গতিশীল ঢাকার হাই-রাইজ অফিসে বসে রাইসুল ইসলামের চোখ স্ক্রিনে, কিন্তু মন কোথায়? ডেডলাইনের চাপ, নোটিফিকেশনের কর্কশ শব্দ, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা – সব মিলিয়ে তার মনোযোগ ছিন্নভিন্ন। হঠাৎই চোখ পড়ল ক্যালেন্ডারে চিহ্নিত জুমার নামাজের সময়ের ওপর। মসজিদে গিয়ে জামাতে দাঁড়াতেই যেন এক অদৃশ্য ভার নামল হৃদয় থেকে। আজানের ধ্বনি, কুরআনের তিলাওয়াত, দীর্ঘ সিজদা – প্রতিটি মুহূর্ত তাকে টেনে আনল বর্তমানে। নামাজ শেষে ফেরার পথে তার মনে হলো, এই তো! মনোযোগ বাড়ানোর ইসলামিক উপায় খুঁজছিলাম, তা তো এই নামাজের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। রাসূল (সা.) যেমন বলেছেন, “নিশ্চয়ই নামাজের মধ্যে শান্তি ও প্রশান্তি রয়েছে।” (সহীহ মুসলিম)। আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে, যেখানে মনোযোগের সংকট মহামারীর আকার ধারণ করেছে, ইসলাম আমাদের হৃদয় ও মস্তিষ্ককে কেন্দ্রীভূত করার জন্য শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক কাঠামো দেয়। এই উপায়গুলো শুধু ইবাদতের ক্ষেত্রেই নয়, দৈনন্দিন কাজ, পড়াশোনা, পেশাগত জীবনে অসামান্য একাগ্রতা ও শান্তি এনে দেয় – যেন অন্তরের শোরগোল থেমে যায়, আর মস্তিষ্ক খুঁজে পায় তার হারানো তীক্ষ্ণতা। আসুন, আবিষ্কার করি সেই পথ, যেখানে ইমান ও বিজ্ঞান মিলেমিশে একাকার হয়ে আমাদের মনকে করে তোলে সুদৃঢ়, কর্মে করে সফল।
মনোযোগ বাড়ানোর ইসলামিক উপায়: কেন এটি সময়ের সবচেয়ে জরুরি চাহিদা?
আজকের হাই-স্পিড, হাই-প্রেশার লাইফস্টাইলে মনোযোগের ঘাটতি শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়; এটি সামাজিক উৎপাদনশীলতা, মানসিক স্বাস্থ্য এমনকি পারিবারিক বন্ধনের জন্যও হুমকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ADHD বা মনোযোগের ঘাটতিজনিত সমস্যা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। কিন্তু ইসলাম এই সমস্যার সমাধানকে দেখে শুধু ক্লিনিক্যাল লেন্সে নয়, হোলিস্টিক (সমন্বিত) দৃষ্টিকোণ থেকে। মনোযোগ বাড়ানোর ইসলামিক পদ্ধতিগুলো শুধু কার্যকরী টেকনিক নয়; এগুলো জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়।
- ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি: ইসলামে মনোযোগ বা “হুযূর আল-কল্ব” (হৃদয়ের উপস্থিতি) কে ইবাদতের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইহইয়া উলুমিদ্দিন’-এ ব্যাখ্যা করেছেন, নামাজ, দোয়া বা জিকিরে পূর্ণ মনোযোগ না থাকলে তা কেবল শারীরিক ক্রিয়া মাত্র, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ হয় না। এই একাগ্রতা শুধু ইবাদতে সীমাবদ্ধ নয় – এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রসারিত।
- বৈজ্ঞানিক সমর্থন: আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান গবেষণায় দেখা গেছে, ইসলামিক প্র্যাকটিস যেমন নিয়মিত ধ্যানমূলক প্রার্থনা (নামাজ), রোজা, কুরআন তিলাওয়াত মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সকে শক্তিশালী করে, যা একাগ্রতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণা নিশ্চিত করে, ধ্যান ও প্রার্থনা মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার বৃদ্ধি করে মনোযোগের ক্ষমতা বাড়ায়। Harvard Health Publishing
