জুমবাংলা ডেস্ক : আমার সুযোগ হয়েছে, আবরার হত্যার পর বুয়েটে ছাত্রদের আন্দোলন দেখার আবার একই সাথে শিক্ষক সমিতির মিটিংয়ে উপস্থিত থেকে সমস্যার অন্য প্রকৃতি বোঝার। আমি দেখেছি বুয়েটের শিক্ষার্থীদের জেদ, সহিষ্ণুতা আর একতায় কিভাবে সিসি টিভি পুরো ফুটেজ আদায় করল, বুয়েটের জমে থাকা ময়লা পরিষ্কার করার জন্য দুই দিন ধরে রাস্তায় বসেছিল,…ঠিক একইভাবে আমি দেখেছি শিক্ষক সমিতির মিটিংয়ে কথা বলতে গিয়ে কয়েকজন স্যারকে কাঁদতে, নিজেদের অসহায়ত্ব, সীমাবদ্ধতার মাঝেও চেষ্টা করার কথা এবং পরবর্তীতে নিজেদের দায়ী করে ছাত্রদের সামনে দাঁড়াতে…
আজ ছাত্ররা ছিল পরীক্ষক। … আজকের ওই পরীক্ষায় কে পাস করেছে বা কে ফেল করেছে, সে জায়গাতে আমার কিছু নিজস্ব মতামত আছে।… কারণ আমার মনে হয়, আমরা অনেক মাসুল দিয়ে আজ যে জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে চাচ্ছি সেখানে কাউকে হারলে চলবে না,… আর এ জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে কয়েকটি প্রশ্ন যা তাদের মধ্যে একটা যৌক্তিক চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি করছে তার কিছু মতামত নিজের মতো করে দিতে চাই।
১) শিক্ষার্থীদের একটা প্রশ্ন “হলের এই সমস্যাগুলো প্রভোস্ট স্যারদের জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয় নাই কেন? … ইত্যাদি”
আজ শিক্ষক সমিতির মিটিংয়ে অনেক প্রভোস্ট, সহকারী প্রভোস্ট স্যাররা বলেছেন তাদের প্রশাসনিক অসহায়ত্তের কথা। তারা ছাত্রদের কাছ থেকে অভিযোগ পান, সেটা নিয়ে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা তাদের কম (আমি নিজেও আজ জানলাম)। যিনি ব্যবস্থা নিতে পারেন (ভিসি স্যার)-এর কাছে তাদের বার বার গিয়ে সময় না পেয়ে ফিরে আসা, বা কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে রিপোর্ট দেওয়ার পর ও সেই অনুযায়ী যার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তিনি যখন কোনো ব্যবস্থা নেন না, তখন ওই প্রভোস্ট স্যারদের কি করার থাকে?… আজ আরেক ভয়ানক কথা শুনলাম, এক ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে নাকি অভিযোগ ছিল,… ভিসি স্যার নাকি ওই হলে গিয়ে ওই ছেলেকে দেখে (হাফপ্যান্ট পরা সিগারেট হাতে) আগ বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে আসে… তাহলে কিভাবে সামান্য এক প্রভোস্ট স্যার কোন ব্যবস্থা নিবেন… আরো অনেক কথা প্রভোস্ট স্যাররা বলেছেন, অনেক সময়, আগের DSW স্যারকে জানিয়েও কোনো সুফল পান নাই। আজ জানলাম কিভাবে সব কিছুতে ছাত্রলীগের (হল/বুয়েট শাখা) প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা থাকে, তারা চেষ্টা করেছেন কিন্তু সব কিছু ওই একজনের কাছে গিয়ে আর আলোর মুখ দেখেনি… আমাদের মধ্যেও প্রশ্ন ছিল, তাহলে তারা কেন আগেই পদত্যাগ করেননি? পরে পুরো ব্যাপার শুনে আমরা বুঝলাম তাদের পদত্যাগটাই সমাধান না, যে আসবে সেও একি পরিস্থিতিতে পড়বে… কারণ প্রভোস্টরা সমস্যা শুনে রিপোর্ট দিতে পারে, ওপরে জানাতে পারে, অথচ, যারা সমস্যার কারণ তাদের সাথে ওপরওয়ালার নাকি সরাসরি কানেকশন, কোনো রিপোর্ট লাগে না… সেখানে স্যাররা অনেক কিছু চাইলেও পারে না, আর না পারতে পারতে হয়তো আর চাইতেও যায় না।
