রঞ্জু খন্দকার, রংপুর থেকে: ‘কী শোভা কী ছায়া গো, কী স্নেহ কী মায়া গো/ কী আঁচল বিছায়েছ, বটের মূলে নদীর কূলে কূলে…’
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার বাংলার এই রূপ এখন গ্রামবাংলার অনেক স্থানে না পেলেও একটি জায়গায় এখনো পাবেন। সেটি ভিন্ন জগত, রংপুর। একটি মনোমুগ্ধকর বিনোদনকেন্দ্র।
কবির বর্ণনা মতো, এখানে হয়ত নদী নেই; তবে কূল আছে ঠিকই– শান্ত-স্নিগ্ধভাবে বয়ে যাওয়া নদীর মতো খালের কূল। বিনোদনকেন্দ্রের তিনদিকে বয়ে যাওয়া খালের পাড়ে রয়েছে আঁচল বিছানো বটবৃক্ষের শোভা, ছায়া ও মায়া।
শুধু কী বটবৃক্ষ আর খালের মায়া? বরং বলা চলে কী নেই ভিন্ন এই জগতে! এখানে রয়েছে দেশের প্রথম প্লানেটোরিয়াম। রয়েছে রোবট স্ক্রিল জোন, স্পেস জার্নি, জল তরঙ্গ, সি প্যারাডাইস, আজব গুহা, ফ্লাই হেলিকপ্টার, মেরি গো রাউন্ড, লেক ড্রাইভ, সুইমিং পুল স্পিনিং হেড, নৌকাভ্রমণ ও মাছ ধরার ব্যবস্থা।
গাইবান্ধার ফুলছড়ি থেকে ভিন্ন জগতে বেড়াতে গিয়ে মুগ্ধ এক দর্শনার্থী ফারুক হোসেন বলেন, এটা আসলেই ভিন্ন এক জগত। কিন্তু কেন যেন এ বিনোদনকেন্দ্রটি রংপুরের বাইরের দর্শনার্থীদের কাছে এখনো অতটা জনপ্রিয় নয়। অথচ উত্তরাঞ্চলের অন্য বিনোদনকেন্দ্রগুলো ঘুরেই বলছি, সবচে সুন্দর এটিই।
প্রায় ১০০ একর জায়গা নিয়ে বেসরকারিভাবে গড়ে তোলা হয়েছে এই ভিন্ন জগত। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার গঞ্জীপুর এলাকায় এর অবস্থান। রংপুর শহর থেকে বাসে করে পাগলাপীর এলাকায় নামলে সিএনজি/ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ১৫-২০ মিনিটের দূরত্বে ভিন্নজগত। তবে রাস্তা কিছুটা এবড়োখেবড়ো।
স্থানীয় লোকজন জানান, রাস্তা আগে ভালো ছিল। অনেক দিন সংস্কার না করায় খারাপ হয়ে গেছে।
ভিন্নজগতে প্রবেশ ফি ১০০ টাকা। ভেতরে ঢুকে প্রধান ফটক পার হলেই দেখা যায়, তিন দিকের বিশাল লেক ঘেরা নয়নাভিরাম দৃশ্য। এসব লেকের পাড়ে আঁচল বিছিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বর্ষীয়ান সব বটবৃক্ষ। এসব বটের মায়ায় ধ্যানমগ্ন হতে পারেন যেকোনো মুনি-ঋষি। তবে সেদিন বটের ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছিলেন অনেক দর্শনার্থী।
দর্শনার্থীদের কয়েকজন জানান, গ্রামবাংলার অনেক স্থানে আর এত বটগাছ দেখা যায় না। সেখানে একটি বেসরকারি পার্কে এত বটগাছ রাখা হয়েছে, দেখলেই মায়া লাগে। এত ফাঁকা জায়গাও অন্য বিনোদনকেন্দ্রে দেখা যায় না।
বটের ছায়া মাড়িয়ে সামনে হাতের বাম পাশে পড়বে লোহার সেতু। সেতু পেরিয়ে সামনে নারকেলবাগান। নারকেলবিথীর ছায়াঘেরা রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে মন চাইবে অনেকটা সময়। কিন্তু অতদূর যাওয়া যাবে না। ওদিকে যে পথ শেষ!
