একটি সূর্যোদয়ের লালিমায় ঢাকা পাহাড়ি রাস্তা। জানালার পাশে বসে আছেন আপনি। কিন্তু গত রাতে বিমানবন্দরের অস্বাস্থ্যকর খাবার, আর দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে মাথা যেন ফাটছে, পেট মোচড় দিচ্ছে। সেই অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করার বদলে আপনি শুধু ভাবছেন, “কখন পৌঁছাবো হোটেলে শুয়ে পড়তে?” এই পরিচিত দৃশ্যপট কতবার আমাদের ভ্রমণের স্বাদ মাটি করে দিয়েছে! নতুন জায়গার উদ্দীপনা, অজানার রোমাঞ্চ – সবই ম্লান হয়ে যায় যখন শরীর বলতে শুরু করে, “ব্যস, থামো!” ভ্রমণ মানেই কিন্তু শারীরিক ও মানসিক চাপের মুখোমুখি হওয়া। জলবায়ুর পরিবর্তন থেকে শুরু করে অপরিচিত খাবার, অনিয়মিত ঘুম, দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি – নানান উপাদান মিলে আমাদের দেহ-মনকে ক্লান্ত করে তোলে। কিন্তু একটু সচেতন প্রস্তুতি আর কিছু সহজ ভ্রমণের সময় শরীর ঠিক রাখার উপায় মেনে চললেই এই চাপকে জয় করে সুস্থ, প্রাণবন্ত ও আনন্দময় ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করা সম্ভব। আসুন, জেনে নেই সেই বিজ্ঞানসম্মত ও ব্যবহারিক কৌশলগুলো, যেগুলো আপনার পরবর্তী যাত্রাকে করবে আরও মসৃণ ও স্মরণীয়।
ভ্রমণের সময় শরীর ঠিক রাখার উপায়: যাত্রাপথের শুরুতেই সতর্কতা
ভ্রমণের সুস্থতা নিশ্চিত করার লড়াই শুরু হয় যাত্রা শুরুর আগেই। সঠিক প্রস্তুতি না নিলে যাত্রাপথেই নেমে আসতে পারে বিপত্তি। এই প্রাথমিক প্রস্তুতিই আপনার ভ্রমণের ভিত্তি গড়ে দেবে।
গন্তব্যের স্বাস্থ্য ঝুঁকি গবেষণা: কোথায় যাচ্ছেন, সেখানকার বর্তমান স্বাস্থ্য পরিস্থিতি কী? মশাবাহী রোগ (ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া), খাবার-পানির মাধ্যমে ছড়ানো রোগ (টাইফয়েড, হেপাটাইটিস এ), বা কোনো বিশেষ স্বাস্থ্য সতর্কতা আছে কি না, তা জেনে নিন অবশ্যই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ট্রাভেলার্স হেলথ সেকশন বা বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (IEDCR) ওয়েবসাইট (https://iedcr.gov.bd/) নির্দেশিকা দেখুন। প্রয়োজনে টিকা নিন (যেমন: হেপাটাইটিস এ, টাইফয়েড, ইয়েলো ফিভার নির্দিষ্ট কিছু দেশে)।
ভ্রমণ স্বাস্থ্যবিমা: অদৃশ্য নিরাপত্তা কভার: এটি কোনো বিলাসিতা নয়, বরং অপরিহার্য। দেশে বা বিদেশে দুর্ঘটনা, আকস্মিক অসুস্থতা বা জরুরি চিকিৎসার খরচ ভয়াবহ হতে পারে। এমন একটি পলিসি নিন যা জরুরি চিকিৎসা, হাসপাতালে ভর্তি, এমনকি মেডিকেল ইভাকুয়েশনকেও কভার করে। বিমা কিনে নিশ্চিত হোন যে এটি আপনার গন্তব্যে বৈধ ও কার্যকর। এই সতর্কতা ভ্রমণের সময় শরীর ঠিক রাখার উপায় গুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
প্রাথমিক চিকিৎসা কিট: আপনার ছোট্ট ভ্রমণ হাসপাতা: একটি পোর্টেবল ফার্স্ট এইড কিট প্যাক করা অত্যন্ত জরুরি। তাতে কী কী রাখবেন?
