারে বালু ভরাট করছে।
স্থানীয়রা জানান, কোম্পানিগুলো এলাকার প্রভাবশালী ও গুণ্ডা প্রকৃতির লোকজনকে জমির দালাল নিয়োগ করেছে। তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে কৃষককে জমি বিক্রিতে বাধ্য করছে। বাড়িতে বসেই কমিশনে হচ্ছে জমি রেজিস্ট্রি।
নর্থ-সাউথ গ্রুপের সাইনবোর্ডের পাশে কে এম ইউসুফ আলী অ্যান্ড গং লেখা সাইনবোর্ড কার? জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা রওশন বলেন, কোম্পানির নামে জলাভূমি ভরাটে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই ব্যক্তিমালিকানার সাইনবোর্ড লাগিয়ে ভরাট করছে। ইউসুফ আলী নর্থ-সাউথ গ্রুপেরই ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
বিজ্ঞাপন অনুযায়ী, বেলাই বিলে শুধু নর্থ-সাউথ গ্রুপের দখলে আছে ৩ হাজার বিঘারও বেশি জমি। তেপান্তর গ্রুপের দখলেও আছে প্রায় একই পরিমাণ জমি।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, বেলাই বিলে সাইনবোর্ড বসানো অধিকাংশ জায়গা এখনো ব্যক্তিমালিকানাধীন। সাইনবোর্ড বসানের জন্য প্রতি মাসে জমির মালিককে দেওয়া হয় ১ হাজার টাকা। শুধু ম্যাপ বানিয়ে চার বছরের বেশি সময় ধরে প্লট বিক্রি করছে বেলাই বিল দখল করা কোম্পানিগুলো।
তেপান্তর হাউজিং লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার মামুন আহমেদ বলেন, আমরা বর্তমানে বালু ভরাট করছি না। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমতি পেলে আমরা বেলাই বিলে পুনরায় হাউজিং প্রকল্পের কাজ শুরু করব।
নর্থ সাউথ গ্রুপের এজিএম হুমায়ুন কবিরের ব্যবহৃত মুঠোফোনে ফোন করলে তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে বলেন, ‘আমি মিটিং এ আছি। এ বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে আমাদের বনানী অফিসে আসেন।’ এ কথা বলেই তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন।
বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, নর্থ-সাউথ হাউজিং ও তেপান্তর হাউজিং লিমিটেড আইন ভঙ্গ করে বিলের জমিতে বালু ভরাট করছে। কখনই উন্মুক্ত জলাধারের জমি কোনো আবাসন প্রতিষ্ঠানের নামে থাকার সুযোগ নেই। এটা হয়ে থাকলে তা হবে আইন লঙ্ঘন। এ বিষয়ে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
বেলাই বিলে আবাসনের অনুমতির ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নয়ন মিয়া বলেন, কখনই কোনো প্রতিষ্ঠান উন্মুক্ত জলাশয় ভরাট করতে পারে না। আইন ভঙ্গ করে তেপান্তর হাউজিং লিমিটেড ও নর্থ-সাউথ গ্রুপ বেলাই বিলে বালু ভরাট করছে বলে আমরাও অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গাজীপুর সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাফে মোহাম্মদ ছড়া বলেন, ২০১০ সালের জলাশয় আইন অনুযায়ী বিভাগীয়, জেলা ও পৌর শহরের জলাশয় ভরাট করা যাবে না। খালের পাশে বিলের জায়গাগুলো ব্যক্তিগত হলেও ভরাট করা যাবে না। এছাড়া, হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক বেলাই বিল ও আশপাশের জলাশয়গুলোতে বালু ভরাট, অবৈধ দখল ও সাইনবোর্ড টাঙানো যাবে না। এরইমধ্যে আমরা খবর পেয়ে নোটিস দিয়েছি। নোটিসের পরও যদি তারা বালু ভরাটের কাজ করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজিজুর রহমান বলেন, যেখানে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে এবং জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা আছে, সেখানে কারো সঙ্গে সমঝোতার সুযোগ নেই, তিনি যত শক্তিশালীই হোন। যেহেতু জেলা সদর ও কালীগঞ্জ উপজেলায় এ বিলের অবস্থান, তাই ডিসি স্যারের নির্দেশনায় দুই উপজেলা প্রশাসন যৌথভাবে ব্যবস্থা নেবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।