পদার্থবিজ্ঞানে D দিয়ে স্থানিক মাত্রার সংখ্যা প্রকাশ করে। এম-থিওরিতে আগ্রহের কারণে পদার্থবিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নেরও জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছেন, উচ্চতর বা নিম্নমাত্রায় প্রাণ টিকে থাকা সম্ভব কি না। স্থান যদি একমাত্রিক হতো, তাহলে প্রাণের কোনো অস্তিত্বই থাকত না।
কারণ, মহাবিশ্ব হতো তুচ্ছ। সাধারণত একমাত্রিক মহাবিশ্বে পদার্থবিদেরা যখন কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন, তখন আমরা দেখতে পেয়েছি, কণারা পরস্পরের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে কোনো রকম মিথস্ক্রিয়া না করেই। কাজেই এক মাত্রার কোনো মহাবিশ্ব প্রাণের জন্য উপযুক্ত নয় বলে মনে হয়। কারণ, সেখানে কণাগুলো পরস্পরের সঙ্গে একত্র হয়ে ক্রমবর্ধমান জটিল বস্তু গঠন করতে পারে না।
দুটি স্থানিক মাত্রাতেও আমাদের সমস্যা আছে। কারণ, সেখানে প্রাণের গঠন সম্ভবত খণ্ডিত হয়ে যেত। একটি দ্বিমাত্রিক প্রজাতি কল্পনা করা যাক, যারা ফ্ল্যাট বা সমতলের প্রাণী; যাদের বলা হয় ফ্ল্যাটল্যান্ডার। এরা একটি টেবিলের ওপর বসবাস করে। তাদের খাওয়ার কথা কল্পনা করুন।
মুখ থেকে তাদের পেছন পর্যন্ত পথটি ফ্ল্যাটল্যান্ডারকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দেবে। তাতে সে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। কাজেই একটি জটিল জীব হিসেবে বিভক্ত বা টুকরা টুকরা না হয়ে কোনো ফ্ল্যাটল্যান্ডার কীভাবে টিকে থাকতে পারে, তা ভাবাও কঠিন। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং তাঁর আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বইতে বিষয়টি সচিত্র বুঝিয়েছেন।
জীববিজ্ঞানের আরেকটি যুক্তি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে বুদ্ধিমত্তা তিন মাত্রার চেয়ে কম মাত্রায় থাকতে পারে না। আমাদের মস্তিষ্ক বিপুল পরিমাণ ওভারল্যাপিং বা পরস্পরছেদী নিউরন ধারণ করে, যা বড় ধরনের বৈদ্যুতিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত। মহাবিশ্ব যদি এক বা দুই মাত্রিক হতো, তাহলে সেখানে জটিল নিউরাল নেটওয়ার্ক গঠন করা কঠিন হতো। বিশেষ করে সেগুলো যদি একটির ওপর আরেকটি থাকত, তাহলে তাদের মধ্যে শর্টসার্কিট দেখা দিত।
নিম্নমাত্রায় জটিল লজিক সার্কিটের সংখ্যার দিক দিয়ে এবং অল্প জায়গায় যে বিপুল পরিমাণ নিউরন রাখতে পারি, তার দিক দিয়ে আমরা মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ হতাম। যেমন আমাদের মস্তিষ্কে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরন আছে। এর পরিমাণ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যে পরিমাণ নক্ষত্র আছে, তার সমান। প্রতিটি নিউরন প্রায় ১০ হাজার অন্য নিউরনের সঙ্গে সংযুক্ত। এ রকম জটিলতা নিম্নমাত্রায় আনা খুবই কঠিন।
চার মাত্রাতেও রয়েছে আরেক ধরনের সমস্যা। চার মাত্রায় গ্রহগুলো সূর্যের চারদিকের কক্ষপথে স্থিতিশীল নয়। নিউটনের বিপরীত বর্গীয় সূত্রটি এখানে প্রতিস্থাপিত করতে হয় বিপরীত ঘনকীয় সূত্র দিয়ে। অন্যান্য মাত্রায় পদার্থবিজ্ঞান কেমন হতে পারে, তা ১৯১৭ সালে অনুমান করেছিলেন আইনস্টাইনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী পল এহরেনফেস্ট। তাঁর বিশ্লেষণকে এখন বলা হয় পইসন-ল্যাপ্লাস সমীকরণ (যা গ্রহীয় বস্তুগুলোর গতিসহ পরমাণু বৈদ্যুতিক চার্জ নিয়ন্ত্রণ করে)।
