মহাশূন্য থেকে পৃথিবীতে আসা পাথরগুলোকে ডাকা হয় মিটিওর বা উল্কা নামে। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময়টা এসব মহাজাগতিক অতিথিদের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। কারণ সেখানে তাদের প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হতে হয়। প্রবল বেগে চলা পাথরগুলো বায়ুমণ্ডলের বাতাস ক্রমাগত সংকুচিত করতে থাকে। সংকোচনের দরুন পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তাপমাত্রা। ফলে একসময় দপ করে জ্বলে ওঠে পাথরগুলোর আশপাশে থাকা বাতাস। আর আপাত বৈশিষ্ট্যহীন পাথরগুলো পরিণত হয় ভয়ংকর সুন্দর জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডে।
বেশির ভাগ সময় এগুলো বায়ুমণ্ডলের ভেতরেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তবে এদের আকার যথেষ্ট বড় হলে পুড়ে যাওয়ার পরেও পাথরগুলোর কিছু অংশ নেমে আসতে পারে ভূপৃষ্ঠে। তখন এদের ডাকা হয় মিটিওরাইট নামে। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিক থেকেই যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে থাকা গবেষণাগারগুলোয় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল অ্যাপোলো মিশনের। এর মাধ্যমে পৃথিবীতে নিয়ে আসা হবে চাঁদের পাথর।
এমনই এক সময়ে অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো করে বিজ্ঞানীদের হাতে এসে ধরা দেয় চিহুয়াহুয়ার মিটিওরাইটটি। পরবর্তীতে গ্রামের নাম অনুসারে উল্কাপিণ্ডটির নাম রাখা হয় অ্যালেনডে মিটিওরাইট। পৃথিবীতে নাটকীয় আগমনের কারণে মুহূর্তেই বিখ্যাত হয়ে ওঠে এটি। বিজ্ঞানীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন এর ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করতে।
স্থানীয় বাসিন্দারাও সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন এই বিশাল কর্মযজ্ঞে। যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা একাই প্রায় ১৫০ কেজি সমপরিমাণ পাথর সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। সেগুলো পরে তেরোটি দেশের ৩৭টি ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষাগারে বিতরণ করা হয়। সব মিলিয়ে উল্কাপিণ্ডের ধ্বংসাবশেষ থেকে ছোট-বড় মিলিয়ে দুই টনেরও বেশি ভরের বস্তু সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। এদের ভর ছিল ১ গ্রাম থেকে শুরু করে ১১০ কেজি পর্যন্ত।
এত বিশাল ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার অর্থ, বিস্ফোরিত হওয়ার সময় উল্কাপিণ্ডটির আকার ছিল কমপক্ষে একটি গাড়ির সমান। সফলভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পাথর সংগ্রহ করতে পারা ও সেগুলো নিয়ে গবেষণা করতে পারায় একে ‘বেস্ট স্টাডিড মিটিওরাইট’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা অ্যালেনডে মিটিওরাইটের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে নিশ্চিত হন। এটি মোটেও মহাকাশ থেকে আসা সাধারণ কোনো পাথর নয়।
বরং এটি কার্বনেসিয়াস কনড্রাইট শ্রেণির। মহাশূন্য থেকে পৃথিবীতে আসা মোট উল্কাপিণ্ডের মাত্র ৫% এই শ্রেণিভুক্ত। এদের মধ্যে থাকে সৌরজগতের সৃষ্টির সময়ের অতি প্রাচীন বস্তুর অস্তিত্ব। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রাপ্ত এ ধরনের সবচেয়ে বড় উল্কাপিণ্ড হলো অ্যালেনডে মিটিওরাইট। নানা ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে পৃথিবীতে পৌঁছানো মিটিওরাইটগুলোর মধ্যে হরহামেশাই তেজস্ক্রিয় মৌলের দেখা মেলে।
