ধরুন আপনি একটা বল ছুড়ে দিলেন ওপর দিকে। পৃথিবী বলটাকে টেনে ফের মাটিতে নামিয়ে আনবে। কিন্তু বলটা যদি এত বেশি বেগে ছুড়ে দেন যে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় আকর্ষণের চেয়েও বলটির বেগ বেশি হয়? তাহলে বলটা আর ফিরে আসবে না। এর নামই মুক্তিবেগ। এটা আমরা সবাই জানি। জানি, পৃথিবীর জন্য এই মুক্তিবেগের মান সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার। অর্থাৎ এই বেগ বা আরও বেশি বেগে বলটাকে ছুড়ে দিলে সেটা পেরিয়ে যাবে পৃথিবীর মহাকর্ষ।
তারপর? সেটা ছুটতে থাকবে। নভোযানে জ্বালানির পরিমাণ নির্দিষ্ট। কিন্তু সেটা কোনো সমস্যা নয়। কারণ, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে গেলে আর কোনো বাধা নেই। কোনো কিছু নভোযানের বেগ কমিয়ে দিতে ষড়যন্ত্র করবে না। বলপ্রয়োগও করবে না। ফলে নভোযানটি ছুটতে থাকবে, সরলরেখায়। আর দিক পাল্টাতে চাইলে জ্বালানি পোড়াবে, জেট ছুড়ে দেবে পেছনের সরু নল দিয়ে—ডানে জেট ছুড়লে নভোযান মোড় নেবে বাঁয়ে, আর বাঁয়ে ছুড়ে দিলে যাবে ডানে। এই তো!
কিন্তু যেতে হবে বহু দূর। ভয়েজার ১-এর কথাই ভাবুন। সৌরজগতের সীমা পেরোনো যার লক্ষ্য, তাকে পাড়ি দিতে হবে কত পথ! ভয়েজার ১ পেরিয়ে গেছে ২৩.৩৮১ বিলিয়ন কিলোমিটার। এত পথ যাওয়ার মতো জ্বালানি কোথায়। আর সদ্য পৃথিবী পেরিয়ে সামান্য যে বেগে ছুটছে, তাতে অত পথ পাড়ি দেওয়া কোনো কাজের কথা না। কাজেই, ধার করে নিতে হবে কোনো গ্রহ বা উপগ্রহের মহাকর্ষীয় সাহায্য।
ভয়েজার ১ চলে গেল বৃহস্পতির কাছাকাছি। বৃহস্পতি ঘুরছে উপবৃত্তাকার পথে, সূর্যের চারপাশে। বিশাল তার কক্ষপথ। ভয়েজার বা কোনো নভোযান এর কাছাকাছি গেল। মুক্তিবেগের বেশি বেগে না ছুটলে বৃহস্পতির মহাকর্ষীয় জালে আটকা তো পড়তে হবেই। হ্যাঁ, তাই হলো। এবারে নষ্ট সিএনজি যেমন দড়িতে বদ্ধ, অনুসরণ করে ছুটছে বাসের পিছুপিছু, বাস যেদিকে যাচ্ছে, সেও ওদিকে—এভাবেই ভয়েজার বৃহস্পতির উপবৃত্তাকার পথে ছুটল, পিছুপিছু, মহাকর্ষের দড়িতে বাঁধা।
বিপুল ভারী গ্যাসদানব গ্রহটি নিজের সবটা মহাকর্ষীয় আকর্ষণে বদলে দিল ভয়েজারের গতিপথ, বাড়িয়ে দিল গতি—ঠিক যেভাবে ফাস্ট বোলারের ছুড়ে দেওয়া বলের গতি বদলে দেন ব্যাটার, সেভাবে। তারপর, লক্ষ্য পূরণ হতেই—পর্যাপ্ত গতি উঠে গেছে বৃহস্পতির সহায়তায়, সঙ্গে বদলেও গেছে দিক—এবারে, খানিকটা জেট ব্যবহার করে বৃহস্পতির জাল ছিড়ে নিজের পথে এগোতে লাগল নভোযানটি।
এভাবেই মহাকর্ষীয় সহায়তা নিয়ে নিজের গতি বাড়ায় নভোযান। এ জন্য বৃহস্পতি যে পথে ছুটছে, যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকমুখী যাত্রা করতে হয় নভোযানটিকে। গতি কমাতে চাইলে? যেতে হবে উল্টোপথে। গতি বাড়ানোকে যদি ভাবেন পাহাড়ের ঢালু পথে নিচে ছুটে চলা, তবে গতি কমানোর জন্য ভাবতে পারেন উল্টোটি। ব্রেক আপনাকে করতে হবে না, ঢালু পাহাড়ি পথই সে কাজ করে দেবে। এ ক্ষেত্রে নভোযানের ব্রেকটা চেপে দেয় বৃহস্পতি গ্রহ, মহাকর্ষীয় জালে স্থান-কালজুড়ে ছুড়ানো সে ব্রেক মহাজাগতিক।
কল্পনা হয়তো করতে পারছেন, সঙ্গের ছবিগুলো দেখলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এভাবে গতি বাড়াতে-কমাতে বা দিক বদলাতে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্টের জুড়ি নেই। তবে মানবমিশন, অর্থাৎ নভোচারীদের নিয়ে এ ধরনের গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট করা মুশকিল। ধরুন, বৃহস্পতির সঙ্গে এর কক্ষপথের অর্ধেকটা ঘুরবেন নভোযানে।
বৃহস্পতির এক বছর মানে পৃথিবীর ৪ হাজার ৩৩৩ দিন। এর অর্ধেক, ২ হাজার দিনই ধরুন, মানে তো প্রায় সাড়ে ৫ বছর! কিংবা চাঁদকে ঘিরেই ঘুরলেন, সেও তো প্রায় এক মাসের ধাক্কা। অত সময় অপচয় করে নভোযানের ভেতরে বসে থাকাটা নভোচারীদের জন্য একটু কঠিনই। কাজেই মানব মিশনে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট ব্যবহৃত হবে কি না আদৌ, সন্দেহ আছে।
মানবহীন মিশনগুলোতে অবশ্য হরহামেশাই ব্যবহৃত হচ্ছে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট। সম্প্রতি বৃহস্পতির উদ্দেশে ছুটে চলা জুস (জুপিটার আইসি মুনস এক্সপ্লোরার) নভোযানও এ কাজ করেছে। মহাকর্ষীয় সহায়তা নিয়েছে চাঁদ থেকে। স্বল্প জ্বালানি খরচ করে বহু দূর দ্রুত গতিতে পাড়ি দিতে চাইলে আসলে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্টের বিকল্প নেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।