ভিয়েতনাম যুদ্ধের অস্ত্র ও আলোকচিত্র: ইতিহাসের নীরব সাক্ষী

এজেন্ট অরেঞ্জ গ্যালারি

সাইগন যুদ্ধ জাদুঘরের দেয়ালে যেসব আলোকচিত্র ঝোলানো আছে, সেগুলোতে ফুটে উঠেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং আমেরিকান সৈনিকদের নিষ্ঠুরতা। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার সঙ্গে যথেষ্ট সাদৃশ্য চোখে পড়ে। দুই যুদ্ধে প্রায় একই সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল।

 

এজেন্ট অরেঞ্জ গ্যালারি

৩০ এপ্রিল ১৯৭৫। ভোর ৫টা ২০ মিনিট। আমেরিকান দূতাবাস ভবনের ছাদ, সাইগন, দক্ষিণ ভিয়েতনাম। হেলিকপ্টারের রোটর ব্লেডের ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট বাতাসের ধাক্কায় চারপাশ কাঁপছে। অবাধ্য চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন উলফগ্যাং জে লেহম্যান সদর দরজার দিকে ফিরে তাকালেন। হাজারের ওপর মানুষ জটলা পাকিয়েছে সেখানে। যেকোনো মুহূর্তে দরজা ভেঙে এই জনস্রোত ভেতরে চলে আসবে। ঠেকানোর সাধ্য নেই কারও। অবশ্য ঠেকানোর মতো কেউ নেইও আর।

সাত হাজারের বেশি মানুষ, যাঁদের দুই–তৃতীয়াংশই দক্ষিণ ভিয়েতনামের বাসিন্দা, তাঁরা দূতাবাসকর্মীদের সহায়তায় সাইগন ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছেন। শেষ ব্যক্তি হিসেবে আরও পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে শেষ ফ্লাইটে চেপেছেন লেহম্যান। চশমার কাচ থেকে ময়লাটুকু পরিষ্কার করে চোখে চাপিয়ে ব্যাগ থেকে লালরঙা ডায়েরিটা বের করলেন। শেষবারের মতো আকাশ থেকে সাইগন শহরের দিকে তাকিয়ে কালো কালিতে ছোট্ট করে লিখলেন—
‘05 20 – Left Saigon’

লেহম্যান যখন এই পলায়ন পর্ব তদারক করছিলেন, তখন সেই ঘটনার ছবি তুলে বিখ্যাত হয়ে যান এক ডাচ আলোকচিত্রী, হুবার্ট ভ্যান ইজ যাঁর নাম। দূতাবাসের অনতিদূরে অবস্থিত ক্যারাভেল হোটেলের ব্যালকনি থেকে তিনি ছবিগুলো তুলেছিলেন, যেগুলো পরে ছাপা হয় পৃথিবীর প্রায় সব বিখ্যাত সংবাদপত্রে। গুগলে ‘ফল অব সাইগন’ লিখে সার্চ দিলে সবার আগে এই ছবিগুলোই দেখা যায়। হুবার্ট কিংবা লেহম্যান আদতে ইতিহাসের এক বাঁকবদলের সাক্ষী হয়েছিলেন।

যেই ঘটনার প্রতিঘাতে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যায় দক্ষিণ ভিয়েতনামের নাম, যবনিকাপাত ঘটে ২০ বছর ধরে চলা ভিয়েতনাম যুদ্ধের, যাত্রা শুরু হয় অখণ্ড ভিয়েতনামের। যেই ঘটনায় কূটনৈতিক এবং সামরিক পর্যায়ে প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমেরিকার ভাবমূর্তি। যেই ঘটনার ফলে দক্ষিণ চীন সাগরের তট থেকে সাময়িকভাবে বিলুপ্তি ঘটে পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থ ও শাসনব্যবস্থার, ভিয়েতনাম ছাড়াও লাওস ও কম্বোডিয়া প্রবেশ করে সমাজতান্ত্রিক ব্লকে। বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শেষে এসব প্রেক্ষাপট নিয়েই লেহম্যান ২০১৯ সালে লিখেছেন আত্মজীবনী ‘আ সিট ইন দ্য ফ্রন্ট রো’ নামে। ভিয়েতনামের যুদ্ধ জাদুঘরের গেটে দাঁড়িয়ে কেন জানি সেই বইটার কথাই মনে পড়ল।