তিনি দেখতে পান, চার মাত্রায় কিংবা তার চেয়ে বেশি স্থানিক মাত্রায় কক্ষপথগুলো স্থিতিশীল নয়। কারণ, এতে পরমাণুর ইলেকট্রন এবং একইভাবে গ্রহগুলো বারবার সংঘর্ষের মুখে পড়ে। এর সহজ মানে হলো, পরমাণু ও সৌরজগৎ সম্ভবত উচ্চতর মাত্রাগুলোতে টিকে থাকতে পারে না। অন্য কথায়, তিন মাত্রা আসলে বিশেষ কিছু।
পদার্থবিদ ফ্রিম্যান ডাইসন একবার বলেছিলেন, ‘এটা দেখে এ রকম মনে হয়, যেন মহাবিশ্ব জানত, আমরা আসছি।’ এটা স্ট্রং অ্যানথ্রপিক প্রিন্সিপালের একটা উদাহরণ। ধারণাটি হলো, ভৌত ধ্রুবকগুলোর ফাইন টিউনিং কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি কোনো ধরনের নকশা বা ডিজাইনের ইঙ্গিত করে। তবে মার্টিন রিজ এবং অন্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এসব মহাজাগতিক দুর্ঘটনা আসলে মাল্টিভার্সের অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়।
রিজের মতে, শত শত কাকতালীয় ঘটনার মধ্যে আমরা যে অবিশ্বাস্য রকম অতিক্ষুদ্র পরিসরে বাস করি, তার একমাত্র সমাধান হলো কোটি কোটি প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব স্বীকার করা। অগণিত মাল্টিভার্সের মধ্যে বেশির ভাগ মহাবিশ্বই হয়তো মৃত। সেখানে হয়তো প্রোটন স্থিতিশীল নয় কিংবা কোনো কোনোটায় হয়তো পরমাণুও গঠিত হয়নি, গঠিত হয়নি ডিএনএ। সেসব মহাবিশ্ব অকালেই ধসে গেছে কিংবা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জমে হিমশীতল হয়ে গেছে।
কিন্তু আমাদের মহাবিশ্বের ভেতর ধারাবাহিক মহাজাগতিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। গড়পড়তা নিয়মের কারণেই এমনটি হয়েছে বলে মনে করেন রিজ। তিনি বলেন, ‘যদি বিপুল পরিমাণ পোশাকের মজুত থাকে, তাহলে সেখান থেকে একটি মানানসই স্যুট খুঁজে পাওয়া গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অসংখ্য মহাবিশ্ব যদি থেকে থাকে, প্রতিটি যদি ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যার সেট দিয়ে পরিচালিত হয়, তাহলে সেখানে এমন একটাকে পাওয়া যাবে, যেটি প্রাণের উপযোগী নির্দিষ্ট সংখ্যার সেট দিয়ে পরিচালিত। আমরা হলাম সে রকম একটি।’
বিজ্ঞানীরা আসলে এ রকম বহুসংখ্যক সন্তোষজনক মহাজাগতিক দুর্ঘটনার দীর্ঘ তালিকা তৈরি করেছেন। এই মনোরম তালিকার মুখোমুখি হলে কতগুলো পরিচিত মহাজাগতিক ধ্রুবক খুবই ছোট্ট পরিসরের মধ্যে থেকে প্রাণকে সম্ভবপর করে তুলেছে, তা দেখে বিস্মিত হতে হয়। এসব দুর্ঘটনার মাত্র একটাও যদি বদলে যায়, তাহলে নক্ষত্র কখনোই গঠিত হতো না। স্রেফ ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত মহাবিশ্ব, ডিএনএর অস্তিত্বই থাকত না, প্রাণও হয়ে উঠত অসম্ভব, পৃথিবী বিপর্যস্ত হতো। তখন কি আর বলা যেত, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে/ কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/ কৌতূহলভরে’।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।