গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দেওয়ার শব্দ, বিমানের টেকঅফের সেই উত্তেজনাকর কষট, কিংবা ট্রেনের চাকায় লেগে থাকা রেললাইনের গুঞ্জন – ভ্রমণের প্রতিটি মুহূর্তই তো রোমাঞ্চে ভরা। কিন্তু হঠাৎ করেই কি মনে পড়লো, পাসপোর্টটা ফটোকপি করা হয়নি? কিংবা প্রিয় জুতো জোড়াটা ব্যাগে রাখতে ভুলে গেছেন? এমন ছোটখাটো ভুল বা প্রস্তুতির ঘাটতি পুরো ভ্রমণের স্বাদ মাটি করে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, জরুরি স্বাস্থ্য সমস্যা, ডকুমেন্টের গড়মিল, বা নিরাপত্তাজনিত অসাবধানতা ডেকে আনতে পারে বড় ধরনের বিপদ। এই কারণেই ভ্রমণের আগে কী কী লাগবে – তা বিস্তারিত জানা এবং প্রস্তুতি নেওয়া শুধু জরুরিই নয়, একান্ত অপরিহার্য। এটি শুধু সুবিধাজনক ভ্রমণের চাবিকাঠি নয়, আপনার এবং আপনার সঙ্গীদের নিরাপত্তা ও শান্তির নিশ্চয়তাও বটে।
ভ্রমণের আগে কী কী লাগবে? জেনে রাখুন জরুরি প্রস্তুতির প্রথম ধাপ (পরিকল্পনা ও কাগজপত্র)
ভ্রমণ মানেই শুধু গন্তব্যে পৌঁছানো নয়, সেখানে নির্বিঘ্নে, আনন্দে এবং নিরাপদে সময় কাটানো। আর এর জন্য প্রয়োজন পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনা এবং অপরিহার্য কাগজপত্রের সমাবেশ। মনে রাখবেন, ছোট্ট একটি কাগজের টুকরোই (যেমন ভিসা বা ইমিগ্রেশন কার্ড) আপনার পুরো ট্রিপ বাঁচাতে পারে অথবা বানচাল করে দিতে পারে।
- গন্তব্য গবেষণা ও বাজেট নির্মাণ: শুধু নাম শুনেই রওনা দেওয়া কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আপনার গন্তব্য সম্পর্কে গভীরভাবে জানুন। সে দেশের বা অঞ্চলের সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, প্রধান আকর্ষণ, স্থানীয় খাবার, আবহাওয়ার ধরন – সবকিছুই জেনে নিন। এটি আপনাকে প্যাকিং থেকে শুরু করে দৈনন্দিন খরচ পরিকল্পনায় সাহায্য করবে। এরপর আসে বাজেট। হাতে নগদ অর্থ কতটা রাখবেন, কার্ড নেবেন কিনা, স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার কেমন – সবকিছুই আগে থেকে ঠিক করুন। ভ্রমণ বীমা (ট্রাভেল ইনশ্যুরেন্স) কতটা জরুরি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি অসুস্থতা, দুর্ঘটনা, ব্যাগ হারানো, ফ্লাইট ক্যানসেল বা জরুরি প্রত্যাবর্তনের মতো অপ্রত্যাশিত খরচ মেটাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অনেকেই এটিকে বাড়তি খরচ মনে করে এড়িয়ে যান, কিন্তু আন্তর্জাতিক ভ্রমণে এটি প্রায় বাধ্যতামূলক এবং দেশীয় ভ্রমণেও অত্যন্ত সুপারিশকৃত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ভ্রমণকারীদের জন্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নির্দেশিকা ও টিকা সংক্রান্ত তথ্য দিয়ে থাকে – গন্তব্য অনুযায়ী সেখানে চেক করুন।
- অপরিহার্য ভ্রমণ ডকুমেন্টস: এই অংশটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর কোনো বিকল্প নেই:
- পাসপোর্ট: মেয়াদ অন্তত ৬ মাস বাকি আছে তো? খালি ভিসা পৃষ্ঠা আছে তো? (অনেক দেশ ২-৪টি ফাঁকা পৃষ্ঠা চায়)। পুরাতন পাসপোর্ট থাকলে সেটিও সাথে রাখুন।
