মহান আল্লাহ গোটা বিশ্বের একক স্রষ্টা ও মালিক। এ বিশাল সৃষ্টির কোনো উপাদানে বা এর সামান্য কিছুতেও মানুষের কোনো হাত নেই। এমনকি একটি ধূলিকণা, এক ফোঁটা পানি কিংবা একমুঠো শুকনা পাতা পর্যন্ত সৃষ্টির ক্ষমতা মানুষের নেই; বরং সব মৌলিক সৃষ্টিই মহান আল্লাহর এবং মানুষ তার সীমিত জ্ঞান ও শক্তির বলে সেসব মৌলিক উপাদান বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতে পারে মাত্র। আর তার জ্ঞান বা শক্তিও তার নিজস্ব নয়, তাও মহান আল্লাহর সৃষ্টি।
সুতরাং জগতে মানুষের মালিকানা বলতে কিছুই নেই। মালিকানার সবটুকু একমাত্র আল্লাহর। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন : ‘তিনিই আল্লাহ, প্রতিটি বস্তু সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তার পথনির্দেশ (ব্যবহার-বিধি জ্ঞান দান) করেছেন।’ (সুরা : ত্বা-হা, আয়াত : ৫০)
তিনি আরো বলেন : ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সব আল্লাহরই।
’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ২৪)
তাই পৃথিবীর মালিক নিরঙ্কুশভাবে মহান আল্লাহ, আর তিনি মানুষকে তাঁর উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন। তাই মানুষ তাঁর বিধান অনুযায়ী ভূপৃষ্ঠের বিধিবদ্ধভাবে যাবতীয় সমপদ ভোগ-দখল করতে পারবে। এটাই ইসলামের মূলনীতি। এ নীতি অনুসারে মহান আল্লাহর মালিকানার অধীনে মানুষের সীমিত মালিকানা স্বীকৃত।
এ সমপর্কে মহান আল্লাহ বলেন : ‘তিনি (আল্লাহ) পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্টজীবের জন্য, এতে আছে ফলমূল, আবরণযুক্ত খেজুর এবং খোসাবিশিষ্ট দানা ও সুগন্ধ ফুল।’ (সুরা : আর-রাহমান, আয়াত : ১০-১২)
আর মহান আল্লাহর দেওয়া এ উত্তরাধিকার বলেই মানুষ সম্পত্তি হস্তান্তর, দান, ক্রয়-বিক্রয় ও উত্তরাধিকারের ক্ষমতা লাভ করেছে। যদিও নিরঙ্কুশ মালিকানা সে কিছুতেই লাভ করতে পারে না। আর ইসলামী নীতি অনুসারে ব্যক্তিমালিকানার বিলোপ কিংবা সমুদয় সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্তকরণ অবৈধ।
ভূমির ওপর সমষ্টির মালিকানা
ভূমির ওপর সমাজ ও সমষ্টির মালিকানা ইসলামে স্বীকৃত।
কিন্তু সমাজ ও সমষ্টির এ মালিকানা সীমাহীন ও সর্বগ্রাসী নয়, ব্যক্তিস্বার্থবিরোধীও নয়। দেশের সব ভূমিই যদি ব্যক্তিমালিকানা ও ভোগাধিকারে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে সামাজিক প্রয়োজন পূরণ করা নানাভাবে ব্যাহত হতে পারে। এ জন্য ইসলামী অর্থনীতি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানেও ভূমি রাখার অনুমতি দিয়েছে, যেন প্রয়োজনের সময় দেশের ভূমিহীন লোকদের মধ্যে তা বণ্টন করে দেওয়া সম্ভব হয়।
ইসলামী অর্থনীতিতে ভূমিস্বত্বের স্বরূপ
ভূমির ওপর স্বত্বাধিকার এবং সরকারি ভূমির রাজস্ব আদায়ের বিধানকে ভূমিস্বত্ব বলা হয়। ইসলামে জমিদারি, জায়গিরদারি, তালুকদারি, হাওলাদারি প্রভৃতি কর আদায়কারী মধ্যস্বত্বের স্থান স্বীকৃত নয়। এসব স্বত্ব মূলত পুঁজিবাদী, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভিত্তি।
খাজনা আদায়কারী মধ্যস্বত্বভোগীরা সরকারকে খুবই নিহারে কর প্রদানের ফলে একটি বিশাল ভূমির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে বসে এবং জমির মালিক চাষিদের কাছ থেকে নিজেদের মনগড়া হারে কর আদায় করে। জমির মালিক জমি থেকে কোনো ফসল না পেলেও বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলেও জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগী এবং সরকার বার্ষিক খাজনা ক্ষমা করে না। তাই ইসলামী অর্থনীতি এমন জমিদারি বা নিছক খাজনা আদায়কারী মধ্যস্বত্বভোগীদের ঘোর বিরোধিতা করে। ড. এম এ মান্নান লিখেছেন, প্রচুর জমি হস্তগত করে আল্লাহর জমিন থেকে জীবিকা আহরণে অন্যদের অধিকার হরণ করা কোরআনের দৃষ্টিতে কখনো বৈধ হতে পারে না।’ (ড. এম এ মান্নান, ইসলামী অর্থনীতি : তত্ত্ব ও প্রয়োগ, পৃ. ৭৩)
ভারসাম্যপূর্ণ ভূমি মালিকানা
ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ ভূমি মালিকানায় বিশ্বাসী। ইসলাম ভূমির মালিককে দুটি উপায়ে ভূমি ভোগ ও ব্যবহার করার নির্দেশনা দেয়।
১. ভূমির মালিক নিজে চাষাবাদ করবেন।
২. কোনো কারণে নিজে চাষ করতে না পারলে অন্যের দ্বারা তা চাষ করাবেন। অথবা চাষাবাদের কাজে অন্যের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করবেন। ইসলামে ভূমিকে উৎপাদনের প্রধান উপকরণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ব্যক্তিগত ভূমিস্বত্ব ও ভোগাধিকার