এগুলো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্দিষ্ট সময় পরে ক্ষয়ে যায়। অর্থাৎ, এক মৌলের নিউক্লিয়াস রূপান্তরিত হয় অন্য মৌলের নিউক্লিয়াসে। বাইরে থেকে কোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগ করে এ প্রক্রিয়া সামান্যতম প্রভাবিত করারও সুযোগ নেই। তেজস্ক্রিয় ক্ষয় প্রক্রিয়ায় কোনো নির্দিষ্ট পরমাণু ঠিক কখন রূপান্তরিত হবে, তা আগে জানা সম্ভব নয়। তবে বেশকিছু তেজস্ক্রিয় পরমাণুর মধ্যে ঠিক অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয়ে যেতে কতটুকু সময় প্রয়োজন, তা আগাম বলে দেওয়া সম্ভব। বিজ্ঞানীরা এই সময়ের নাম দিয়েছেন অর্ধায়ু।
প্রতিটি তেজস্ক্রিয় মৌলের অর্ধায়ুর মান আলাদা। তেজস্ক্রিয় মৌলের অর্ধায়ুর একটি চমৎকার ব্যবহারিক প্রয়োগ রয়েছে। কোনো মিটিওরাইটে থাকা তেজস্ক্রিয় মৌলগুলোর অর্ধায়ুর মান আগে থেকে জানা থাকলে, তা ব্যবহার করে খুব সহজে নিখুঁতভাবে এর (মিটিওরাইট) বয়স নির্ধারণ করে ফেলা সম্ভব। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করা মিটিওরাইটগুলোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া অতি পরিচিত একটি তেজস্ক্রিয় মৌলের নাম রুবিডিয়াম।
এর ভর সংখ্যা ৮৭। অর্থাৎ, এর নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা ৮৭। এর মধ্যে প্রোটন ৩৭টি, বাকিগুলো নিউট্রন। তেজস্ক্রিয় ক্ষয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রুবিডিয়াম নিউক্লিয়াসের একটি নিউট্রন পরিণত হয় প্রোটনে। ফলে সামগ্রিকভাবে নিউক্লিয়াসটি পরিণত হয় সমান ভর সংখ্যার স্ট্রনসিয়াম নিউক্লিয়াসে। এভাবে কোনো নমুনায় উপস্থিত মোট রুবিডিয়াম পরমাণুর ঠিক অর্ধেক পরিমাণ রূপান্তরিত হতে প্রয়োজন সুদীর্ঘ সময়।
প্রায় ৪৮.৪ বিলিয়ন বছর। মানুষের জীবনকাল বিচারে এ সময়কে আমাদের কাছে অনন্তকাল মনে হতে পারে। কিন্তু গ্রহ বা নক্ষত্রদের গঠন হওয়ার কাল বিবেচনায় এটা খুব বেশি নয়। যদি রুবিডিয়ামের অর্ধায়ুর মান কম হতো (যেমন কয়েক হাজার বছর), তাহলে পৃথিবীতে পৌঁছানো মিটিওরাইটের মধ্যে এদের লেশমাত্রও খুঁজে পাওয়া যেত না। এদের প্রায় প্রতিটি পরমাণু ক্ষয়ে যেত।
অন্যদিকে, রুবিডিয়ামের অর্ধায়ুর মান আরও অনেক বেশি হলে বয়স নির্ধারণ করার জন্য প্রয়োজনীয় স্ট্রনসিয়ামের অস্তিত্ব থাকত না মিটিওরাইটগুলোতে। যাহোক, মিটিওরাইটে থাকা রুবিডিয়াম ও স্ট্রনসিয়াম পরমাণুর বর্তমান সংখ্যা থেকে বিজ্ঞানীরা সহজে হিসাব কষে বের করে ফেলতে পারেন এর (মিটিওরাইট) জন্মলগ্ন থেকে ক্ষয়ে যাওয়া রুবিডিয়াম পরমাণুর সংখ্যা।
পরে এই তথ্যের সঙ্গে আগে থেকে জানা রুবিডিয়ামের অর্ধায়ুর মেলবন্ধন ঘটিয়ে তারা নিমিষেই নির্ধারণ করে ফেলতে পারেন মিটিওরাইটের বয়স। ঠিক এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হল সৌরজগতের সৃষ্টিলগ্নের বার্তা বয়ে আনা অ্যালেনডে মিটিওরাইটের নমুনায়। প্রাপ্ত ফলাফল অনুসারে মিটিওরাইটটির যাত্রা শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৪৫৬ কোটি বছর আগে। খুব সম্ভবত যে সময়টায় মহাবিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করেছিল আমাদের চিরচেনা পৃথিবী।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।