- জরুরি ওষুধ: প্যারাসিটামল/অ্যাসপিরিন (ব্যথা-জ্বর), অ্যান্টিহিস্টামিন (এলার্জি, মোশন সিকনেস), লোপেরামাইড/ওআরএস (ডায়রিয়া), অ্যান্টাসিড (অম্বল), ব্যান্ডেজ, প্লাস্টার, অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম/লোশন, মশা নিরোধক ক্রিম/স্প্রে, সানস্ক্রিন (SPF 30+), ব্যক্তিগত প্রেসক্রিপশনের ওষুধ (যথেষ্ট পরিমাণে, মূল প্যাকেটে)।
- ব্যবহারিক জিনিস: থার্মোমিটার, টুইজার, কাঁচি, সেফটি পিন, স্যালাইন ড্রপ (চোখ ধোয়া/কন্টাক্ট লেন্সের জন্য)।
- বিশেষ টিপস: প্রেসক্রিপশনের ওষুধগুলো মূল কাগজের প্যাকেটে রাখুন। ডাক্তারের একটি প্রেসক্রিপশন কপি (ইংরেজিতে) সাথে রাখুন, বিশেষ করে যদি সেগুলো নিয়ন্ত্রিত ওষুধ হয় (যেমন: ব্যথানাশক, ঘুমের ওষুধ)।
- চিকিৎসা তথ্য সহজলভ্য করুন: আপনার গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য তথ্য (রক্তের গ্রুপ, গুরুতর অ্যালার্জি, দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, চলমান ওষুধের তালিকা) একটি কার্ডে বা ফোনে (ইমার্জেন্সি মেডিকেল আইডি হিসেবে) সেভ করে রাখুন। ইংরেজিতে লিখুন। প্রিয়জনকে আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা ও গুরুত্বপূর্ণ কন্টাক্ট নাম্বার জানিয়ে রাখুন।
ভ্রমণের সময় শরীর ঠিক রাখার উপায়: যাত্রাপথে সুস্থতার কৌশল
এবার আসি যাত্রাপথের নিজস্ব চ্যালেঞ্জের কথায়। গাড়ি, ট্রেন, বাস বা বিমান – প্রতিটিরই নিজস্ব স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে। এই ধাপে সতর্কতা আপনাকে গন্তব্যে তুলনামূলক সুস্থ ও সতেজ পৌঁছে দেবে।
জলবায়ু অভিযোজন: শরীরকে মানিয়ে নিতে দিন: গরম বা আর্দ্র জায়গা থেকে হঠাত ঠাণ্ডা বা শুষ্ক স্থানে গেলে শরীরে চাপ পড়ে। ভ্রমণের সময় শরীর ঠিক রাখার উপায় গুলোর মধ্যে এটি প্রায়ই উপেক্ষিত হয়।
- আস্তে আস্তে শুরু করুন: প্রথম দিন বা দু’দিন খুব বেশি কসরত (ট্রেকিং, দীর্ঘ ট্যুর) এড়িয়ে চলুন। শরীরকে নতুন তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সময় দিন।
- সান প্রোটেকশন অপরিহার্য: রোদে বের হলে মাথা ঢাকুন (টুপি, স্কার্ফ), সানগ্লাস ব্যবহার করুন, এবং SPF 30 বা তার বেশি সানস্ক্রিন মুখ, কান, ঘাড়, হাত-পায়ে নিয়মিত (২-৩ ঘন্টা পর পর) লাগান। সানবার্ন শুধু অস্বস্তিকরই নয়, তা ডিহাইড্রেশন ও হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর এর ওয়েবসাইট থেকে স্থানীয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে নিন।
- ঠাণ্ডা আবহাওয়ার জন্য: স্তর করে পোশাক পরুন (লেয়ারিং) যাতে প্রয়োজনে কাপড় কমবেশি করতে পারেন। শুষ্ক বাতাস গলা ও ত্বক শুষ্ক করে ফেলে, তাই ময়েশ্চারাইজার ও লিপ বাম ব্যবহার করুন।