- ভিসা: গন্তব্য দেশের ভিসা প্রয়োজন হলে তা যথাসময়ে, সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংগ্রহ করুন। ভিসা প্রক্রিয়ায় সময় লাগতে পারে – তাড়াহুড়ো করবেন না।
- আইডি কার্ড/জাতীয় পরিচয়পত্র: দেশের ভেতরে ভ্রমণে জাতীয় পরিচয়পত্র বা ড্রাইভিং লাইসেন্স অবশ্যই রাখুন।
- ভ্রমণ বীমা ডকুমেন্টস: পলিসি নম্বর, জরুরি যোগাযোগের নম্বর সহ সমস্ত কাগজ প্রিন্ট আউট করে রাখুন।
- হোটেল বুকিং কনফার্মেশন ও ফ্লাইট/ট্রেন/বাস টিকিট: ই-টিকিটের প্রিন্ট আউট বা মোবাইলে স্ক্রিনশট রাখুন। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকলেও যেন দেখাতে পারেন।
- ড্রাইভিং লাইসেন্স ও আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট (IDP): ভাড়ায় গাড়ি চালাতে চাইলে IDP প্রায় সব দেশেই বাধ্যতামূলক।
- জরুরি যোগাযোগের তথ্য: পরিবারের সদস্য, বীমা কোম্পানি, বাংলাদেশ দূতাবাস/হাইকমিশনের ফোন নম্বর নোট করুন।
- ডকুমেন্টের ফটোকপি ও ডিজিটাল ব্যাকআপ: ভ্রমণের আগে কী কী লাগবে তা জানার মধ্যে ডকুমেন্ট সুরক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ। মূল পাসপোর্ট, ভিসা, বীমা, টিকিট – সবকিছুর ক্লিয়ার ফটোকপি আলাদা ব্যাগে রাখুন। মূল ডকুমেন্ট হারালে বা চুরি গেলে এই কপিগুলো সাহায্য করবে। এছাড়াও, এসব ডকুমেন্টের স্ক্যান কপি নিজের ইমেইলে সেভ করুন এবং ক্লাউড স্টোরেজে (গুগল ড্রাইভ, ড্রপবক্স) আপলোড করুন। ফোনেও সেভ করে রাখুন অফলাইন এক্সেসের জন্য। একটি হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্টের স্ক্যান কপি নতুন পাসপোর্ট ইস্যু করাতে দূতাবাসে অমূল্য সময় বাঁচায়।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা: ভ্রমণের আগে অবশ্যই নিশ্চিত করুন (চিকিৎসা প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা)
ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন জলবায়ু, নতুন খাবার – এসব আপনার শরীরের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। আর নিরাপত্তা তো সর্বত্রই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। এই বিভাগে থাকবে আপনার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা এবং নিরাপদে থাকার প্রস্তুতি।
- চিকিৎসক পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় টিকা: বিশেষ করে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে, আপনার পারিবারিক চিকিৎসক বা ট্রাভেল মেডিসিন বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করুন। আপনার স্বাস্থ্যের অবস্থা, চলমান কোনো অসুস্থতা বা অ্যালার্জি, গন্তব্যের স্বাস্থ্য ঝুঁকি (যেমন ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ইয়েলো ফিভার, টাইফয়েড) এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় টিকা (Vaccinations) বা প্রতিরোধমূলক ওষুধ (যেমন ম্যালেরিয়ার জন্য অ্যান্টি-ম্যালেরিয়াল) সম্পর্কে জেনে নিন। কিছু টিকার ডোজ সম্পূর্ণ হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে – তাই যথেষ্ট সময় হাতে রাখুন। বাংলাদেশে ট্রাভেলার্স ক্লিনিক আছে কিনা খোঁজ নিন।
