এবার আসা যাক হোম্যান ট্রান্সফারে। যদি কোনো কৃত্রিম উপগ্রহের কক্ষপথ পুরোপুরি পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে, অর্থাৎ কম উচ্চতার কক্ষপথ থেকে বেশি উচ্চতার কক্ষপথে অথবা উল্টোটা, তাহলে কীভাবে সেটি করা হয়?। সেখানে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধের পথে ঘূর্ণমান রয়েছে। সেখান থেকে এটিকে নিয়ে আসতে হবে বেশি উচ্চতার কক্ষপথে। সে জন্য প্রথমে কৃত্রিম উপগ্রহের গতিবেগে পরিবর্তন আনা হয়।
গতিবেগ কমবেশি হলে এর কক্ষপথের আকার আগের মতো বৃত্তাকার থাকবে না; বরং সেটি হয়ে যাবে উপবৃত্তাকার। খুব সূক্ষ্মভাবে হিসাব–নিকাশ করে কৃত্রিম উপগ্রহের গতিবেগ এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়, যেন নতুন উপবৃত্তাকার পথের অপর প্রান্তের অবস্থান হয় কাঙ্ক্ষিত বেশি উচ্চতার কক্ষপথের পরিধির ওপরে। সেখানে পৌঁছানোর পর কৃত্রিম উপগ্রহের গতির মান ও দিক আরেক দফা পরিবর্তন করা হয়। ফলে বেশি উচ্চতার কক্ষপথে ভারসাম্যপূর্ণভাবে পরিভ্রমণ করতে পারে কৃত্রিম উপগ্রহটি। পুরো প্রক্রিয়াটির নাম হোম্যান ট্রান্সফার।
এ আলোচনার সমাপ্তি টানব মহাকাশযান চালানোর আরেকটি মজার কৌশলের কথা দিয়ে। এর নাম গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট বা গ্র্যাভিটেশনাল স্লিংশট। গোড়া থেকে শুরু করা যাক। রকেটে ব্যবহার করা জ্বালানির দাম অনেক। তাই যত কম জ্বালানি খরচ করা যায়, ততই মঙ্গল। জ্বালানি সাশ্রয় করার এক চমকপ্রদ উপায়ের নাম গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট। এ পদ্ধতিতে কোনো গ্রহের নিজস্ব ভরবেগ কাজে লাগিয়ে মহাকাশযানের গতিবেগ অনেক বাড়িয়ে নেওয়া যায়। ১৯১৯ সালের দিকে সোভিয়েত গণিতবিদ ইউরি কন্ড্রাটুকের হাত ধরে এ পদ্ধতির আবির্ভাব।
গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট সম্পন্ন করতে হলে মহাকাশযানকে কোনো গ্রহ বা উপগ্রহের বেশ কাছ দিয়ে উড়ে যেতে হয়। এ সময় সেটি যদি গ্রহ বা উপগ্রহের কক্ষপথের পরিভ্রমণের গতির দিকের সঙ্গে একই দিকে যায়, তাহলে মহাকাশযানে খুব সামান্য পরিমাণ ভরবেগের স্থানান্তর ঘটে। ফলে বেড়ে যায় মহাকাশযানের গতি। বিষয়টি অনেকটা টান দিয়ে গতি বাড়িয়ে দেওয়ার মতো। গ্র্যাভিটি কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয় এই টান।
পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নীতি অনুসারে যেকোনো সিস্টেমে ভরবেগ সব সময় সংরক্ষিত থাকে। গ্রহ-উপগ্রহ ও মহাকাশযানের সিস্টেমও এর ব্যতিক্রম নয়। গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্টের মাধ্যমে মহাকাশযানের ভরবেগ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমপরিমাণ কমে যাবে গ্রহ বা উপগ্রহের ভরবেগ। ভরবেগ দুইভাবে কমতে পারে। এক, হয় গ্রহ বা উপগ্রহের ভর কমে যাবে অথবা এদের পরিভ্রমণের বেগ কমে যাবে।
গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্টের মাধ্যমে তাদের ভর কমে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই ভরবেগ সামান্য পরিমাণ কমতে হলে অবশ্যই কমে যাবে তাদের কক্ষপথে পরিভ্রমণের বেগ। তবে বেগ কমে যাওয়ার মাত্রা এতটাই কম যে খুব সহজে উপেক্ষা করা যায়। গ্রহ বা উপগ্রহের সামগ্রিক কক্ষপথে কোনো ধরনের প্রভাব পড়ে না। অন্যদিকে মহাকাশযানের ক্ষেত্রেও ভরবেগ বেড়ে যায় তার গতিবেগ বৃদ্ধি পাওয়ার মাধ্যমে। কারণ, এখানেও ভর বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে মহাকাশযানের গতিবেগ বেশ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে যায়।
এ সময় যদি ইঞ্জিন ব্যবহার করে মহাকাশযানকে গতির দিকে ধাক্কা দেওয়া যায়, তাহলে ভরবেগ বৃদ্ধির মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া যায় আরও অনেক গুণ। আমরা চাইলে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট ব্যবহার করে কোনো মহাকাশযানের গতিবেগ কমিয়ে ফেলতে পারি। সে জন্য একে অগ্রসর হতে হবে গ্রহ বা উপগ্রহের কক্ষপথের গতির বিপরীত দিক থেকে। তখন গ্রহ বা উপগ্রহের ভরবেগ বেড়ে যাবে এবং মহাকাশযানের ভরবেগ কমে যাবে।
গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট পদ্ধতি প্রয়োগের বিপরীতে সবচেয়ে বড় বাধার নাম সময়। এর সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য একেবারে সঠিক জায়গায় ও সঠিক সময়ে উপস্থিত থাকতে হয় একটি মহাজাগতিক বস্তুর। নয়তো কাজে আসবে না এ পদ্ধতি। ভয়েজার মিশনগুলোর কথাই ধরুন। মানবসভ্যতার মহাকাশভ্রমণের ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত দুটি মহাকাশযানের নাম ভয়েজার-১ এবং ভয়েজার-২।
তাদের বর্তমান অবস্থান ইন্টারস্টেলার স্পেসে। অর্থাৎ তারা ছাড়িয়ে গেছে আমাদের সৌরজগতের শেষ প্রান্ত। সৌরজগতের শেষ প্রান্তে পৌঁছানোর জন্য কোনো মহাকাশযানকে পৃথিবী থেকে যাত্রা করতে হবে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২৫ মাইল বেগে। এ জন্য দরকার পড়ে প্রচুর পরিমাণ জ্বালানি। ১৯৭৭ সালে আমাদের সৌরজগতের বেশ কিছু গ্রহ প্রাকৃতিকভাবে বিশেষ অবস্থানে চলে এসেছিল। এমনটা ঘটে প্রতি ১৭৫ বছরে মাত্র একবার।
সে সময়ে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন এমনভাবে অবস্থান করছিল যে একটি মহাকাশযানের মাধ্যমে পরপর কয়েকটি গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট সম্পন্ন করার সুযোগ তৈরি হয়। অন্য সময় এমনটা করা এককথায় অসম্ভব। এ অনবদ্য সুযোগ কাজে লাগিয়ে ১৯৭৭ সালে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২। ফলে অনেক কম জ্বালানি ব্যয় করে তারা পৌঁছে যেতে সক্ষম হয় সৌরজগতের শেষ প্রান্তে। ভয়েজার মিশনগুলো ছাড়া এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি মহাকাশ মিশনে সফলতার সঙ্গে গ্র্যাভিটি অ্যাসিস্ট পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। সত্যিই মনোমুগ্ধকর, তাই না?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।