উল্লেখ্য, হলের যে সিসি টিভি ফুটেজ নিয়ে আজ আমরা প্রমাণ করতে পারছি অনেক কিছু, সেই সিসি টিভি ফুটেজ, হল অফিসের বাইরে থেকে বন্ধ দরজার ভেতরে দুইজন শিক্ষক (সহকারী প্রভোস্ট, নাম মনে আসছে না) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগলে বসেছিল। কারণ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে যারা খুন করেছে তাদের লোক যেন নষ্ট করতে না পারে। অথচ গুজব ছড়াল যে, ফুটেজ নষ্ট করা হচ্ছে। …
২) শিক্ষার্থীদের একটা প্রশ্ন “বর্তমান DSW (মিজানুর রহমান) স্যার এ ধরনের ঘটনায় ব্যর্থ কিনা? বা একটা ছবিতে (যেটা সিসি টিভি ফুটেজ থেকে নেওয়া) যেখানে ঘটনার দিন রাত প্রায় ৩.৩০ নাগাদ স্যারকে প্রভোস্ট, খুনিদের কয়েকজন ও ডক্টরসহ দেখা যাচ্ছে সেখানে কি হচ্ছিল? (কারো কারো মতে তিনি কি খুনিদের সাহায্য করছিলেন কিনা?)
বর্তমান DSW (মিজানুর রহমান) স্যার এ ঘটনায় ব্যর্থ কিনা সে বিষয়ে বলব, স্যার এ দায়িত্ব পেয়েছেন মাত্র তিন মাসের কিছু বেশি। বুয়েট কিন্তু এই তিন মাসে এমন ভয়াবহ হয়নি। এটা অনেক দিনের (পূর্বে যারা এই পদে ছিলেন) অবহেলার, দেখে না দেখার বা সমস্যা যিনি সমাধান করবেন সেই ভিসি স্যারের অসহযোগিতার ফল। আজ জানলাম DSW এর ক্ষমতা কি? তিনি শুধু ছোট খাটো বিষয়ে তদন্ত বা রিপোর্ট করতে পারেন বা ব্যবস্থা নিতে পারেন। তিনি বেশ কিছু উদাহরণ দিয়েছেন যা তিনি করেছেন। এর বেশি কিছু করতে হলে সেটা পারেন ভিসি স্যার। ছাত্রদের এমন একটি বিষয় তিনি প্রায় এক মাস আগে ভিসি অফিসে পাঠিয়েছেন তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য যা আজও হয়নি… অর্থাৎ আমরা সবাই ওই এক জায়গায় বন্দি। আজ মিটিংয়ে DSW স্যার এটাও বলেছেন “আবরার হত্যার ঘটনার সমাধান করার পর যদি বর্তমান ভিসি স্যার থাকেন তাহলে তিনি নিজে পদত্যাগ করবেন” … কতটা অসহযোগিতা পেলে মানুষ এমন করে বলে। তিনি এটাও বলেছেন যে এখন পদত্যাগ করতে চান না কারণ, এখন যদি পদত্যাগ করে তাহলে তিনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না, তিনি চান তার সময়ে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখে যেতে, দ্বিতীয়ত এটা তদন্ত কাজেও সমস্যা করবে…। আমার কাছে বিষয়টি ভালো লেগেছে।
