বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমাদের ছায়াপথের মধ্যে অনেকগুলো ছোটখাটো গিলে ফেলা গ্যালাক্সির চিহ্ন আছে। এগুলো একসময় ছায়াপথের খুব কাছে এসে পড়েছিল আর বেরোতে পারেনি। সেই ছোট গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলো এখন ছায়াপথের বাসিন্দা, কিন্তু সেগুলোর আগেকার গতিবিধির স্মৃতি একেবারে হারায়নি। এখনো সেগুলোর গতিবিধির মধ্যে কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, যা থেকে এগুলোর অতীতের ঘটনার ইতিহাস উদ্ধার করা যেতে পারে। এই গিলে ফেলা ছোট গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলো কয়েক কোটি বছর ধরে দলবদ্ধ হয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে ছায়াপথের মহাকর্ষ সেগুলোর মধ্যে সেই বন্ধন আলগা করে আনে।
একটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটা বোঝা যেতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীনকালে যুদ্ধের পর যখন পরাজিত দেশের লোকজনকে ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া হতো, তখন কয়েক প্রজন্ম ধরে হয়তো তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারত, তারপর ধীরে ধীরে অন্য দেশের আর পাঁচটা নাগরিকের মধ্যে মিশে যেতে বাধ্য হতো। এখানেও প্রায় তেমন ঘটনা ঘটে।
এই গবেষণায় ইউরোপ থেকে মহাকাশে পাঠানো একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র বিশেষভাবে সাহায্য করেছে, যার নাম GAIA। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পাঠানো হয়েছিল এই যন্ত্র। বহু দূরের নক্ষত্রের দূরত্ব ও গতিবিধি সঠিকভাবে নির্ধারণে এর জুড়ি নেই। এর সাহায্যে বিজ্ঞানীরা আমাদের ছায়াপথে প্রায় এক কোটি নক্ষত্রের সঠিক অবস্থান এবং গতিপ্রকৃতি জানার চেষ্টা করছেন।
২০১৮ সালে এই যন্ত্রের সাহায্যে বিজ্ঞানীরা এক আশ্চর্যজনক তথ্য পেয়েছেন। আমরা জানি যে ছায়াপথের অন্তর্গত নক্ষত্রগুলো তার কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরছে। মেলার মেরি গো রাউন্ডের মতো। আমাদের সূর্যও ঘুরছে। কিন্তু দেখা গেছে যে সূর্যের আশপাশের কিছু নক্ষত্র আছে, যেগুলোর গতিবিধি একেবারে ভিন্ন। সৌরজগতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হয়, এগুলো উল্টো দিকে যাচ্ছে। দুটি ট্রেন পাশাপাশি চলার সময় যখন মনে হয় যে অন্য ট্রেনটি পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে। তখন আমরা বুঝে নিই যে অন্য ট্রেনটি হয় ধীরে চলছে বা উল্টো দিকে যাচ্ছে। এখানেও তা–ই।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এ ধরনের ‘উল্টো দিকে’ চলা নক্ষত্রের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এগুলো যেন একটি আলাদা গোষ্ঠী, যেগুলো নিজেদের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। শুধু তা–ই নয়, এগুলোর পদার্থের উপাদান থেকে বোঝা যায়, এগুলোর জন্ম একসঙ্গে হয়নি, কয়েক প্রজন্ম ধরে হয়েছে। তাহলে এগুলো নিজেদের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখছে কী করে?
আগের সেই ক্রীতদাসদের উদাহরণের মতো নক্ষত্রগুলোর ক্ষেত্রেও কোনো গোষ্ঠীর আলাদা বৈশিষ্ট্য নজরে পড়লে সেগুলোর ইতিহাস নিয়ে ভাবতে হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, সূর্যের নিকটবর্তী এই বিপরীতমুখী নক্ষত্রগুলো অন্য এক গ্যালাক্সিতে জন্ম নিয়েছিল। একসময় সেই গ্যালাক্সি এসে ছায়াপথের সঙ্গে ধাক্কা লাগার পর এগুলো এখানকার বাসিন্দা হয়ে গেছে, কিন্তু সেগুলোর রীতিনীতি বজায় রেখেছে।
সেগুলোর গতিবিধি থেকে এই সংঘর্ষের চরিত্র বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। অনুমান করা হয় যে এই ধাক্কা লেগেছিল প্রায় হাজার কোটি বছর আগে। যেহেতু অন্য গ্যালাক্সিটির নক্ষত্রগুলো এখন ছায়াপথের সদস্য হয়েছে, তাই এ–ও অনুমান করা যায় যে সেই গ্যালাক্সিটি ছায়াপথের তুলনায় কম ভারী ছিল। ফলে সংঘর্ষের সময় ছায়াপথের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। ছায়াপথ তাকে গিলে খেয়েছে। আর সাপের পেটে আধখাওয়া শিকারের মতো রয়ে গেছে তার নক্ষত্রগুলো।