- বাস্তব প্রয়োগ: চট্টগ্রামের এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষিকা ফারজানা হক তার শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার আগের সপ্তাহে “৫ মিনিটের তাফাক্কুর সেশন” চালু করেছেন। ফলাফল? শিক্ষার্থীরা শুধু ভালো রেজাল্ট করেনি, তাদের পরীক্ষাভীতি ও অস্বস্তিও কমেছে।
নামাজ: শারীরিক ও মানসিক একাগ্রতার শক্তিশালী প্রশিক্ষণ
নামাজ শুধু ইসলামের স্তম্ভ নয়; এটি মনোযোগ বাড়ানোর সবচেয়ে শক্তিশালী ইসলামিক টুলকিট। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আসলে মস্তিষ্কের জন্য পাঁচটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর মনঃসংযোগের অনুশীলন (Focus Bootcamp)। প্রতিটি রুকু, সিজদা, কিয়াম আমাদেরকে বারবার বর্তমান মুহূর্তে ফিরিয়ে আনে – যা মনোবিজ্ঞানে “মাইন্ডফুলনেস” নামে পরিচিত।
নামাজে একাগ্রতা অর্জনের কার্যকর কৌশল
- তাজবিহ পাঠে মনোনিবেশ: নামাজের প্রতিটি সুরা বা দোয়া পড়ার সময় শুধু মুখে উচ্চারণ নয়, অর্থ নিয়ে চিন্তা করা, শব্দগুলোকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করা। যেমন, “আল-ফাতিহা” পড়ার সময় আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়ার অনুভূতি হৃদয়ে জাগ্রত রাখা। রাসূল (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি খুশু-খুজুর সাথে দুই রাকাত নামাজ আদায় করল, তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” (সহীহ বুখারি)।
- প্রস্তুতি (আযান ও ইকামত): আযানের শব্দ শুনে কাজ বন্ধ করে দেওয়া, ইকামতের পরপরই দাঁড়িয়ে যাওয়া – এই ছোট্ট কাজগুলো মস্তিষ্ককে নামাজের জন্য প্রস্তুত করে, ডিজিটাল ডিস্ট্রাকশন থেকে সরে আসার সুযোগ দেয়। ঢাকার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আরমান শাহরিয়ার তার ফোনে নামাজের সময়ে “ডু নট ডিস্ট্রার্ব” মোড চালু করেন, যাতে কোন নোটিফিকেশন তাকে বিরক্ত না করে।
- সিজদায় দীর্ঘায়িত সময়: সিজদা হচ্ছে নামাজের সবচেয়ে নিকটবর্তী অবস্থান। এ সময় ধীরে ধীরে “সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা” (মহান আমার প্রতিপালক পবিত্র) পড়ার সময় নিজের দুর্বলতা, আল্লাহর সামনে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের অনুভূতিকে হৃদয়ঙ্গম করা। এটি গভীর আত্ম-সচেতনতা ও মনোযোগ তৈরি করে।
বোল্ড করা দরকার: নামাজের মাধ্যমে অর্জিত এই দৈনিক একাগ্রতার অভ্যাস অনিবার্যভাবে ছড়িয়ে পড়ে আপনার পেশাগত জীবন, পড়ালেখা, পারিবারিক সম্পর্কে – যেকোনো কাজে গভীরভাবে ডুব দিতে সাহায্য করে।
কুরআন তিলাওয়াত, তাদাব্বুর ও তাফাক্কুর: মনের গভীরে নামার সিঁড়ি
মনোযোগ বাড়ানোর ইসলামিক উপায়ের আরেকটি অমূল্য সম্পদ হল কুরআন অধ্যয়ন ও চিন্তা-ভাবনা (তাদাব্বুর ও তাফাক্কুর)। কুরআন কেবল পাঠ্য নয়; এটি মনের জন্য এক ধরনের জিম।
তিলাওয়াতে একাগ্রতা ও তাফাক্কুরের শক্তি