খাদ্য ও পানীয়: সতর্কতাই সুরক্ষা: ভ্রমণে অসুস্থ হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল খাদ্য ও পানিজনিত সমস্যা (‘ট্রাভেলার্স ডায়রিয়া’)। এই ভ্রমণের সময় শরীর ঠিক রাখার উপায় টি মেনে চললে ঝুঁকি কমবে অনেকটাই।
- পানি: সবসময় বোতলজাত সিলমোহর করা পানি পান করুন। রেস্তোরাঁয় বরফ এড়িয়ে চলুন (কারণ তা ট্যাপের পানি দিয়ে বানানো হতে পারে)। দাঁত ব্রাশ করতেও বোতলজাত পানি ব্যবহার করুন। তাজা ফলের রস নিলে দেখে নিন তা আপনার সামনে বানানো হচ্ছে কিনা।
- খাবার: “সেদ্ধ করা, রান্না করা, ছাড়া করা – না হলে ভুলে যাওয়া” (Boil it, Cook it, Peel it – or Forget it) এই নীতি মেনে চলুন। রাস্তার পাশের দোকানের কাটা ফল, সালাদ (যা ধোয়া পানি দিয়ে ধোয়া হয়েছে কিনা নিশ্চিত নন), কাঁচা শাকসবজি, আধা সিদ্ধ মাছ-মাংস, এবং ডেইরি প্রোডাক্ট (যা পাস্তুরিত নয়) এড়িয়ে চলুন। গরম গরম, ভালোভাবে সেদ্ধ খাবার নিরাপদ। হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন (সাবান-পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে) প্রতিবার খাওয়ার আগে।
মোশন সিকনেস: যাত্রায় ভারসাম্য ফেরানো: গাড়ি, নৌকা বা উড়োজাহাজে বমিভাব, মাথাঘোরা, ঘাম হওয়া খুব সাধারণ সমস্যা।
- দৃষ্টি স্থির করুন: সামনের দিকে (যাত্রাপথের দিকে) তাকান। মোবাইল ফোন বা বই পড়া এড়িয়ে চলুন। উইন্ডোর পাশের সিট বেছে নিন এবং বাইরের দিকে স্থির কোনো বিন্দুতে (যেমন দিগন্ত) তাকান।
- বাতাস চলাচল: পর্যাপ্ত তাজা বাতাস ঢুকতে দিন। গাড়ির সামনের সিটে বসুন। উড়োজাহাজে উইন্ডোর পাশের সিট নিলে দিগন্ত দেখতে পাবেন।
- হালকা খাবার: যাত্রার আগে ভারী, তেলেভাজা বা ঝাল খাবার এড়িয়ে চলুন। হালকা, শুকনো খাবার (ক্র্যাকার্স, টোস্ট) খেতে পারেন।
- ওষুধ: প্রয়োজনে যাত্রার ৩০-৬০ মিনিট আগে অ্যান্টিহিস্টামিন (যেমন ডাইমেনহাইড্রিনেট) জাতীয় ওটিসি ওষুধ খেতে পারেন (ঘুম পাড়ানোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে)। প্রাকৃতিক উপায় হিসেবে আদা চিবানো বা আদার ক্যান্ডিও কার্যকর হতে পারে।
দীর্ঘ যাত্রায় রক্ত চলাচল: ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস (ডিভিটি) প্রতিরোধ: বিশেষ করে বিমানে বা বাসে ৪ ঘন্টার বেশি বসে থাকলে পায়ে রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বাড়ে।
- নিয়মিত নড়াচড়া: প্রতি ১-২ ঘন্টায় একবার উঠে হাঁটুন (যদি সম্ভব হয়)। বসে থাকা অবস্থায় পায়ের ব্যায়াম করুন – গোড়ালি ঘুরানো, পায়ের আঙুল ওপর-নিচ করা, হাঁটু বাঁকা করে বুকে টেনে ধরা।
- আরামদায়ক পোশাক: ঢিলেঢালা, আরামদায়ক কাপড় পরুন। টাইট জিন্স বা বেল্ট এড়িয়ে চলুন।
- সংকোচন মোজা: যাদের আগে ডিভিটি হয়েছে, স্থূলতা আছে, গর্ভবতী, বা হরমোন থেরাপি নিচ্ছেন, তাদের জন্য ডাক্তারের পরামর্শে কম্প্রেশন স্টকিংস ব্যবহার করা যেতে পারে।
- হাইড্রেশন: প্রচুর পানি পান করুন। অ্যালকোহল ও ক্যাফেইন সীমিত করুন (এগুলো ডিহাইড্রেশন বাড়ায়)।