আরেকটি ক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। দুটি বিশেষ নক্ষত্রপুঞ্জকে লক্ষ করে দেখা গেছে, সেগুলোর অবস্থান ছায়াপথের অন্যান্য নক্ষত্রের থেকে আলাদা, কিন্তু সেগুলোর বৈশিষ্ট্য ছায়াপথের সদস্য নক্ষত্রের মতোই। অর্থাৎ সেগুলো অন্য গ্যালাক্সির নয়, ছায়াপথেরই অংশ। কিন্তু কোনো কারণে সেগুলো নিজেদের নিজস্ব জায়গা থেকে ছিটকে অন্য জায়গায় গিয়ে পড়েছে।
সেগুলোর বৈশিষ্ট্য ছায়াপথের অন্য নক্ষত্রগুলোর মতো, শুধু অবস্থান আলাদা। এই সূত্র ধরে গবেষণা করে দেখা গেছে যে পুকুরে ঢিল ছুড়লে যেমন জলে ঢেউ ওঠে, তেমনি অতীতের সংঘর্ষের ফলে ছায়াপথের নক্ষত্রের গতিবিধিতেও একধরনের ‘ঢেউ’ তৈরি হয়েছে। GAIA কৃত্রিম উপগ্রহের দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েই এসব সূক্ষ্ম তথ্য জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে।
এই দুই নক্ষত্রপুঞ্জের নাম A13 এবং TriAnd (কারণ, দ্বিতীয়টি আমাদের আকাশে Triangulum এবং Andromeda নক্ষত্রমণ্ডলীর দিকে দেখা যায়)। একটি ছায়াপথের ‘চাকতি’র উত্তরে প্রায় ১৪ হাজার আলোকবর্ষ দূরে এবং অন্যটি প্রায় একই দূরত্বে, কিন্তু দক্ষিণ দিকে অবস্থিত (মহাশূন্যে অবশ্য উত্তর-দক্ষিণ দিকের কোনো অর্থ নেই। তবে ছায়াপথের যে দিকটি পৃথিবীর উত্তর দিকে অবস্থিত, সেই দিকটিকেই তার উত্তরের অংশ বলে উল্লেখ করা হয়)।
সাধারণত যেসব নক্ষত্র ছায়াপথের অন্তর্গত গ্যাস থেকে জন্ম নেয়, সেগুলো ছায়াপথের চাকতির মধ্যেই বাস করে। সেখান থেকে এত ওপর বা নিচে থাকার কথা নয়। কিন্তু এই দুই গোষ্ঠীর নক্ষত্রগুলোর উপাদান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এগুলো ছায়াপথের আর পাঁচটা নক্ষত্রের মতোই। মানুষের ডিএনএ পরীক্ষা করে যেভাবে তার বংশ নির্ধারণ করা হয়, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও নক্ষত্রের উপাদান তলিয়ে দেখে সেটি কী ধরনের নক্ষত্র, তা বের করতে পারেন। জানা গেছে, এগুলো ছায়াপথের গড়পড়তা নক্ষত্রের মতোই। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এগুলো এত দূরে গেল কেন এবং কীভাবে?
বিজ্ঞানীরা কম্পিউটারে এক কল্পিত গ্যালাক্সির সঙ্গে ছায়াপথের সংঘর্ষের অঙ্ক কষে দেখেছেন যে জলে ঢেউ ওঠার মতো নক্ষত্রজগতেও একধরনের ঢেউ তৈরি হতে পারে। জলে ঢেউ উঠলে যেমন জলের কণা ওঠানামা করে, তেমনি একটি নক্ষত্রপুঞ্জ দুটি ছায়াপথের চাকতির দুই দিকে ‘ওঠানামা’ করছে। তার মধ্যে একটি বর্তমানে ছায়াপথের চাকতির উত্তরে এবং অন্যটি দক্ষিণে রয়েছে। এক জায়গায় জন্ম হওয়ার পর দূরে ছিটকে পড়া অস্বাভাবিক নয়। অনেক সময় গল্পে শোনা যায় যে ছোটবেলায় কোনো পারিবারিক বিপর্যয়ের জন্য ভাইবোনদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়েছে, একেকজন ভিন্ন ভিন্ন দিকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। পরে তাদের আচরণের মধ্যে বা স্বভাবগত সাদৃশ্য দেখে বোঝা যায় যে তারা আসলে একই পরিবারের লোক।
এই দুই নক্ষত্রপুঞ্জ আসলে কাছাকাছি জায়গায় জন্ম নিয়েছিল, কিন্তু কোনো কারণে দূরে ছিটকে পড়েছে। এগুলোর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এখন অতীতের সেই বিপর্যয়ের কথা জানতে পেরেছেন। এভাবে নতুন গবেষণায় ছায়াপথের অতীতের ইতিহাসের কথা জানা যাচ্ছে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের এ ধরনের গবেষণার নাম দেওয়া হয়েছে ‘গ্যালাক্সি প্রত্নতত্ত্ব’। জানা গেছে, আমাদের ছায়াপথের অতীতে ভয়ংকর কিছু ঘটনার কথা। সেগুলো হয়তো আমরা কেউ দেখিনি। কারণ, সূর্যের জন্মের আগেই এসব ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আকাশের নক্ষত্রের গতিবিধির মধ্যে লুকিয়ে আছে অতীতের সেই অশান্তিকর পরিস্থিতির স্মৃতি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।