- গুণগত তিলাওয়াত: প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্য হলেও (১৫-২০ মিনিট) সুন্দর তাজউইদের সাথে, ধীরে ধীরে, অর্থ বুঝে কুরআন পড়া। শুধু দ্রুত শেষ করার প্রতিযোগিতা নয়, বরং প্রতিটি আয়াতের বার্তাকে হৃদয়ে ধারণ করার চেষ্টা করা। আল্লাহ বলেন, “এটি এক মুবারক কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ গভীরভাবে চিন্তা করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূদ সাদ: ২৯)।
- তাদাব্বুর (গভীর চিন্তা): একটি নির্দিষ্ট আয়াত বা ছোট সূরাকে বেছে নিয়ে তার অর্থ, প্রেক্ষাপট, আপনার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এর প্রয়োগ নিয়ে ভাবা। উদাহরণস্বরূপ, সূরা আল-আসরের ছোট্ট আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা করা: “সময়ের কসম! নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত…” – সময়ের মূল্য, সৎকর্ম ও ধৈর্যের শিক্ষা আমাদের দৈনন্দিন উৎপাদনশীলতাকে কিভাবে প্রভাবিত করে?
- তাফাক্কুর (প্রকৃতি ও সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা): ইসলামে তাফাক্কুর একটি শক্তিশালী ইবাদত। আকাশের তারা, গাছের পাতার শিরা-উপশিরা, পাহাড়ের মহিমা – আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শনগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং সৃষ্টিকর্তার অসীম জ্ঞান ও শক্তির কথা স্মরণ করা। এই অনুশীলন বহিরাগত উদ্দীপনায় ছুটে বেড়ানো মনকে টেনে এনে কেন্দ্রীভূত করে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের অনুপ্রেরণাও জোগায়। বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে আল-হাইথামের আলোকবিদ্যা সংক্রান্ত যুগান্তকারী আবিষ্কার তাফাক্কুর থেকেই উৎসারিত।
বোল্ড করা দরকার: নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত ও তাফাক্কুর মস্তিষ্কের বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা বাড়ায়, সৃজনশীলতাকে উস্কে দেয় এবং অপ্রাসঙ্গিক চিন্তার প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে – যা একাগ্রতার জন্য অপরিহার্য।
দৈনন্দিন জীবনে ইসলামিক রুটিন: সময় ও মনোযোগের ব্যবস্থাপনা
ইসলাম শুধু আধ্যাত্মিকতাই শেখায় না, বরং জীবনকে সুশৃঙ্খল করার পথও দেখায়। সঠিক রুটিন ও অভ্যাস ছাড়া মনোযোগ ধরে রাখা অসম্ভব।
সুন্নাহভিত্তিক অভ্যাস গড়ে তোলা
- ভোরে উঠার ফজিলত (তাহাজ্জুদ ও ফজর): রাসূল (সা.) বলেছেন, “সুবহে সাদিকের পূর্বে (ফজরের সময়) বরকত দেয়া হয়।” (সহীহ মুসলিম)। ভোরের শান্ত পরিবেশে তাহাজ্জুদ বা ফজরের নামাজ আদায় এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোনিবেশ করা অনুৎপাদনশীলতার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী ঢাল। সিলিকন ভ্যালির অনেক সফল CEO-রাও এই অভ্যাসের গুরুত্ব স্বীকার করেন।
- নিয়তের শুদ্ধতা (ইখলাস): প্রতিটি কাজ শুরু করার আগে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” বলে এবং শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করার নিয়ত করা। এই ছোট্ট অভ্যাস কাজের উদ্দেশ্যকে পরিষ্কার করে, কাজের প্রতি অনীহা দূর করে এবং মনোযোগকে তীক্ষ্ণ করে।
- মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য (ওয়াসাতিয়্যাহ): ইসলাম অতিরিক্ত কাজ, অতিরিক্ত খাওয়া, অতিরিক্ত কথা বলাকে নিরুৎসাহিত করে। পরিমিতি বোধ (Balance) বজায় রাখা মস্তিষ্ককে ক্লান্তি ও দুর্বলতা থেকে রক্ষা করে, দীর্ঘ সময় ধরে মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে। রাসূল (সা.)-এর জীবনে নামাজ, পরিবার, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও বিশ্রামের মধ্যে অদ্ভুত ভারসাম্য ছিল।
- ডিজিটাল ডিটক্সের সুন্নাহ সমর্থন: রাসূল (সা.) অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। এই নীতিকে ডিজিটাল যুগে প্রয়োগ করলে দাঁড়ায়: সোশ্যাল মিডিয়ার স্ক্রলিং সীমিত করা, অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বন্ধ করা, নির্দিষ্ট সময়ে মোবাইল/ল্যাপটপ থেকে দূরে থাকা। ফেসবুকের সাবেক এক্সিকিউটিভও স্বীকার করেছেন এসব প্ল্যাটফর্ম আমাদের মনোযোগের শত্রু।
বোল্ড করা দরকার: ইসলামিক রুটিন ও সুন্নাহ মেনে চলা আসলে সময় ও শক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের বিজ্ঞান; যা আপনাকে অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল থেকে মুক্ত করে প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোনিবেশের সুযোগ সৃষ্টি করে।
ডুয়াআ ও জিকির: অন্তরের শান্তি ও মনোযোগের অবিচ্ছেদ্য অংশ
যখন মাথা গরম, চিন্তা ছুটাছুটি করে, তখন ডুয়াআ ও জিকির হল মনোযোগ ফিরে পাওয়ার দ্রুততম ইসলামিক সমাধান।
মনঃসংযোগের জন্য বিশেষ দোয়া ও জিকির
- বিভ্রান্তি দূরীকরণের দোয়া: রাসূল (সা.) যখন কোন গুরুতর বিষয়ে চিন্তিত বা বিভ্রান্ত হতেন, তখন এই দোয়া পড়তেন: “ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুব, সাব্বিত কালবী আলা দ্বীনিক” (হে হৃদয়সমূহের ঘূর্ণনকারী! আমার হৃদয়কে তোমার দ্বীনের উপর সুদৃঢ় রাখুন)। (সুনানে তিরমিজি)। এই দোয়া অন্তরে প্রশান্তি আনে, মনকে স্থির করে।
- সকাল-সন্ধ্যার জিকির: সকাল-সন্ধ্যায় নিয়মিত “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ” (ক্ষমতা ও শক্তি একমাত্র আল্লাহর) এবং “আস্তাগফিরুল্লাহ” (আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি) পাঠ করা। এই জিকির অন্তরের অহংকার, দুশ্চিন্তা দূর করে মনকে হালকা ও ফোকাসড রাখে।
- তাসবিহ-তাহলিল-তাহমিদ: “সুবহানাল্লাহ” (আল্লাহ পবিত্র), “আলহামদুলিল্লাহ” (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য), “আল্লাহু আকবার” (আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ) – এই ছোট্ট বাক্যগুলো বারবার উচ্চারণ বা মনে মনে স্মরণ করা (জবানী বা কালবী জিকির)। এটি একটি মেন্টাল রিসেট বাটন-এর মতো কাজ করে, যেকোনো সময়ে চিন্তার ট্রেনকে সঠিক ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনে।
বোল্ড করা দরকার: ডুয়াআ ও জিকির শুধু আধ্যাত্মিক অনুশীলন নয়; এগুলো নিউরোপ্লাস্টিসিটিকে উৎসাহিত করে, স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল কমায় এবং মনোযোগ নিয়ন্ত্রণকারী মস্তিষ্কের অংশগুলোকে সক্রিয় করে – বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত এক শান্তি ও একাগ্রতার উৎস।