- ঘুম ও বিশ্রাম: শক্তির রিচার্জিং: ভ্রমণে ঘুমের ধারা বিঘ্নিত হয়, যা ক্লান্তি, বিরক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
- নিয়মিত রুটিন: গন্তব্যে পৌঁছে যত দ্রুত সম্ভব স্থানীয় সময়ের সাথে নিজেকে সামঞ্জস্য করে নিন। দিনের বেলা প্রাকৃতিক আলোতে কিছু সময় কাটান (এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়িকে রিসেট করতে সাহায্য করে)।
- ঘুমের পরিবেশ: আইমাস্ক, ইয়ারপ্লাগ (নয়েজ ক্যানসেলিং হেডফোনও ভালো) এবং আপনার নিজের বালিশের কভার নিয়ে যেতে পারেন। ঘুমানোর আগে ভারী খাবার, ক্যাফেইন ও অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন। রিল্যাক্সেশন টেকনিক (গভীর শ্বাস, হালকা মেডিটেশন) সাহায্য করতে পারে।
- ছোট ছোট বিশ্রাম: দিনের বেলায় খুব ক্লান্ত লাগলে ২০-৩০ মিনিটের পাওয়ার ন্যাপ নিন। দীর্ঘক্ষণ ঘুমাবেন না, তা না হলে রাতে ঘুম আসবে না।
ভ্রমণের সময় শরীর ঠিক রাখার উপায়: গন্তব্যে পৌঁছে ও ফিরে আসার পর
গন্তব্যে পৌঁছানো মানেই সতর্কতার অবসান নয়। স্থানীয় পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া এবং ফিরে আসার পরের যত্নও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
জেট ল্যাগ কমানোর কৌশল: সময়ের সাথে তাল মেলানো: দ্রাঘিমাংশ পার হওয়া মানেই শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি (সার্কাডিয়ান রিদম) এলোমেলো হয়ে যাওয়া। এই ভ্রমণের সময় শরীর ঠিক রাখার উপায় টি বিশেষ করে দীর্ঘ দূরত্বের ভ্রমণকারীদের জন্য জরুরি।
- আগে থেকেই প্রস্তুতি: যদি সম্ভব হয়, ভ্রমণের কয়েক দিন আগে থেকেই ধীরে ধীরে গন্তব্যের সময়ের সাথে আপনার খাওয়া-ঘুমানোর সময় সামঞ্জস্য করে নিন (একটু একটু করে সময় পরিবর্তন করুন)।
- প্রাকৃতিক আলো: গন্তব্যে পৌঁছানোর পর দিনের আলোতে বের হন। সকালের আলো ঘুমের হরমোন মেলাটোনিন কমাতে সাহায্য করে এবং শরীরকে নতুন সময়ের সাথে মানিয়ে নিতে উৎসাহিত করে। সন্ধ্যার পর উজ্জ্বল আলো (বিশেষ করে নীল আলো, যেমন ফোন/ল্যাপটপ স্ক্রিন) এড়িয়ে চলুন।
- মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট: কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শে স্বল্পমেয়াদি মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট (যাত্রার দিন ও পরের কয়েক দিন) সাহায্য করতে পারে। তবে প্রথমে ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
- ধৈর্য ধরুন: শরীরকে মানিয়ে নিতে সাধারণত প্রতি ঘণ্টার সময় পার্থক্যের জন্য এক দিন সময় লাগে। নিজের উপর চাপ নেবেন না।
ব্যায়াম ও সক্রিয়তা: শক্তি ও মন ভালো রাখা: ভ্রমণ মানেই শুধু দর্শনীয় স্থান দেখা নয়, শরীরকে সচল রাখাও জরুরি।
- হাঁটা হাঁটা: নতুন জায়গা ঘুরে দেখার সবচেয়ে ভালো ও স্বাস্থ্যকর উপায় হল পায়ে হেঁটে। এটি রক্ত চলাচল বাড়ায়, মানসিক চাপ কমায় এবং স্থানীয় পরিবেশের সাথে সংযোগ ঘটায়।
