আমরা মস্তিষ্ককে চালাই, নাকি মস্তিষ্ক আমাদের চালায়, বলুন তো? অনেকে হয়তো বলবেন, আমরাই মস্তিষ্ককে চালাই। চিন্তা করি, কর্মপরিকল্পনা তৈরি করি, সিদ্ধান্ত নিই এবং কাজটা করে ফেলি। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণের দড়িটা আমাদের হাতে। অনেকে আবার দ্বিমত করবেন। কেউ কেউ হয়তো একটু ভেবেচিন্তে বলবেন, দুটোই।
আমরা মস্তিষ্ককে চালাই, কারণ যুক্তি-তর্ক, অভিজ্ঞতা—এগুলোর ভিত্তিতে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্তটা আমরা নিই। কথা সত্যি। আবার এ কথাও সত্যি যে চিন্তা ছাড়াই আমরা শ্বাস নিতে পারি, চলাফেরা করতে পারি, প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি। শরীরবৃত্তীয় এরকম হাজারও কাজের নির্দেশনা ক্রমাগত তৈরি করে সেগুলো ব্যবহার করছে মস্তিষ্ক, যেখানে আমাদের বিন্দুমাত্র চিন্তা-ভাবনা করতে হয় না। একেবারে যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটছে বিষয়গুলো। অর্থাৎ মস্তিষ্ক এ ক্ষেত্রে আমাদের চালাচ্ছে।
এখানেই শেষ নয়। মস্তিষ্ক মাঝেমধ্যেই উদ্ভট সব কাজকর্ম করে ধাঁধায় ফেলে দেয় আমাদের। দেজা ভুর কথাই বলা যাক।কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ মনে হয়, এ মূহুর্তে যা ঘটছে আপনার চারপাশে, তা একইভাবে আগেও ঘটেছে। ঠিক পরের দৃশ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা আপনি জানেন। বাস্তবে তা-ই ঘটল। কীভাবে এসব হচ্ছে, তা আপনি জানেন না। কিন্তু ঘটনাটা ঘটছে। একই সঙ্গে আপনি ভীষণ অবাকও হচ্ছেন। কেমন একটা দ্বিধা—যেন কোনো চলচ্চিত্রের ভেতরে ঢুকে পড়েছেন।
মস্তিষ্কের এই অদ্ভুত কাণ্ডের নামই দেজা ভু। এ নিয়ে গবেষণাও হয়েছে বিস্তর। গবেষণা বলছে, অ্যাংজাইটির সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। মানসিক বিপর্যস্ততার কারণে এমনটা হয় অনেক সময়। তবে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের স্বাভাবিকভাবেই এমন অনুভূতি হয়। আগে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার সঙ্গে বর্তমানে ঘটা ঘটনার মিল খুঁজে পেলে দ্বিধায় পড়ে যায় মস্তিষ্ক। তখন এরকম অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করে। এর বাইরে সাধারণ অবস্থাতেও দেজা ভু হতে পারে। বিশেষ করে নতুন জায়গায় গেলে বা নতুন অভিজ্ঞতা হলে দেজা ভুর সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
আরেকটা ঘটনা আমাদের সঙ্গে প্রায়ই ঘটে। বাড়িতে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার পর হঠাৎ ভুলে যাই, কেন এসেছিলাম এ ঘরে। মস্তিষ্ক স্মৃতিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখার সময় প্রতিক্রিয়া হিসেবে এমনটা ঘটে। আমরা যখন একটি দরজা দিয়ে হেঁটে যাই, তখন আমাদের স্মৃতি বিশেষ এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। গবেষকেরা একে বলেন ‘ইভেন্ট বাউন্ডারি’। অর্থাৎ ঘটনার সীমা।
এ সময় আগের ‘ঘটনা’র স্মৃতি মস্তিষ্ক তার দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে স্থানান্তর করে। পাশাপাশি নতুন ইভেন্ট বা ‘ঘটনা’র স্মৃতি ধরার জন্য প্রস্তুত করে নিজেকে। দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিতে স্থানাস্তরের এ সময়টায় একটু আগের স্মৃতি তাৎক্ষণিক ফিরিয়ে আনার উপায় পুরোপুরি প্রস্তুত হয় না। ফলে আমরা যখন একটা ইভেন্ট বাউন্ডারির মধ্য দিয়ে যাই, তখন একটু আগের স্মৃতি সহজে মনে করতে পারি না। প্রতিবার দরজা দিয়ে ঢোকার সময় কিন্তু এটা ঘটে না। ঘটলে আমরা কখনোই ঘরে ঢোকার পর ‘কেন ঢুকেছি’, তা মনে করতে পারতাম না। ঘরে ঢোকার সময় যখন মস্তিষ্কের ইভেন্ট বাউন্ডারি অ্যাক্টিভেট হয়, তখনই শুধু এমন ঘটনা ঘটে।
স্মৃতি নিয়ে মস্তিষ্কের আরেকটা খামখেয়ালিপনার কথা বলে ইতি টানা যাক। কোনোকিছু নিয়ে কথা বলার সময় হঠাৎ করেই যুৎসই শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন না যে শব্দটা আপনি জানেন না। কিন্তু সময় মতো শব্দটা মনে আসে না। এ সমস্যাকে বলা হয় লিথোলজিকা।
আমরা জানি, কী বলতে হবে, কোনো শব্দটি উপযুক্ত। কিন্তু স্মৃতি থেকে শব্দটা নিয়ে আসতে পারি না। এ ঘটনা বেশি ঘটে সচরাচর ব্যবহার করি না, এমন শব্দের ক্ষেত্রে। কারণ এসব শব্দের স্মৃতি মনে করার বা রি-কল করার শক্ত সংযোগ নিউরনে তৈরি হয় না। প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ গড়পড়তা ৫০ হাজার শব্দ জানেন। এর মধ্যকার অনেক শব্দের ক্ষেত্রেই এ ঘটনা ঘটতে পারে।
মস্তিষ্কের এরকম অদ্ভুতুড়ে কাজকর্ম আমাদের সবার সঙ্গেই ঘটে। আসলে মস্তিষ্কের মতো জটিল অঙ্গের ক্ষেত্রে এটা অস্বাভাবিক নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা এসব ঘটনার কারণ জানতে পারছি। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছি কি? উত্তর হলো, না। এখনও আমরা মস্তিষ্কের সব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। মস্তিষ্ক তাই আজও আমাদের কাছে রহস্য হয়েই আছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।