এবার আসি, কেউ কেউ সিসি টিভি ফুটেজে DSW (মিজানুর রহমান) স্যার, ডাক্তার, প্রভোস্টসহ অন্যদের সাথে খুনিদের কয়েকজনে দেখিয়ে বলতে চাচ্ছে যে, তিনি খুনিদের সহযোগিতা করছেন। আমি মনে করি তারা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করছেন না বিষয়টা। DSW স্যারকে যখন রাত ৩.১৫ মিনিটের দিকে হলের প্রভোস্ট ও সহকারী প্রভোস্ট বাসায় এসে খবর দিল, তখনি তিনি তাদের সাথে নিয়ে চলে আসেন… তিনি যদি দেরি করতেন আমরা বলতে পারতাম দায়িত্বহীনটার পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু সেটা হয়নি। এখন হলে এসে তিনি কিভাবে জানবেন কে খুন করছে? খুনি নিশ্চয়ই বলবে না বা গার্ড তো দেখেনি … এখন আমরা জানি কারণ আমাদের কাছে ফুটেজ আছে, কিন্তু তখন ওইখানে যারা ছিল সবার সাথে কথা বলা মানে তো খুনিদের সহায়তা করা না…।
দ্বিতীয়ত শুনলাম স্যার পুলিশ আসা পর্যন্ত ছিলেন এবং সকাল ১১.০০টা নাগাদ ছিলেন। ওখানে খুনি (পরে জানা গেছে) কারো সাথে স্যারের কোনো কথা হয়েছে কিনা বা কি কথা হয়েছিল সেটা আমরা জানি না।… ধরেন যদি কেউ বলেও থাকে যে, সে এভাবে পিটায় ছেলেটাকে মেরেছে, তখন আমরা হলে কি করতাম, পুলিশকে খবর দিতাম, যেটা ওই সময় হল থেকে করা হয়েছে।
পাশাপাশি পুলিশ আসা পর্যন্ত, যারা উপস্থিত তাদের থেকে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। স্যার বলেছেন যে, তিনি ও সহকারী প্রভোস্ট স্যার সেটাই করছিলেন। বরং আমি মনে করি রাত তিনটায় ঘুম থেকে উঠে এসে মাত্র তিন মাসের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতায় তিনি যে নিষ্ঠুরতা দেখেও মাথা ঠাণ্ডা রেখেছেন, সেটা ওই সময়ে দরকার ছিল। তাই আমার মনে হয় আমরা নিজেদের বিচক্ষনতার পরিচয় দেই। কারণ এ ঘটনায় কেউ কেউ নিজের স্বার্থেও ব্যবহার করতে পারে। তিনি যদি আজ খুনিদের পক্ষে বলতেন তখন আমরা তাকে দোষ দিতে পারতাম, খুনি কে জানার পর তিনি তো তাদের পক্ষে কোনো কথা বলেননি… আমরা কেন ভুলভাবে তাকে উপস্থাপন করব?
মূলত DSW (মিজানুর রহমান) স্যারকে আমি চিনি দীর্ঘদিন। কারো সাথে রেগে কথা বলতে দেখি নাই, আমার মনে হয় অন্য কেউ ও দেখে নাই। এবং স্যারের কাছে সবাই অ্যাক্সেস পায়। তার ওপর উনার বর্তমান পদটিই হলো “ছাত্র কল্যাণ পরিচালক”, অর্থাৎ ছাত্রদের নিয়েই সব কাজ, সে যেই দলের হোক বা যেই হোক। সেই জায়গা থেকে তিনি অনেক ছাত্রকে অন্য সবার চাইতে বেশি চিনবেন বা ছাত্ররা তার কাছে বেশি চাইবে এটাই স্বাভাবিক। সেই হিসাবে যে/যারা খুন করেছে (ফুটেজ দেখে পরে প্রমাণিত) তারা স্যারের পরিচিত হতে পারে, তার সাথে ওই সময় সেই রাতে স্যার কথা ও বলতে পারে , তার মানে তো এই না যে, তিনি আগে থেকেই সব জানেন আর তাদের কোন ভাবে সাহায্য করেছেন… তাছাড়া সেখানে একজন ডাক্তার, প্রভোস্ট, সহকারী প্রভোস্ট, দারোয়ানসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিল। একটু বোঝার চেষ্টা করি।
৩) শিক্ষার্থীদের একটা প্রশ্ন “আমরা (শিক্ষকরা) কেন এতদিন প্রতিকার করিনি, আমরা কি ভয় পেয়েছিলাম”?
