বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে একটি শব্দ পুনরায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে — মহার্ঘ ভাতা। সরকারি চাকরিজীবীদের মুখে মুখে ঘুরছে এই ভাতার প্রসঙ্গ, যা আসন্ন বাজেটে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। মহার্ঘ ভাতা কি? — এই প্রশ্নের উত্তর যেমন অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত, তেমনি এটি রাষ্ট্রের নীতিমালার সাথেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এটি শুধু একটি ভাতা নয়; বরং একটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যের অংশ।
মহার্ঘ ভাতা কি?
মহার্ঘ ভাতা (Dearness Allowance বা DA) হল এক ধরনের আর্থিক সহায়তা যা সরকারি ও কিছু বেসরকারি কর্মচারীদের মূল বেতনের অতিরিক্ত প্রদান করা হয়, মূলত জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিপূরণ হিসেবে। যখন বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখন কর্মচারীদের জীবনযাত্রায় যে চাপ পড়ে, তা লাঘব করতেই এই ভাতা চালু করা হয়। মূলত এটি একটি নির্দিষ্ট শতাংশ যা মূল বেতনের উপর ভিত্তি করে হিসাব করা হয় এবং প্রতি মাসে প্রদান করা হয়।
Table of Contents
উদাহরণস্বরূপ, যদি কারো বেতন হয় ১০,০০০ টাকা এবং মহার্ঘ ভাতা হয় ১০%, তাহলে তিনি প্রতি মাসে ১১,০০০ টাকা পাবেন। এটি কর্মীদের জীবনযাত্রার মান ধরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
ভারতে মহার্ঘ ভাতা একটি অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত প্রথা, যেখানে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কর্মচারীরা নির্দিষ্ট হারে DA পান। বাংলাদেশেও এই প্রথা এখনো সীমিত আকারে থাকলেও সম্প্রতি এটি বড় পরিসরে কার্যকরের পথে রয়েছে।
মহার্ঘ ভাতার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সময়কাল থেকেই এই ভাতা চালু করা হয়। তখন এটি ‘খাদ্য ভাতা’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯৪৭ সালে ‘ওল্ড টেক্সটাইল ভাতা’ নামে এক ধরণের ভাতা চালু হয়, যা ১৯৫৩ সালে ‘সংশোধিত টেক্সটাইল ভাতা’তে রূপান্তরিত হয়।
ভারতে DA প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে চালু হয় এবং পরে তা বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমে উন্নত ও পরিবর্ধিত হয়। যেমন:
- তৃতীয় কেন্দ্রীয় বেতন কমিশন: CPI ২০০ সূচকে ৮ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেলেই DA প্রযোজ্য করার সুপারিশ করে।
- চতুর্থ কমিশন: বছরে ২ বার DA পর্যালোচনার সুপারিশ করে — জানুয়ারি ও জুলাই মাসে।
- ষষ্ঠ কমিশন: CPI সূচকের ভিত্তি ২০০১=১০০ ধরে নতুন হিসাব প্রবর্তন করে।
বাংলাদেশে মহার্ঘ ভাতা সম্পর্কে বিভিন্ন সময় আলোচনা হলেও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ খুব একটা দেখা যায়নি। তবে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ও কর্মচারীদের জীবনমানের অবনতির কারণে এই বিষয়টি আবারো আলোচনায় এসেছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মহার্ঘ ভাতা কার্যকরের সম্ভাবনা
সম্প্রতি জুমবাংলা নিউজ এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসন্ন বাজেটে ১ থেকে ৯ গ্রেডের জন্য ১০% এবং অন্যান্য গ্রেডের জন্য ২০% মহার্ঘ ভাতা চালুর প্রস্তাব রয়েছে। এই হারগুলো একীভূত করে ১৫% করার দিকেও আলোচনা চলছে।
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে আনুমানিক ৬,০০০ থেকে ৬,৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে মোট বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ ছিল ৮২,৯৯০ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে দাঁড়িয়েছে ৮৪,০০০ কোটি।
মহার্ঘ ভাতা কিভাবে গণনা করা হয়?
DA হিসাব করার নির্দিষ্ট সূত্র রয়েছে যা প্রতি মাসের ভোক্তা মূল্য সূচক (CPI-IW) এর ভিত্তিতে গণনা করা হয়।
গণনার সূত্র (ভারতের ক্ষেত্রে)
- DA % = {(গত ১২ মাসের AICPI (ভিত্তি বছর ২০০১=১০০) এর গড় – ১১৫.৭৭)/১১৫.৭৭}*১০০
- বর্তমানে নতুন ভিত্তি (২০১৬=১০০) অনুযায়ী: DA = (A – 261.4)*100/(261.4), যেখানে A = গড় CPI-IW x 2.88 (লিঙ্কিং ফ্যাক্টর)
এই সূত্র গুলো বাংলাদেশেও প্রয়োগ করা যেতে পারে ভবিষ্যতের জন্য, বিশেষত যদি দেশীয় CPI ডেটা অনুযায়ী স্থায়ী পদ্ধতি চালু করা হয়।
মহার্ঘ ভাতার প্রভাব ও গুরুত্ব
এই ভাতা চালু হলে সরকারি কর্মচারীদের জন্য জীবনযাত্রার খরচ সামাল দেওয়া সহজ হবে। অর্থনৈতিক চাপ কমবে এবং চাকরি-সন্তুষ্টির হার বাড়বে। সেই সাথে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা ও মনোবলও বৃদ্ধি পাবে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এর মতে, বাংলাদেশে অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতি এখনো স্থিতিশীল রয়েছে যা এই ধরনের নীতিনির্ধারণে সহায়ক হতে পারে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, এই ভাতা চালু হলে কর্মচারীদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক চক্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
মহার্ঘ ভাতা কি? — এই প্রশ্নের উত্তর এখন শুধুমাত্র তথ্য নয়, বরং এটি দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্যের দিকেও নির্দেশ করছে।
FAQs
- মহার্ঘ ভাতা কি?
মহার্ঘ ভাতা হলো জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি রোধে সরকারি ও নির্দিষ্ট বেসরকারি কর্মচারীদের মূল বেতনের অতিরিক্ত আর্থিক ভাতা। - মহার্ঘ ভাতা কবে থেকে কার্যকর হবে?
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এটি কার্যকরের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর নেওয়া হবে। - এই ভাতার হার কত হবে?
১-৯ গ্রেডের জন্য ১০% এবং অন্যান্যদের জন্য ২০% হারে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, তবে একীভূত করে ১৫% করার প্রস্তাবও আলোচনায় রয়েছে। - মহার্ঘ ভাতা কাদের জন্য প্রযোজ্য?
সব সরকারি গ্রেডভুক্ত কর্মচারীদের জন্য এটি প্রযোজ্য হবে। - এর আর্থিক প্রভাব কেমন হবে?
সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় আনুমানিক ৬০০০ থেকে ৬৫০০ কোটি টাকা হতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।