২০ হাজার ডং মূল্যের টিকিট কেটে ভেতরের খোলা উদ্যানে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়বে সারি সারি ট্যাংক, হেলিকপ্টার, উড়োজাহাজ ইত্যাদি যুদ্ধযান, যেগুলো ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যবহার করেছিল দক্ষিণ ভিয়েতনাম এবং তাদের মিত্র পশ্চিমা বাহিনীর সদস্যরা। আরও আছে যুদ্ধে নিক্ষেপ করা বিশালাকৃতির সব বোমার খোলস। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি সম্ভবত ব্লু-৮২ সিসমিক বোমা। ৫ হাজার ৭০০ কেজি ওজনের প্রায় ১১ ফুট দীর্ঘ বোমাটি ১৯৭০ সালে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। অবাক হয়েছি একটা প্রার্থনা ঘণ্টা দেখে। ঘণ্টাটি তৈরি হয়েছে ২৫০ কেজি ওজনের একটি অবিস্ফোরিত বোমার খোলস থেকে। বিন থুয়ান রাজ্যের বু লাম প্যাগোডা থেকে ঘণ্টাটি সংগ্রহ করে ২০২০ সালে জাদুঘরের সংগ্রহশালায় সংযোজন করা হয়।

তিনতলা জাদুঘরটির নিচতলায় বেশ বড় একটি কক্ষে আছে নানা ধরনের ব্যাজের সংগ্রহ। ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালে আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন ধরনের ব্যাজ পরিধান করে মিছিল কিংবা প্রতিবাদ সমাবেশগুলোতে অংশ নিতেন। সেই সব ব্যাজের বেশ বড় একটা অংশই এখানে আছে।

দোতলার হলঘরে একই সঙ্গে যুদ্ধকালীন প্রচুর আলোকচিত্র এবং যুদ্ধসরঞ্জাম, বিশেষ করে অস্ত্র ও গোলাবারুদের নমুনা রাখা আছে। বিশালাকৃতির ৯০ মিলিমিটার বাজুকা রকেট লঞ্চার যেমন আছে, তেমনি আছে ৭৫ মিলিমিটার রিকোয়েল রাইফেল, ৮১ মিলিমিটার মর্টার, ব্রাউনিং এম২ মেশিনগান, কোল্ট লাইট মেশিনগান, বিভিন্ন মডেলের কারবাইন রাইফেল, বেলজিয়াম অটোমেটিক রাইফেল, এম৭৯ কেমিক্যাল গ্রেনেড লঞ্চার, থমসন রাইফেল, কোল্ট পিস্তলসহ বিভিন্ন মডেলের বন্দুক ও পিস্তল। মর্টার শেল, কামানের গোলা, গ্রেনেড, বন্দুক ও পিস্তলের গুলির বিশাল সংগ্রহ কাচের আবরণের ভেতর সাজানো আছে। বই পড়া কিংবা মুভি দেখার সুবাদে অনেকগুলো নাম পরিচিত হলেও কার্যকারণ সম্বন্ধে ভালো ধারণা নেই। বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন।

দেয়ালে যেসব আলোকচিত্র ঝোলানো আছে, সেগুলোতে ফুটে উঠেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং আমেরিকান সৈনিকদের নিষ্ঠুরতা। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতার সঙ্গে যথেষ্ট সাদৃশ্য চোখে পড়ে। দুই যুদ্ধে প্রায় একই সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যার জন্য সময় লেগেছিল যেখানে ২০ বছর, সেখানে বাংলাদেশে সময় লেগেছিল মাত্র ৯ মাস। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার মাত্রা কতটা বীভৎস ছিল, সেটি সহজেই অনুমেয়।

আমেরিকান বাহিনীর নৃশংসতার মাত্রাও কম ছিল না। ছবিতে বেশ কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে। তার মধ্যে নজর কেড়েছিল বব কেরির ঘটনাটি। যুদ্ধের সময় লেফটেন্যান্ট বব কেরি ছিলেন আমেরিকান সিল রেঞ্জার্স গ্রুপের একজন প্লাটুন কমান্ডার। ১৯৬৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বব কেরির প্লাটুন ভিয়েতকং গেরিলাদের খোঁজে থান ফং নামের গ্রামে অভিযান চালায়।

সেই অভিযানে প্রায় ২০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে তাঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন ষাটোর্ধ এক দম্পতি এবং তাঁদের তিন নাতিনাতনি। বাচ্চা তিনজন একটা সুয়্যারেজ পাইপের ভেতরে লুকিয়ে ছিল ভয়ে। সেখান থেকে বের করে এনে ঠান্ডা মাথায় দুজনকে গুলি করে, আরেকজনের নাড়িভুঁড়ি বের করে হত্যা করা হয় বব কেরির সরাসরি নির্দেশে। বাচ্চা তিনটি যেই সুয়্যারেজ পাইপের ভেতরে লুকিয়ে ছিল, সেই পাইপ সংরক্ষণ করা আছে এখানটায়।