ডিজিটাল যুগে মনোযোগ রক্ষায় ইসলামিক কৌশল
স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে মনোযোগ ধরে রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ইসলামের নীতিমালা এখানেও পথ দেখায়।
ইসলামিক নীতি অনুসরণ করে প্রযুক্তি ব্যবহার
- নিয়ত ও সময়সীমা: ফোন ব্যবহারের আগে নিয়ত করুন: এটি কি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য? (জ্ঞানার্জন, যোগাযোগ, ভালো কাজে ব্যবহার)। সময় বেঁধে দিন: যেমন দিনে ৩ বার, মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া চেক করা।
- কনটেন্ট ফিল্টার: ইসলাম অনর্থক বা হারাম বিষয় দেখতে নিষেধ করে। বেহুদা ভিডিও, গসিপ, নেগেটিভ নিউজ থেকে দূরে থাকা – এগুলো মস্তিষ্ককে বিষিয়ে তোলে ও মনোযোগ নষ্ট করে। দরকারী, শিক্ষণীয় ও ইতিবাচক কনটেন্ট বেছে নিন।
- প্রযুক্তিমুক্ত জোন ও সময়: পরিবারের সাথে খাওয়ার সময়, ঘুমানোর আগে ১ ঘন্টা, জুমার দিন বা বিশেষ ধর্মীয় দিনগুলোতে ডিজিটাল ডিটক্স পালন করুন। রাসূল (সা.) পরিবার ও সাহাবাদের সাথে গুণগত সময় কাটাতেন।
- ইসলামিক অ্যাপসের সাহায্য: কুরআন, হাদিস, নামাজের সময়, তাসবিহ কাউন্টার, ইসলামিক পডকাস্ট-এর জন্য নির্ভরযোগ্য অ্যাপ ব্যবহার করুন। এগুলো আপনার স্ক্রিন টাইমকে ইতিবাচক ও ফোকাসড রাখতে সাহায্য করবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের অফিশিয়াল অ্যাপ বা Quran.com হতে পারে ভালো রিসোর্স। Islamic Foundation Bangladesh
বোল্ড করা দরকার: ডিজিটাল ডিভাইস আমাদের দাস নয়, আমরা এর মালিক। ইসলামিক মূল্যবোধ মেনে প্রযুক্তি ব্যবহারই পারে আমাদেরকে ডিজিটাল শোরগোলের মধ্যে থেকেও আত্মিক শান্তি ও মননের একাগ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করতে।
জেনে রাখুন (FAQs Section)
জেনে রাখুন
প্রশ্ন: মনোযোগ বাড়ানোর ইসলামিক দোয়া কোনগুলো সবচেয়ে কার্যকর?
উত্তর: রাসূল (সা.)-এর শিখানো কিছু বিশেষ দোয়া মনোযোগ ও স্থিরতা অর্জনে অত্যন্ত কার্যকর। যেমন: “আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি…” (হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে আশ্রয় চাই…), সকাল-সন্ধ্যার জিকির (সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার – ৩৩ বার করে), এবং “ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুব…” দোয়া। নিয়মিত পড়লে এগুলো অন্তরকে প্রশান্ত ও মনোযোগী করে তোলে।প্রশ্ন: পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ানোর ইসলামিক টিপস কী কী?
উত্তর: পড়তে বসার আগে বিসমিল্লাহ পড়ুন এবং ভালো ফলাফলের জন্য আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন (তাওয়াক্কুল)। পড়ার পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। নিয়মিত ফজর নামাজ পড়ুন, তাহাজ্জুদে উঠলে কিছু সময় পড়ুন। অপ্রয়োজনীয় চিন্তা আসলে “আউজুবিল্লাহ…” পড়ে তা দূর করার চেষ্টা করুন। পড়ার মাঝে ছোট বিরতি নিয়ে আল্লাহকে স্মরণ করুন (জিকির)।প্রশ্ন: কাজের জায়গায় ইসলামিকভাবে মনোযোগ ধরে রাখার উপায় কি?
