শহর থেকে দূরের কোনো গ্রামে রাতের আকাশে তাকালে দিগন্তব্যাপী অসংখ্য ফুটকি ফুটকি আলো দিয়ে গঠিত একটা ফিতার মতো কাঠামো নজরে আসে, যেটা আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিস্তৃত। এটা হলো আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ডিস্কের কিনারার অংশ। আমাদের সৌরজগৎ এই ডিস্ক আকৃতির গ্যালাক্সির কিনারার দিকে থাকার কারণে এই দৃশ্য দেখা যায়।
প্রাচীন যুগে গ্রিকদের বিশ্বাস ছিল, শিশু হেরাক্লেসকে দুধ পান করাতে গিয়ে বুক থেকে কিছু তরল দুধ ছিটকে ছড়িয়ে পড়ে এই আলোর ফিতার মতো পথ তৈরি হয়েছে। সেখান থেকেই গ্যালাক্সি শব্দটার জন্ম হয়েছে। গ্যালাক্সি শব্দের অর্থও আসলে দুধেল বা দুগ্ধময়। আর মিল্কিওয়ে শব্দটাতেও সেই দুধেল পথের কথাই বলা হয়েছে।
বাংলায় একেই বলা হয় ছায়াপথ। অবশ্য গ্যালাক্সির প্রতিশব্দ হিসেবে ছায়াপথ ব্যবহার করতে এখন অনেকেই নারাজ। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে বাংলায় বলা হয় আকাশগঙ্গা। প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিতেরা রাতের আকাশে মিল্কিওয়ের ডিস্কের কিনারা দেখে তাকে আকাশে বয়ে চলা নদী বলে কল্পনা করেছিলেন। তাই তার নাম আকাশগঙ্গা।
যা–ই হোক, সম্প্রতি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার হাবল টেলিস্কোপ এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এসার গায়া স্যাটেলাইটে মিল্কিওয়ের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। আলোর ঘনত্ব বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মিল্কিওয়ের ভর আমাদের সৌরজগতের তুলনায় ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন গুণ, যেখানে প্রায় ২০০ বিলিয়ন নক্ষত্রের বসবাস। একটা প্রমাণ সাইজের মেঘের ভেতরেও প্রায় একই সংখ্যক পানির কণা থাকতে দেখা যায়। কাজেই আমরা এক নাক্ষত্রিক মেঘের ভেতর বসবাস করছি, সেটা কি বলা যায়?
মিল্কিওয়ের নামের এই মেঘের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ১০০ কোয়াড্রিলিয়ন কিলোমিটার (১ কোয়াড্রিলিয়ন হলো ১০১৫)। আলোকবর্ষ এককে বলা যায়, মিল্কিওয়ের দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় ১০০,০০০ আলোকবর্ষ। তার মানে, এ গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত পাড়ি দিতে একটা আলোক রশ্মিরও সময় লাগবে এক লাখ বছর।
লকহিড বিমানের কত সময় লাগবে, সে কথা আর নাই-বা বললাম। মিল্কিওয়েকে কেন্দ্র করে আমাদের সূর্য তথা সৌরজগৎ একটা কক্ষপথে ঘুরছে। এই পথে এক পাক ঘুরে আসতে সূর্যের সময় লাগে ২৩০ মিলিয়ন বছর। একে বলা হয় গ্যালাকটিক ইয়ার বা মহাজাগতিক বছর।
আমাদের সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সির নাম অ্যান্ড্রোমিডা। আমাদের কাছ থেকে তার দূরত্ব ২৩ কোয়াড্রিলিয়ন কিলোমিটার। এই সংখ্যার মর্মার্থ সহজে মাথায় ঢোকার কথা নয়। আলোকবর্ষের হিসাবে তা প্রায় ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। এতে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন নক্ষত্র রয়েছে। তার ব্যাস ২২০,০০০ আলোকবর্ষ।
মিল্কিওয়ে আর অ্যান্ড্রোমিডা বিপুল মহাবিশ্বের মাত্র দুটি গ্যালাক্সি। এ রকম প্রায় ১০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। রাতে আকাশের দিকে আপনি যদি একমুঠো বালুকণা ধরে ওপরে তোলেন, তাহলে যেটুকু এলাকা সেটা দখল করবে, সেই জায়গায় অন্তত ১০,০০০ গ্যালাক্সি রয়েছে। আর তাদের প্রতিটিতে রয়েছে অন্তত বিলিয়ন–সংখ্যক নক্ষত্র এবং তার চেয়েও কয়েক গুণ গ্রহ। মহাবিশ্ব তথা মহাকাশ আসলে খুবই বড়।
এই ‘খুবই বড়’ শব্দে মহাকাশ বা মহাবিশ্বের বিশালত্ব বোঝানো সম্ভব নয়। এটা আসলে বিশালের চেয়েও অনেক অনেক অনেক গুণ বড়। সেটা অসামান্য, বিপুলাকায়, বিরাট, প্রকাণ্ডের চেয়েও অনেক বড়। সেই বড়ত্বকে, বিশালত্বকে ‘মহাজাগতিক’ শব্দটাই হয়তো কিছুটা প্রকাশ করতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি সাধে লিখেছেন, ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে/ আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে॥’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।