ইসলামের ভূমিনীতিতে জমির মালিকানা লাভ ও ভোগদখলের দৃষ্টিতে জমিকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—প্রথমত, আবাদি মালিকানাধীন জমি—এ ধরনের ভূমিতে ব্যক্তিগত স্বত্ব বিদ্যমান। এতে মালিক ইচ্ছামতো চাষাবাদ, উৎপাদন, বৃক্ষরোপণ, বাড়ি নির্মাণ ইত্যাদি কাজ কিংবা যেকোনোভাবে ব্যবহার করতে পারবে। এ জমি মালিকের অধিকারভুক্ত থাকবে। এতে মালিকের বৈধ অনুমতি ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির হস্তক্ষেপ, ব্যবহার বা কোনোরূপ অধিকার থাকবে না।
দ্বিতীয়ত, অনাবাদি মালিকানাধীন জমি : এ ধরনের জমি কারো মালিকানাধীন থাকা সত্ত্বেও পতিত অবস্থায় থাকে। এতে বসবাস করা, কৃষিকাজ করা কিংবা বনজঙ্গল থাকলেও তা পরিষ্কার করা হয় না, এরূপ পতিত অনাবাদি জমিতে ব্যক্তির মালিকানা থাকবে এবং আবাদি জমির মতোই এর বিক্রয়, হস্তান্তর, দান ইত্যাদি করতে পারবে ও এতে উত্তরাধিকার স্বত্ব বলবৎ থাকবে।
তৃতীয়ত, জনকল্যাণের জন্য নির্দিষ্ট জমি : কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কিংবা কোনো গ্রামবাসী কর্তৃক প্রদত্ত পশুপালন, পাঠশালা প্রতিষ্ঠা, ঈদগাহ বা কবরস্থানের জন্য বা অন্য কোনো জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য নির্দিষ্ট জমি এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এরূপ জমিতে কারো ব্যক্তিমালিকানা থাকে না। কিংবা কোনো ব্যক্তিবিশেষ নিজ স্বার্থে এ জমি ব্যবহার করার অনুমতি পান না। এবং এর হস্তান্তর ও ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে না।
চতুর্থত, অনাবাদি ও পরিত্যক্ত জমি : অনাবাদি ও পরিত্যক্ত জমির মধ্যে এক শ্রেণির জমি আছে, যেগুলো কারো ভোগদখলে নেই বা কারো মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ শ্রেণির জমিকে ইসলামী অর্থনীতির পরিভাষায় মৃত জমি বলা হয়। এজাতীয় জমিতে দেশের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী মানুষের অধিকার ও মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশে ও রকম যত অনাবাদি পতিত জমি থাকবে সরকারিভাবে সেগুলো কৃষি উপযোগী বা ব্যবহার করে গড়ে তুলতে হবে। এরূপ প্রাপ্ত জমিতে যে কৃষিকাজ করবে বা জমি আবাদ করবে, সেই উক্ত জমির মালিক হবে। এই নীতিতে পাহাড়-পর্বতে, বনজঙ্গলে ও মরুভূমিতে মানুষের ভূমির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। হাদিসে এসেছে : আয়েশা (রা.) বলেছেন, নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি মালিকানাহীন কোনো জমি আবাদযোগ্য করে, ওই ব্যক্তি ওই জায়গার হকদার। উরওয়া বিন জোবায়ের (রা.) বলেছেন, ওমর (রা.) তাঁর খেলাফতকালে এর ওপর আমল করেছেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩৩৫)
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘যে ব্যক্তি মৃত (অনাবাদি) ভূমি জীবিত (আবাদযোগ্য) করেছে, সে জমি তার।’
(তিরমিজি, হাদিস : ১৩৭৯)
এ ব্যাপারে ইসলামী আইনজ্ঞরা একমত। মতভেদ এ ব্যাপারে যে আবাদযোগ্য করার দ্বারাই কি কোনো ব্যক্তি পতিত জমির মালিক হয়ে যায়, নাকি মালিকানা প্রমাণের জন্য সরকার থেকে অনুমতি প্রয়োজন? এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) রাষ্ট্রের অনুমতি প্রয়োজন মনে করেছেন। কিন্তু ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ইমাম মুহাম্মদ (রহ.), ইমাম শাফেঈ (রহ.) ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.) প্রমুখের মত হলো, এ সম্পর্কে হাদিস একেবারেই সুস্পষ্ট। তাই আবাদকারীর মালিকানার অধিকারের জন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর দেওয়া হক অনুযায়ী, আবাদকারী এ জমির মালিক হয়ে যাবে। এরপর ব্যাপারটা যখন রাষ্ট্রের কাছে পেশ হবে তখন এ কাজ হবে আবাদকারীর হককে মেনে নেওয়া। আর যদি এ নিয়ে কলহ বাধে, তাহলে রাষ্ট্র তার হকই বলবৎ রাখবে। ইমাম মালিক (রহ.) জনবসতির নিকটবর্তী জমি ও দূরবর্তী অনাবাদি জমির মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁর মতে, প্রথম প্রকারের জমি এ নির্দেশের আওতাধীন নয়। আর দ্বিতীয় প্রকারের জমির জন্য অনুমোদন শর্ত নয়। শুধু আবাদ করার মাধ্যমেই আবাদকারী এ মালিক হয়ে যাবে। (বিস্তারিত দেখুন : ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ৩৬ ৩৭; আবু উবায়েদ, কিতাবুল আমওয়াল, পৃষ্ঠা ২৮৫-২৮৯)
সূত্র : কালের কণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।