- ব্যক্তিগত ওষুধের স্টক ও ফার্স্ট এইড কিট: আপনি নিয়মিত কোনো ওষুধ (যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাঁপানি, জন্মনিয়ন্ত্রণ) সেবন করলে, পুরো ভ্রমণকালীন সময়ের চেয়ে কিছু অতিরিক্ত ওষুধ সাথে নিন। ফ্লাইট ডিলে বা ভ্রমণ দীর্ঘায়িত হলে যেন অসুবিধা না হয়। ওষুধের মূল প্যাকেট ও ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অবশ্যই রাখুন। পাশাপাশি, একটি ছোট কিন্তু কার্যকরী ফার্স্ট এইড কিট প্রস্তুত করুন:
- পেইন কিলার (প্যারাসিটামল, আইবুপ্রোফেন)
- অ্যান্টি-হিস্টামিন (অ্যালার্জির জন্য)
- পেট খারাপের ওষুধ (অ্যান্টাসিড, অ্যান্টি-ডায়ারিয়াল)
- মোশন সিকনেসের ওষুধ
- প্লাস্টার, ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম/লোশন (বেটাডিন/স্যাভলন)
- মশা নিরোধক ক্রিম/স্প্রে (ডিইইট সমৃদ্ধ)
- সানস্ক্রিন (উচ্চ SPF)
- নিরাপত্তা সচেতনতা ও ব্যবস্থা:
- স্থানীয় নিয়ম ও সংস্কৃতি: গন্তব্যের স্থানীয় আইন, রীতিনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় অনুভূতি সম্পর্কে আগে থেকেই পড়াশুনা করুন। পোশাক-আশাক, আচার-ব্যবহারে সতর্ক থাকুন। বিশেষ করে নারী ভ্রমণকারীদের জন্য কিছু দেশে পোশাক সংক্রান্ত কড়া নিয়ম থাকে।
- অমূল্য সামগ্রীর সুরক্ষা: মূল ডকুমেন্ট, ক্রেডিট কার্ড, অতিরিক্ত নগদ অর্থ এবং মূল্যবান গহনা হোটেলের সেফটি ডিপোজিট বক্সে রাখুন। বাইরে বেরুলে শুধু প্রয়োজনীয় টাকা ও একটি কার্ড (প্রিপেইড ট্রাভেল কার্ড ভালো) সাথে রাখুন। মানিবেল্ট বা নেক ওয়ালেট ব্যবহার নিরাপদ।
- স্থানীয় জরুরি নম্বর: পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের স্থানীয় জরুরি নম্বর ফোনে সেভ করুন।
- ব্লেন্ড ইন: অতিরিক্ত গয়না বা বাহারি পোশাক পরা এড়িয়ে চলুন। স্থানীয়দের মতো পোশাক পরলে অযথা মনোযোগ আকর্ষণ করবেন না। রাতের বেলা নির্জন এলাকায় একা ঘোরাঘুরি না করাই ভালো।
- ডিজিটাল নিরাপত্তা: পাবলিক Wi-Fi এ ব্যাংকিং বা সেনসিটিভ কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। VPN ব্যবহার করা নিরাপদ। ফোন, ল্যাপটপে পাসওয়ার্ড/পিন/বায়োমেট্রিক লক দিন। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ব্যাকআপ রাখুন।
গন্তব্যের সাথে খাপ খাইয়ে নিন: আবহাওয়া, সংস্কৃতি ও যোগাযোগ (পরিবেশের সাথে অভিযোজন)
আপনি যখন হিমালয়ের কোলে যাচ্ছেন, না কি সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে, না হয়তো কোনও প্রাচীন নগরীর পথে – প্রতিটি গন্তব্যের নিজস্ব আবহাওয়া, সংস্কৃতি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। এই পার্থক্যগুলোকে মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিলে ভ্রমণ হবে আরও আরামদায়ক এবং সমৃদ্ধ।