উত্তর: কাজ শুরু করুন বিসমিল্লাহ বলে এবং নিয়ত করুন এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। জুমার নামাজে অংশ নিন, এটি সপ্তাহিক রিচার্জের মতো। অফিসে ছোট বিরতিতে জিকির বা দোয়া পড়ুন (চুপিচুপি বা মনে মনে)। হারাম কাজ বা অসৎ পথে কাজের চাপ কমানোর চেষ্টা করবেন না, এতে বরকত কমে। সহকর্মীদের সাথে সুন্দর আচরণ (ইহসান) মনঃসংযোগের পরিবেশ তৈরি করে।প্রশ্ন: কি নামাজ মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে?
উত্তর: পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজই মূল ভিত্তি। তবে তাহাজ্জুদ নামাজ বিশেষভাবে কার্যকর, কারণ ভোরের শান্তি মনকে গভীরভাবে কেন্দ্রীভূত করে। জুমার নামাজের খুতবা মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করা একাগ্রতার দুর্দান্ত অনুশীলন। নিয়মিত নফল নামাজ (তাহিয়্যাতুল ওজু, ইশরাক, চাশত) নামাজের ধারাবাহিকতা ও মনোযোগের সক্ষমতা বাড়ায়।প্রশ্ন: কুরআন তিলাওয়াত কিভাবে মনোযোগ বাড়ায়?
উত্তর: কুরআন তিলাওয়াত একটি সক্রিয় মনোযোগের অনুশীলন। সঠিক তাজউইদে পড়তে হলে প্রতিটি অক্ষরে মনোযোগ দিতে হয়। অর্থ বুঝে পড়লে (তাদাব্বুর) মস্তিষ্ক গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত হয়, যা একাগ্রতা বাড়ায়। কুরআনের আয়াত আল্লাহর কাছ থেকে সরাসরি বাণী – এটি বিশ্বাস হৃদয়ে এক অনন্য প্রশান্তি ও নিবিষ্টতা আনে, যা অন্য সব চিন্তাকে স্তব্ধ করে দেয়।- প্রশ্ন: সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি কাটাতে ইসলাম কি বলে?
উত্তর: ইসলাম সময়ের অপচয়, অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা ও দৃষ্টি সংযত রাখতে জোর দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি কাটাতে: নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার (নির্দিষ্ট সময়), কনটেন্ট ফিল্টারিং (হারাম/অনর্থক বিষয় এড়ানো), ডিজিটাল রোজা (সপ্তাহে একদিন বা জুমার দিন বন্ধ রাখা), এবং বাস্তব সম্পর্ককে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। মনে রাখুন, রাসূল (সা.) বলেছেন: “মুসলিম সেই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ।” – অনলাইনে এই নীতি মেনে চলাই উত্তম।
উপরে বর্ণিত মনোযোগ বাড়ানোর ইসলামিক উপায়গুলো কোন জাদুর কাঠি নয়; এগুলো হল জীবনবোধের রূপান্তর। নামাজের মধ্যই লুকিয়ে আছে একাগ্রতার প্রশিক্ষণ, কুরআনের তিলাওয়াতে মেলে মনের গভীরে পৌঁছানোর সিঁড়ি, দৈনন্দিন সুন্নাহর অনুসরণে তৈরি হয় সুশৃঙ্খল রুটিন আর ডুয়ায় নিভে যায় অন্তরের অস্থিরতা। ডিজিটাল যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ নীতিই হতে পারে আপনার শান্তির খনি। মনোযোগ বাড়ানোর এই ইসলামিক পথ শুধু কর্মদক্ষতা বাড়ায় না, বরং জীবনের প্রতি মুহূর্তকে করে তোলে অর্থপূর্ণ, আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যায় কাছাকাছি। আজই শুরু করুন – পরবর্তী নামাজেই খুঁজে নিন হৃদয়ের সেই গভীর উপস্থিতি, ডুয়ায় ভরুন আপনার আশা-আকাঙ্ক্ষা, আর ইসলামের আলোকে সাজিয়ে নিন প্রতিদিনের রুটিন। শান্তি ও সফলতা অপেক্ষা করছে আপনার মনোযোগের দ্বারপ্রান্তেই। এখনই সময় আমলে নামার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।