- সরল ব্যায়াম: হোটেল রুমে বা পার্কে ১৫-২০ মিনিটের জন্য স্ট্রেচিং, যোগব্যায়াম, বা বডিওয়েট এক্সারসাইজ (স্কোয়াট, লাঞ্জ, পুশ-আপ) করতে পারেন। অনেক হোটেলে জিম থাকে। স্থানীয় পার্কে সকালের হাঁটায় যোগ দিতে পারেন।
- সাঁতার: যদি সুযোগ থাকে, সাঁতার কাটা ভ্রমণে দারুণ একটি ব্যায়াম এবং রিল্যাক্সেশনের উপায়।
মানসিক সুস্থতা: চাপমুক্ত ভ্রমণ: ভ্রমণে মানসিক চাপও শরীরের উপর প্রভাব ফেলে। এই ভ্রমণের সময় শরীর ঠিক রাখার উপায় টি প্রায়ই উপেক্ষিত হয়।
- বাস্তবসম্মত প্রত্যাশা: সবকিছু নিখুঁত হবে এমন আশা করবেন না। বিমান বিলম্ব, হারিয়ে যাওয়া, ভাষাগত বাধা – এসব ঘটতেই পারে। ধৈর্য ধরুন এবং সমস্যাকে অভিযোজনের অংশ হিসেবে নিন।
- একা সময়: ভ্রড়মণ দলবদ্ধ হলেও নিজের জন্য কিছু একা সময় বের করুন। বই পড়ুন, ডায়েরি লিখুন, বা শুধু বসে প্রকৃতি উপভোগ করুন।
- সংযোগ রাখুন: প্রিয়জনের সাথে মেসেজ বা ভিডিও কলের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখুন। এটি একাকিত্ব দূর করতে সাহায্য করে।
- নেই বলুন: খুব ক্লান্ত লাগলে বা অসুস্থ বোধ করলে কিছু প্রোগ্রাম বাদ দিতে দ্বিধা করবেন না। জোর করে কিছু করবেন না। বিশ্রামও ভ্রমণের অংশ।
- ফিরে আসার পরের যত্ন: ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফিরলেই শরীরের দায়িত্ব শেষ নয়।
- আরও বিশ্রাম: ভ্রমণের ক্লান্তি কাটতে একটু সময় লাগে। ফিরে আসার পরের দিন বা দু’দিন হালকা রাখুন, পর্যাপ্ত ঘুমান।
- লক্ষণ নজরে রাখুন: ভ্রমণের কয়েক সপ্তাহ বা মাস পরেও অসুস্থতা দেখা দিতে পারে (যেমন: ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, পাকস্থলীর সমস্যা)। জ্বর, ঠাণ্ডা-কাশি, ডায়রিয়া, র্যাশ বা অন্য কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তার দেখান এবং আপনার ভ্রমণের ইতিহাস জানান।
- হাইড্রেশন ও পুষ্টি: ভ্রমণ শেষে শরীরকে আবার সুস্থ করতে প্রচুর পানি ও পুষ্টিকর খাবার খান।
বিশেষ পরিস্থিতিতে ভ্রমণের সময় শরীর ঠিক রাখার উপায়
সব ভ্রমণকারী সমান নয়। কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা প্রয়োজন।
শিশুদের সাথে ভ্রমণ:
- স্বাস্থ্য পরিকল্পনা: ভ্রমণের আগে শিশুকে শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান। প্রয়োজনীয় টিকা/বুস্টার ডোজ নিশ্চিত করুন। শিশুর চিকিৎসা ইতিহাস, ওষুধের তালিকা ও ডাক্তারের কন্টাক্ট নম্বর সাথে রাখুন।
- ওষুধ ও জিনিসপত্র: শিশুর সকল ওষুধ (প্রচুর পরিমাণে), প্রেসক্রিপশন, জ্বর-ব্যথার ওষুধ, ওআরএস, নাকের ড্রপ, ন্যাপি র্যাশ ক্রিম, প্রিয় খেলনা/বই, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ওয়েট উইপস, অতিরিক্ত কাপড়-চোপড় প্যাক করুন।