- আবহাওয়া উপযোগী পোশাক ও গিয়ার: গন্তব্যের আবহাওয়া ও মৌসুম (Season) সম্পর্কে নিখুঁত ধারণা রাখুন। শীত প্রধান দেশে গেলে ভালো মানের উষ্ণ পোশাক, গ্লাভস, টুপি, স্কার্ফ জরুরি। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে হালকা সুতির পোশাক, রেইন গিয়ার বা ছাতা, আরামদায়ক স্যান্ডেল বা স্নিকার্স লাগবে। পাহাড়ি এলাকায় ট্রেকিং করলে উপযুক্ত জুতো (হাইকিং বুট), জলরোধী জ্যাকেট, হ্যাট, সানগ্লাস এবং ট্রেকিং পোলস প্রয়োজন হতে পারে। “ভ্রমণের আগে কী কী লাগবে” জিজ্ঞাসার উত্তরে আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাকের তালিকা শীর্ষে থাকবে। মনে রাখবেন, লেয়ারে পোশাক পরা সবচেয়ে কার্যকর – সহজে খুলে বা যোগ করে তাপমাত্রার সাথে খাপ খাওয়ানো যায়।
- স্থানীয় সংস্কৃতিকে সম্মান ও যোগাযোগের প্রস্তুতি: গন্তব্যের ভাষার কিছু মৌলিক শব্দ বা বাক্যাংশ শিখে নেওয়া (যেমন: হ্যালো, ধন্যবাদ, দাম কত?, সাহায্য করুন, টয়লেট কোথায়?) অমূল্য সাহায্য করবে এবং স্থানীয় মানুষদের সাথে সুসম্পর্ক গড়তে সাহায্য করবে। স্থানীয় রীতিনীতি, বিশেষ করে ধর্মীয় স্থান বা সংবেদনশীল এলাকায় আচরণ সম্পর্কে সচেতন হোন (যেমন: মন্দিরে জুতো খুলে প্রবেশ, মাথা ঢাকা)। স্থানীয় রেস্তোরাঁয় কী খাবেন না খাবেন, তা নিয়ে আগে থেকে ধারণা নিন। খাবার অ্যালার্জি থাকলে তা স্থানীয় ভাষায় লিখে রাখুন বা অ্যাপের সাহায্য নিন।
- যোগাযোগ ও নেভিগেশনের ব্যবস্থা: বাংলাদেশের সিম কার্ডটি রোমিং চালু করে নিন অথবা গন্তব্যে পৌঁছে স্থানীয় সিম কার্ড কিনে নিন। এতে ডেটা ও কল চার্জ অনেক কম পড়বে। গুগল ম্যাপস অফলাইন ম্যাপ ডাউনলোড করে রাখতে পারেন। একটি পাওয়ার ব্যাংক অবশ্যই সাথে রাখুন – ফোন, ক্যামেরার চার্জ দিতে কাজে লাগবে। স্থানীয় পরিবহন ব্যবস্থা (মেট্রো, বাস, রেল, ট্যাক্সি অ্যাপ) সম্পর্কে আগে থেকেই রিসার্চ করুন। ট্যাক্সি বা রিকশায় ওঠার আগে ভাড়া ঠিক করে নিন বা মিটার চালু আছে কিনা দেখুন।
জরুরি অবস্থা ও সমস্যা সমাধানের কৌশল: ভ্রমণের আগে জেনে রাখুন (অপ্রত্যাশিতের জন্য প্রস্তুতি)
ভ্রমণে সবকিছু সবসময় পরিকল্পনা মতো হয় না। ফ্লাইট বাতিল হতে পারে, অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, ব্যাগ হারাতে পারে, বা কোনো দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন। এমন জরুরি অবস্থার (Emergency) জন্য আগে থেকে মানসিক ও ব্যবহারিক প্রস্তুতি নিলে আতঙ্কিত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
- ভ্রমণ বীমার গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত: আগেই বলা হয়েছে, কিন্তু আবারও বলছি – একটি ভালো ট্রাভেল ইনশ্যুরেন্স পলিসি আপনার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা বলয়। নিশ্চিত করুন যে পলিসিটি মেডিকেল ইমার্জেন্সি, হাসপাতালে ভর্তি, মেডিকেল ইভাকুয়েশন, ট্রিপ ক্যানসেলেশন/ইন্টারাপশন, ব্যাগেজ লস/ডেলে, এবং ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা (থার্ড-পার্টি ইনজুরি বা ক্ষতি) কভার করে। পলিসি নম্বর এবং ২৪/৭ হেল্পলাইন নম্বর হাতের কাছে রাখুন।