হলে আবাসিক ছিলাম না, আর পাশ করার পর আজ ১২ বছর হলে যাওয়া হয় নাই… গত কয়েক বছর হলের অবস্থা ভালো না, বা রাজনৈতিক বিষয়গুলো, হিংসা প্রবল সেটা মোটামুটি কিছুটা জানতাম। তবে আজ এর ভয়াবহতা কত সেটা জানলাম যখন প্রভোস্ট স্যাররা মিটিংয়ে বিভিন্ন ঘটনা বললেন তখন। এবং জানলাম ছাত্রলীগ (বুয়েট) কিভাবে সব কিছুতে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে চাইত। এবং শুনলাম প্রভোস্ট স্যার বা DSW স্যার দের কিছু চেষ্টার কথা। পাশাপাশি এটাও জানলাম কেন এই চেষ্টা দীর্ঘমেয়াদি ফল পায় না। কারণ, যিনি বা যার কাছে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আছে তিনি বুয়েট এর স্যারদের সময় দেন বা না দেন, ছাত্রলীগের জন্য সব সময় উন্মুক্ত। আসলে হয়ত স্যার রা ভয় পায়, বা হয়ত বা বার বার বিফল হয়ে চেষ্টা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে… তারা এখন শুধু অর্পিত দায়িত্ব পালন করা যান, ঝামেলা চান না… কারণ ঝামেলায় পরলে যিনি রক্ষা করবেন সেই ভিসি স্যার কে পাওয়া যাবে না…। যেমন আবরার পায়নি তার মৃত্যুর পরেও …
তবে, আজ একটা বিষয় মনে হচ্ছে, সবার মধ্যে থেকে ভয় টা চলে গেছে… আজ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বুয়েটে ছাত্র, শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করার…স্যাররা সবাই এ পরিস্থিতির দায়িত্ব মাথা পেতে নিয়েছেন… এ বিষয়ে সরকারের ও সহযোগিতা চেয়েছি… আর ছাত্র রাজনীতির অনেক ভালো উদাহরণ আমাদের আছে, কিন্তু আমরা এখন সেটা থেকে অনেক দূরে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে যে শুদ্ধাচার শুরু করেছেন সেটা আমাদের জন্য একটা উদাহরণ। এছাড়াও আরো কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে…
৪) শিক্ষার্থীদের একটা প্রশ্ন “এতক্ষণ ধরে আবরারকে মারল, বা সিসি টিভিতে দেখা গেল তারপরও কেন কেউ / স্যার রা আসলো না”
আসলে আমার মনে হয়, স্যার রা জানবে কিভাবে, কেউ তো তখন তাদের জানায় নাই। সিসি টিভিতে আবরারকে মেরে নিয়ে যাবার ঘটনা তিনবার আসছে এবং খুব অল্প সময়ের জন্য। গার্ড হয়ত ওই সময় স্ক্রিনের দিকে তাকায় নাই তাছাড়া তখন বাজে রাত ১টার বেশি… কেউ যদি না দেখে বা না জানায়, এমন কি আবরারকে যখন মারা হয় তখন তার চিৎকার শুনেও তো কেউ প্রভোস্টদের জানায় নাই… যদি কেউ জানাত আর যদি কেউ না আসত তাহলে বলতে পারতাম… আজ তো DSW ( মিজানুর রহমান ) স্যার বলছেন যে, তিনি যদি একবার জানতেন বা কেউ যদি তাকে আগে একবার জানাত তিনি সেই রুম পর্যন্ত অবশ্যই যেতেন। সবাই তো জানল শেষে…
আমরা চাই, অনেক কষ্ট পেয়ে যে আবরার চলে গেছে, আজ থেকে অনেক বছর পর আমরা যেন বলতে পারি সেই আবরার আমাদের দিয়েছে একটা সুন্দর, সপ্নের বুয়েট, যা ছিল আমাদের গর্ব।
… লেখাটি কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ বা পছন্দ বা অপছন্দ করে নয়… আজ যা জানলাম তা নিজের মতো করে বলা। যতটুকু জানি, বুজেছি ততটুকুই। আমি এই প্রশ্নের উত্তর দেবার কেউ না, তবুও নিজের মতামত দিলাম যাতে আমরা ভুল বোঝার কারনে মূল সমস্যা থেকে সরের যাই। আমরা যে খুনি তাকে খুনি বলব, অযথা যেন কারো উপর অবিচার না করি… কারন সীমাবদ্ধতা সবারই আছে…
ধন্যবাদ বুয়েটের ছাত্র-ছাত্রীদের। তার প্রথমে শুনেছে এরপর সুশৃঙ্খলভাবে প্রশ্ন করেছে, স্যাররা যতটুকু পেরেছে বলেছে… যে সুন্দর বুয়েটের দিকে অনেক দাম দিয়ে অনেক পরে আমরা যাত্রা করছি, সে পরীক্ষায় সবাইকে জিততে হবে একসাথে।
লেখক : শিফুন নেওয়াজ, সহকারী অধ্যাপক, বুয়েট
সূত্র : কালের কন্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।