- যাত্রাপথে: বিমান/গাড়িতে টেক-অফ ও ল্যান্ডিংয়ের সময় বুকের দুধ খাওয়ানো বা চুষনি (প্যাসিফায়ার) দিলে কানে চাপ কমে। হাঁটাচলার সুযোগ দিন। খাবার-পানি নিয়ে সতর্কতা বড়দের মতোই। শিশুকে হাইড্রেটেড রাখুন।
- সুরক্ষা: নতুন পরিবেশে শিশুকে কাছাকাছি রাখুন। পরিচয় চিহ্ন (নাম, ফোন নম্বর লেখা ব্রেসলেট/কার্ড) পরিয়ে দিন। স্থানীয় জরুরি নম্বর জেনে রাখুন।
গর্ভবতী মহিলাদের ভ্রমণ:
- ডাক্তারের অনুমতি: ভ্রমণের আগে অবশ্যই আপনার গাইনোকোলজিস্ট/ধাত্রীর সাথে পরামর্শ করুন এবং লিখিত অনুমতি নিন। সাধারণত দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার (১৪-২৮ সপ্তাহ) ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ বলে বিবেচিত হয়।
- গন্তব্য নির্বাচন: উচ্চতা, মশাবাহী রোগপ্রবণ অঞ্চল, উন্নত চিকিৎসা সুবিধার অভাব এমন স্থান এড়িয়ে চলুন। ভ্রমণের ধরন (যেমন: অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর) সামঞ্জস্য করুন।
- যাত্রাপথে: গাড়িতে সিটবেল্ট পেটের নিচে ও কোমরের উপর লাগান। বিমানে অ্যাইলে সিট নিন (স্পেস বেশি, উঠে হাঁটার সুবিধা)। প্রতি ৩০ মিনিটে উঠে হাঁটুন। হাইড্রেশন বজায় রাখুন। আরামদায়ক পোশাক ও জুতো পরুন।
- কাগজপত্র: প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট ও ডাক্তারের অনুমতিপত্র সবসময় সাথে রাখুন।
- দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্তদের ভ্রমণ: (ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি)
- ডাক্তারের পরামর্শ: ভ্রমণের আগে বিশেষজ্ঞের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করুন। ওষুধের ডোজ সামঞ্জস্যের প্রয়োজন হতে পারে। একটি ফিট-টু-ট্রাভেল সার্টিফিকেট নিতে বলুন।
- ঔষধের প্রাচুর্যতা: প্রয়োজনীয় ওষুধ ভ্রমণের সময়ের চেয়ে অন্তত এক সপ্তাহ বেশি পরিমাণে, মূল প্যাকেটে নিয়ে যান। কিছু ওষুধ আলাদা ব্যাগে (হ্যান্ড ব্যাগে) রাখুন। প্রেসক্রিপশনের কপি (ইংরেজিতে) রাখুন।
- নিয়মিত মনিটরিং: ব্লাড সুগার লেভেল, ব্লাড প্রেশার ইত্যাদি নিজেই মনিটর করার যন্ত্রপাতি সাথে নিন। ডায়েরিতে লিখে রাখুন।
- খাদ্যাভ্যাস: স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নেওয়ার চেষ্টা করুন। ডায়াবেটিস রোগীরা সময়মতো খাবার খাওয়া ও হাইড্রেশনে বিশেষ নজর দিন।
জেনে রাখুন
প্রশ্নঃ লম্বা ফ্লাইটে পা ফুলে যাওয়া বা ব্যথা প্রতিরোধের উপায় কী?
উত্তরঃ প্রতি ১-২ ঘন্টা পরপর সিট থেকে উঠে কেবিনে কিছুক্ষণ হাঁটুন। বসে থাকা অবস্থায় পায়ের ব্যায়াম করুন – গোড়ালি ঘোরানো, পায়ের আঙুল নাড়ানো, হাঁটু বুকের দিকে টানা। ঢিলেঢালা পোশাক পরুন। প্রচুর পানি পান করুন, অ্যালকোহল ও ক্যাফেইন কম খান। উচ্চ ঝুঁকিতে থাকলে (পূর্বে ডিভিটি, গর্ভাবস্থা) ডাক্তারের পরামর্শে কম্প্রেশন স্টকিংস ব্যবহার করতে পারেন।প্রশ্নঃ ভ্রমণে ডায়রিয়া হলে সাথে সাথে কী করব?