- অর্থের ব্যাকআপ প্ল্যান: শুধু একটি মাধ্যম (নগদ বা একটি মাত্র কার্ড) এর উপর নির্ভর করবেন না। কিছু নগদ টাকা (স্থানীয় মুদ্রায় ও ইউএস ডলার/ইউরো), একটি ডেবিট কার্ড, একটি ক্রেডিট কার্ড এবং সম্ভব হলে একটি প্রিপেইড ট্রাভেল কার্ড (যেমন ট্রাভেলেক্স, ওয়াইজ) আলাদা আলাদা জায়গায় (ব্যাগ, মানিবেল্ট, হোটেল সেফ) রাখুন। একটি কার্ড ব্লক বা হারিয়ে গেলে অন্যটি ব্যবহার করতে পারবেন। নোট করুন: বাংলাদেশ থেকে বাইরে কার্ড ব্যবহারের অনুমতি (ইন্টারন্যাশনাল ইউজ) চালু আছে কিনা ব্যাংকে জিজ্ঞাসা করুন।
- জরুরি যোগাযোগ ও দূতাবাসের তথ্য: বাংলাদেশ দূতাবাস বা হাইকমিশনের ঠিকানা ও ফোন নম্বর (দুটি ভিন্ন নম্বর) নোট করুন এবং ফোনে সেভ করুন। পরিবারের কারো কাছে আপনার ভ্রমণ তালিকা, ফ্লাইট বিস্তারিত, থাকার জায়গার ঠিকানা এবং দূতাবাসের নম্বর জানিয়ে রাখুন। একটি ছোট নোটে আপনার নাম, রক্তের গ্রুপ, গুরুতর অ্যালার্জি/অসুস্থতা এবং জরুরি যোগাযোগের নম্বর (বাংলাদেশে ও গন্তব্যে) লিখে ব্যাগে বা ওয়ালেটে রাখুন।
- আপনার ইনটুইশনকে বিশ্বাস করুন: যদি কোনো পরিস্থিতি বা ব্যক্তি আপনাকে অস্বস্তি বা অনিরাপদ বোধ করায়, সেখান থেকে দ্রুত সরে আসুন। জোর করে কিছু করবেন না বা অতিরিক্ত ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে বিপদে পড়বেন না। “না” বলতে শিখুন।
শেষ মুহূর্তের চেকলিস্ট: ভ্রমণের আগে কী কী লাগবে তার শেষ বার্তা (একনজরে প্রস্তুতি)
ভ্রমণের আগের রাত বা দিনটি বেশ ব্যস্ততাপূর্ণ হতে পারে। কোনো কিছু যেন বাদ না পড়ে, সেজন্য একটি চূড়ান্ত চেকলিস্ট (Checklist) অনুসরণ করুন। এই তালিকাটি আপনার ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করুন।
- কাগজপত্র: পাসপোর্ট + ভিসা, আইডি কার্ড, ফ্লাইট/ট্রান্সপোর্ট টিকিট (প্রিন্ট/ডিজিটাল), হোটেল বুকিং কনফার্মেশন, ভ্রমণ বীমা কাগজ, ড্রাইভিং লাইসেন্স/আইডিপি (প্রয়োজন হলে), জরুরি যোগাযোগের তালিকা, ফটোকপি সেট (ব্যাগে ও ইমেইলে/ক্লাউডে)।
- অর্থ ও কার্ড: স্থানীয় মুদ্রা, ইউএস ডলার/ইউরো, ডেবিট/ক্রেডিট/ট্রাভেল কার্ড (অন্তত দুটি ভিন্ন), ছোট খরচের জন্য কিছু কয়েন।
- স্বাস্থ্য ও ওষুধ: ব্যক্তিগত নিয়মিত ওষুধ (পর্যাপ্ত মাত্রায় + প্রেসক্রিপশন), ফার্স্ট এইড কিট, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক (প্রয়োজন হলে), মশা নিরোধক, সানস্ক্রিন, টিস্যু পেপার/ওয়েট উইপস, ব্যক্তিগত হাইজিন আইটেম।
- ইলেকট্রনিক্স: মোবাইল ফোন + চার্জার, পাওয়ার ব্যাংক + তার, ক্যামেরা + মেমোরি কার্ড + ব্যাটারি/চার্জার, ইয়ারফোন, ট্রাভেল অ্যাডাপ্টার (বিদেশে গেলে), ল্যাপটপ/ট্যাবলেট (প্রয়োজন হলে) + চার্জার।
- পোশাক ও আনুষাঙ্গিক: আবহাওয়া অনুযায়ী পোশাক (লেয়ারিং এর জন্য), অন্তর্বাস, মোজা, আরামদায়ক হাঁটার জুতো, স্যান্ডেল, রেইন জ্যাকেট/ছাতা, সানগ্লাস, টুপি/স্কার্ফ, সুইমিং কস্টিউম (প্রয়োজন হলে), ছোট ব্যাকপ্যাক/স্লিং ব্যাগ।
- অন্যান্য: পানির বোতল (খালি – এয়ারপোর্টে পানি ভরবেন), স্ন্যাকস (ট্রাভেল ফ্রেন্ডলি), বই/ই-রিডার, ট্রাভেল পিলো/আই মাস্ক (দীর্ঘ যাত্রায়), ছোট তালা (ব্যাগ/হোস্টেল লকারের জন্য), পেন ও নোটপ্যাড।
জেনে রাখুন
ভ্রমণে যাওয়ার আগে কোন কোন কাগজপত্র আবশ্যক?