আর বটের মায়া পেরিয়ে হাতের বামপাশে অনেক সময় হাঁটলেও পথ যেন ফুরাবে না। কারণ, ভিন্ন জগতের আজব সব জগত গড়ে তোলা হয়েছে এদিকটায়।
এদিকে প্রথমেই চোখে পড়বে দেশের প্লানেটোরিয়াম। সেখানে ঢুকলে দেখা যাবে সৌরজগতের সব গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, নীহারিকা। থ্রিডি মুভিতে দেখা যাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির সেই আদি বিস্ফোরণ — বিগ ব্যাং।
নভোথিয়েটার পেরিয়ে চোখে পড়বে বিশালাকার হস্তিসহ নানা প্রাণীর ভাস্কর্য। শিশুরা চাইলে সেসব হাতির কানও মলে দিতে পারবে, কিছু বলবে না হাতিগুলো। খেলতে পারবে শুঁড় নিয়েও।
ভাস্কর্য আর সবুজ ফাঁকা জায়গা পেরিয়ে পাবেন গাছগৃহ। একটি বটগাছের ওপর কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে সেই গৃহ। সেখানে কথা হলো একদল দর্শনার্থীর সঙ্গে। তাঁরা তিনজনই শিক্ষক। এসেছেন কুড়িগ্রাম থেকে।
এই দর্শনার্থীরা বললেন, এখানে সবার জন্যই বিনোদন রয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য রয়েছে শিক্ষামূলক বিনোদন। শিশুরা আসলে অনেক শিখতে পারবে।
গাছগৃহ পেরিয়ে খালের পাড় ধরে হাঁটলে দেখা মিলবে আজব গুহার টিকিট কাউন্টার। সেখানে টিকিট কেটে ছোট্ট সেতু পার হতে হবে। এরপর দেখা মিলবে সেই গুহার। গুহার মুখে বিরাট ‘হা’ করে আছে এক মনুষ্যমুখ। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। কৃত্রিম সেই মনুষ্যমুখই গুহার প্রবেশদ্বার।
গুহায় ঢুকলে আদিবাংলার অনেক নিদর্শনের দেখা পাওয়া যাবে। ঢেঁকিতে ধানভানা গ্রাম্যবধূ থেকে পালকিচড়া কনে, গরু নিয়ে হালচাষ করা কৃষকের দেখাও মিলবে।
গুহা পার হলে দেখা হয়ে যাবে আশিষ মহন্তের সঙ্গে। তিনি নিরিবিলি এই পাশে ঝালমুড়ির দোকান দিয়েছেন। তাঁর বয়স আশির আশপাশে হবে।
আশীষ মহন্ত বলেন, এখানে তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে দোকান করেন। শুক্র, শনিবারসহ ছুটির দিনগুলোয় লোক বেশি হয়। অন্য দিনেও লোক হয়। তবে কম।
আশীষ মহন্তের চায়ের দোকান পেরিয়ে বেড়িয়ে পড়লে পাবেন আগ্রার তাজমহল থেকে শুরু করে প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের দেখাও। এগুলো সব ‘মিনিয়েচার’।
এ পারে দেখা মিলল এক জোড়া তরুণ-তরুণীর। তাঁদের ভাষ্য, এখানে নিরিবিলি সময় কাটানোর পাশাপাশি অনেক ঐতিহাসিক স্থান, স্থাপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়।
তবে ভিন্ন জগতে আপনাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করবে এর সুপরিসর ফাঁকা জায়গা আর মায়াময় বটবৃক্ষের ছায়াই। এই পারেও বিরাট সব বটগাছ ছায়াদান করছে অকৃপণভাবে।
গাইবান্ধা থেকে আসা দর্শনার্থী ফারুক হোসেন আবারও বললেন, কেউ যদি প্রকৃতির মায়ায় সময় কাটাতে চান, তার ব্যবস্থা ভিন্ন জগতে আছে। আবার কেউ যদি কৃত্রিম ভাস্কর্য, স্থান, স্থাপনার সঙ্গে পরিচিত হতে চান– তাও এখানে রয়েছে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে এখানে যথেষ্ট গাছপালা আর ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছে। অনেক রাইড থাকলেও ঘিঞ্জি করা হয়নি কিছুই। যা চোখের জন্য আরামদায়ক। সেদিক থেকে এটি আসলেই ভিন্ন এক জগৎ।
রংপুর জেলা তথ্য বাতায়ন অনুসারে, ভিন্নজগতে একই সঙ্গে রয়েছে অন্তত ৫০০ পৃথক দলের পিকনিক করার ব্যবস্থা। শুধু ভেতরেই রয়েছে অন্তত ৮/৯শ গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা। কটেজ রয়েছে ৭টি। রয়েছে থ্রি স্টার মডেলের ড্রিম প্যালেস। রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থাও।
ভিন্নজগতের মালিক মোস্তফা কামাল বলেন, ভিন্নজগত উত্তরাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিনোদনকেন্দ্র। এখানে যারা বেড়াতে আসেন তাদের নিরাপত্তার দায়দায়িত্ব এখানে যারা কর্মরত আছেন তাদের। রয়েছে থাকার ব্যবস্থাও।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।