উত্তরঃ সবার আগে প্রচুর তরল খান, বিশেষ করে ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট (ওআরএস) মিশ্রিত পানি। হালকা, নরম খাবার খান (ভাত, কলা, টোস্ট, সিদ্ধ আলু)। লোপেরামাইড জাতীয় ওষুধ শুধুমাত্র জরুরি অবস্থায় (যেমন: বাসে যেতে হবে) ব্যবহার করুন, এটি সংক্রমণ আটকায় না। যদি রক্তপাত, উচ্চ জ্বর (১০১°F/৩৮.৩°C এর বেশি), তীব্র পেটব্যথা, বা ডিহাইড্রেশন লক্ষণ (প্রস্রাব কম, দুর্বলতা) দেখা দেয়, অবশ্যই ডাক্তার দেখান।প্রশ্নঃ গরম দেশে ভ্রমণের সময় হিট স্ট্রোক এড়াতে কী করব?
উত্তরঃ প্রচুর পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট যুক্ত পানীয় (ডাবের পানি, স্পোর্টস ড্রিংক – তবে চিনি কম আছে এমন) পান করুন। সরাসরি রোদ এড়িয়ে চলুন, বিশেষ করে দুপুর ১১টা থেকে বিকেল ৩টা। হালকা রঙের, সুতি ঢিলেঢালা পোশাক পরুন। টুপি, সানগ্লাস ও উচ্চ SPF সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন। কড়া রোদে অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম করা থেকে বিরত থাকুন। মাথাঘোরা, বমিভাব, ত্বক শুষ্ক ও গরম লাগলে দ্রুত ছায়ায় যান, শরীরে পানি দিন ও চিকিৎসা নিন।প্রশ্নঃ ভ্রমণে কোন ওষুধগুলো অবশ্যই সাথে নেবো?
উত্তরঃ ব্যক্তিগত প্রেসক্রিপশনের ওষুধ (ঢিলের চেয়ে বেশি), জ্বর-ব্যথার ওষুধ (প্যারাসিটামল/আইবুপ্রোফেন), পেটের ওষুধ (অ্যান্টাসিড, অ্যান্টিহিস্টামিন – এলার্জি ও মোশন সিকনেসের জন্য, লোপেরামাইড – জরুরি ডায়রিয়ার জন্য, ওআরএস), অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম/লোশন, প্লাস্টার-ব্যান্ডেজ, মশা নিরোধক, সানস্ক্রিন। প্রয়োজনে ঘুমের সহায়ক ওষুধ (ডাক্তারের পরামর্শে)।- প্রশ্নঃ ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরার পর অসুস্থ হলে কী করব?
উত্তরঃ ভ্রমণ শেষ হওয়ার পর কয়েক সপ্তাহ বা মাসেও অসুস্থতা (বিশেষ করে জ্বর) দেখা দিতে পারে। ডাক্তার দেখানোর সময় অবশ্যই জানান যে আপনি সম্প্রতি কোথায় ভ্রমণ করে এসেছেন (দেশ/অঞ্চলের নাম উল্লেখ করুন) এবং সেখানে কী কী করেছেন (যেমন: জঙ্গলে গিয়েছিলেন, অপরিশোধিত পানি পান করেছিলেন ইত্যাদি)। এটি ডাক্তারকে সঠিক রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করবে (যেমন: ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, টাইফয়েড ইত্যাদি)।
ভ্রমণ জীবনের রঙিন অভিজ্ঞতা, কিন্তু সেই আনন্দ তখনই পূর্ণতা পায় যখন আমরা সুস্থ ও প্রাণবন্ত থাকি। নতুন স্থান, নতুন মানুষ, নতুন স্বাদের সাথে পরিচয় হওয়ার সেই রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলোকে অসুস্থতার ছায়া যেন ম্লান করে দিতে না পারে, সেজন্য ভ্রমণের সময় শরীর ঠিক রাখার উপায় সম্পর্কে সচেতনতা ও প্রস্তুতি একান্তই জরুরি। যাত্রাপথের আগে-পরে ও গন্তব্যে এই সহজ কিন্তু কার্যকর টিপসগুলো মেনে চললে – সঠিক খাদ্য ও পানি নির্বাচন, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম, জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া, দীর্ঘ যাত্রায় সচল থাকা এবং মানসিক চাপ কমানোর মাধ্যমে – আপনি আপনার পরবর্তী যাত্রাকে করে তুলতে পারেন আরও সুরক্ষিত, আরও আরামদায়ক এবং সত্যিকার অর্থেই স্মরণীয়। আপনার সুস্থতা আপনার হাতে – এবারের ভ্রমণে এই টিপসগুলোকে সঙ্গী করুন, নিরাপদ ও আনন্দময় ভ্রমণ করুন!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।