ভ্রমণের ধরন (দেশি/বিদেশি) ভেদে কাগজপত্র ভিন্ন হয়। বিদেশে গেলে অবশ্যই প্রয়োজন: বৈধ পাসপোর্ট (৬ মাস মেয়াদসহ), প্রয়োজনীয় ভিসা, ভ্রমণ বীমা কাগজ, ফ্লাইট টিকিট, হোটেল বুকিং কনফার্মেশন, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও আইডিপি (গাড়ি চালাতে চাইলে)। দেশের ভেতরে ভ্রমণে জাতীয় পরিচয়পত্র বা ড্রাইভিং লাইসেন্স যথেষ্ট। সব ক্ষেত্রেই মূল ডকুমেন্টের ফটোকপি ও ডিজিটাল স্ক্যান রাখা জরুরি। জরুরি যোগাযোগের নম্বরের তালিকাও সাথে রাখুন।
ভ্রমণ বীমা কেন জরুরি? কী কী কভার করে?
ভ্রমণ বীমা অপ্রত্যাশিত বিপদ আর্থিক সুরক্ষা দেয়। এটি সাধারণত কভার করে: বিদেশে চিকিৎসা ব্যয়, জরুরি মেডিকেল ইভাকুয়েশন, ট্রিপ ক্যানসেলেশন বা ছোট করণ, ফ্লাইট মিস বা বিলম্ব, ব্যাগেজ হারানো বা দেরিতে পৌঁছানো, ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা (কাউকে আঘাত করলে/সম্পত্তির ক্ষতি করলে), এবং জরুরি অবস্থায় পরিবারের সদস্যকে আনার খরচ। বাংলাদেশ থেকে বাইরে ভ্রমণে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, দেশের ভেতরেও সুপারিশকৃত।
ভ্রমণের আগে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কী কী প্রস্তুতি নেওয়া উচিত?
প্রথমত, চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন, বিশেষ করে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে। গন্তব্য অনুযায়ী প্রয়োজনীয় টিকা নিন (যেমন ইয়েলো ফিভার, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস এ/বি) – অনেক টিকার ডোজ সম্পূর্ণ হতে সপ্তাহ লাগে। নিয়মিত ওষুধ পর্যাপ্ত মাত্রায় (ভ্রমণকাল + অতিরিক্ত) ও প্রেসক্রিপশনসহ নিন। একটি ছোট ফার্স্ট এইড কিট (পেইন কিলার, পেটের ওষুধ, অ্যালার্জির ওষুধ, প্লাস্টার, ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক, মশা নিরোধক, সানস্ক্রিন) তৈরি করুন। স্বাস্থ্য সমস্যা ও রক্তের গ্রুপ জরুরি নোটে লিখুন।
টাকা-পয়সা ও কার্ড নিয়ে ভ্রমণের আগে কী সতর্কতা নেবেন?
বিভিন্ন উৎসে অর্থ রাখুন। কিছু স্থানীয় মুদ্রার নগদ, কিছু ইউএস ডলার/ইউরো, একটি ডেবিট কার্ড, একটি ক্রেডিট কার্ড এবং একটি প্রিপেইড ট্রাভেল কার্ড আলাদা আলাদা স্থানে রাখুন। নগদ টাকা মানিবেল্টে বা গোপন পকেটে রাখুন। কার্ডের পিন নম্বর কাউকে বলবেন না, এটিএম ব্যবহারে সতর্ক থাকুন। বাংলাদেশী কার্ডের ইন্টারন্যাশনাল ইউজ চালু আছে কিনা ব্যাংকে জিজ্ঞাসা করুন। অতিরিক্ত মূল্যবান গহনা বা নগদ অর্থ হোটেল সেফে রাখুন।
প্যাকিং করার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টিপস কী কী?
আবহাওয়া ও ভ্রমণের ধরন অনুযায়ী পোশাক বেছে নিন (লেয়ারিং সর্বোত্তম)। আরামদায়ক হাঁটার জুতো অপরিহার্য। তরল পণ্য (শ্যাম্পু, লোশন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার) ছোট বোতলে (১০০মিলি এর কম) রাখুন এবং প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে হ্যান্ড ব্যাগে দিন। মূল্যবান জিনিস (ইলেকট্রনিক্স, জুয়েলারি, ওষুধ, ডকুমেন্ট) হ্যান্ড ব্যাগে রাখুন। লাইটার বা ক্ষুরের ব্লেড চেকড ব্যাগে রাখুন। একটি ছোট ডে-ব্যাক ব্যাগ দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য রাখুন। লেবেল লাগানো ব্যাগ চিনতে সুবিধা হবে।
বিদেশ ভ্রমণে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভূমিকা কী? কীভাবে যোগাযোগ করব?
বাংলাদেশ দূতাবাস বা হাইকমিশন বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের সাহায্য করে। পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে, গুরুতর অসুস্থতা বা দুর্ঘটনায় পড়লে, আটকে গেলে বা অন্য কোনো জরুরি আইনি সমস্যায় দূতাবাস সহায়তা করতে পারে। ভ্রমণের আগে গন্তব্য দেশের দূতাবাসের ঠিকানা, ফোন নম্বর (ল্যান্ডলাইন ও ইমার্জেন্সি), ইমেইল এবং ওয়েবসাইট নোট করুন। সমস্যা দেখা দিলে সরাসরি ফোন করে বা দূতাবাসে গিয়ে সাহায্য চাইতে পারেন।
ভ্রমণ শুধু একটি গন্তব্যে পৌঁছানো নয়; এটি আবিষ্কারের যাত্রা, নতুন অভিজ্ঞতার সমাহার, এবং নিজের সীমাকে চেনার সুযোগ। কিন্তু এই যাত্রা তখনই আনন্দময় ও স্মরণীয় হয় যখন আমরা সঠিকভাবে প্রস্তুত থাকি। “ভ্রমণের আগে কী কী লাগবে” এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে নেওয়া এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি সম্পন্ন করা আপনার এই যাত্রাকে নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং সম্পূর্ণ উদ্বেগমুক্ত করে তুলবে। কাগজপত্রের সঠিকতা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়ানো, স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং জরুরি পরিস্থিতির জন্য মানসিক প্রস্তুতি – প্রতিটি ধাপই সমান গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন, একটি ভালো ভ্রমণ বীমা পলিসি এবং জরুরি যোগাযোগের তথ্য আপনার নিরাপত্তার বলয়। আপনার ব্যাগপ্যাকিং শেষ করুন, চেকলিস্টটি টিক দিন, এবং নিজেকে এই অনন্য অভিজ্ঞতার জন্য প্রস্তুত করুন। সতর্কতা ও প্রস্তুতি কখনো ভ্রমণের আনন্দকে কমায় না; বরং তা নিশ্চিত করে যে প্রতিটি মুহূর্ত আপনি নির্ভারভাবে উপভোগ করতে পারবেন। তাহলে আর দেরি কেন? আপনার পরবর্তী অ্যাডভেঞ্চারের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিন আজই!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।