যুক্তরাষ্ট্রের সরকার মাংসখেকো মাছির লার্ভা মোকাবিলায় এক অভিনব পরিকল্পনা নিয়েছে। বিলিয়ন বিলিয়ন মাছি প্রজনন করে সেগুলো মেক্সিকো ও দক্ষিণ টেক্সাসে বিমান থেকে ফেলা হবে। শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও এটি যুক্তরাষ্ট্রের গরুর মাংস শিল্প, বন্যপ্রাণী এবং গৃহপালিত প্রাণীদের সুরক্ষায় বিজ্ঞানভিত্তিক একটি কার্যকর পদ্ধতি।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তর (ইউএসডিএ) বলছে, তারা ‘নিউ ওয়ার্ল্ড স্ক্রুওয়ার্ম’ নামের মাংসখেকো মাছির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পুরোনো পদ্ধতি আবার শুরু করছে। এসব প্রজাতির স্ত্রী মাছিরা জীবন্ত প্রাণীর ক্ষতস্থান বা মিউকাসে ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে বের হওয়া লার্ভা সেই প্রাণীর জীবন্ত মাংস খেতে শুরু করে। এক হাজার পাউন্ড ওজনের একটি গরুকেও মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে মেরে ফেলতে পারে এই লার্ভা।
এই মাছিরা একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো অঞ্চলে মারাত্মক হুমকি ছিল। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ইউএসডিএ ও মেক্সিকো মিলে প্রায় ৯৪ বিলিয়ন প্রজননে অক্ষম মাছি ছেড়ে এদের নির্মূল করেছিল। এরপর মধ্য আমেরিকার পানামায় একটি মাছি প্রজনন কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রজননে অক্ষম মাছি ছেড়ে উত্তর দিকের অঞ্চলগুলোকে নিরাপদ রাখা হতো।
তবে ২০২৪ সালের শেষ দিকে দক্ষিণ মেক্সিকোতে আবার স্ক্রুওয়ার্মের উপস্থিতি ধরা পড়ে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।
এ ধরনের মাছিদের প্রতিরোধের মূল অস্ত্র—পুরুষ মাছিদের প্রজননে অক্ষম করে তোলা। পুরুষ স্ক্রুওয়ার্ম মাছিদের রেডিয়েশনের মাধ্যমে প্রজননে অক্ষম করে বনে ছেড়ে দেওয়া হবে। স্ত্রী মাছিরা মাত্র একবারই প্রজননের জন্য সঙ্গী নির্বাচন করে থাকে, ফলে প্রজননে অক্ষম পুরুষ মাছির সঙ্গে মিলনের পর ডিম ফুটে আর লার্ভা বের হবে না। ফলে ধীরে ধীরে মাছির সংখ্যা কমে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কীটনাশক ব্যবহারের চেয়ে অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব এবং কার্যকর। কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির কিটবিজ্ঞানী ক্যাসান্দ্রা ওল্ডস বলেন, মাছি প্রজননের জন্য সঠিক পরিবেশ ও পুষ্টি নিশ্চিত করাই মূল চ্যালেঞ্জ।
একসময় লার্ভাদের খাবার হিসেবে ঘোড়ার মাংস ও মধু ব্যবহার করা হতো। পরে মাছির লার্ভার জন্য তৈরি খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয় ডিমের গুঁড়া, গরুর রক্ত ও প্লাজমা দিয়ে প্রস্তুত বিশেষ খাদ্য। পরিণত লার্ভা যখন পিউপায় (গুটিপোকা) রূপ নিতে প্রস্তুত হয়, তখন তারা গরু বা প্রাণীর শরীর থেকে মাটিতে পড়ে যায় এবং মাটির নিচে ঢুকে গুটিপোকার আবরণে বেড়ে ওঠে। পানামা প্রজনন কেন্দ্র স্ক্রুওয়ার্ম মাছির পিউপাগুলো মাটির বিকল্প হিসেবে করাতকাঠে রাখা হয়, যাতে তারা প্রাপ্তবয়স্ক মাছিতে রূপ নিতে পারে।
বর্তমানে পানামার প্রজননকেন্দ্রটি প্রতি সপ্তাহে ১১৭ মিলিয়ন মাছি উৎপাদনে সক্ষম হলেও ইউএসডিএর লক্ষ্য সপ্তাহে ৪০০ মিলিয়ন মাছি উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করা। এ জন্য তারা দক্ষিণ টেক্সাসে একটি নতুন বিতরণকেন্দ্র গড়ে তুলছে, যেখানে পানামা থেকে আনা মাছি সংরক্ষণ ও ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। একই সঙ্গে দক্ষিণ মেক্সিকোর একটি পুরোনো ফল মাছির প্রজননকেন্দ্রকে স্ক্রুওয়ার্ম মাছির জন্য উপযোগী করতে ২১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিমান থেকে মাছি ছাড়ার কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মাছি ছড়ানোর সময় একটি আকাশপথ মিশনের সময় মেক্সিকো ও গুয়াতেমালার সীমান্ত এলাকায় একটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে এবং ওই বিমানে থাকা তিনজন নিহত হন। ১৯৫০-এর দশকে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে কাগজের কাপ ব্যবহার করে মাছি ফেলা হতো। পরে ‘হুইজ প্যাকার’ নামের যন্ত্র দিয়ে কাঠের বাক্সে মাছি ভরে বিমানে তোলা হয়।
এখনো একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়—হালকা বিমান থেকে এসব বাক্স ফেলা হয় নির্দিষ্ট এলাকায়।
ইউএসডিএর সহযোগী অধ্যাপক এডউইন বার্জেস বলেন, ‘এটি বিজ্ঞানকে বাস্তব সমস্যার সমাধানে কাজে লাগানোর এক অনন্য উদাহরণ।’ তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘যে সমস্যাকে একসময় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে বলে মনে করা হয়, সেটি আবার নতুনভাবে ফিরে আসতে পারে।’
এ জন্যই কৃষি কর্মকর্তারা চান নতুন প্রজননকেন্দ্রগুলো যেন ভবিষ্যতের জন্য চালু রাখা হয়।
স্ক্রুওয়ার্ম পুনরায় দক্ষিণমুখী হওয়ার হুমকিতে মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ সীমান্তে গরু, ঘোড়া ও বাইসনের আমদানি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। এ নিষেধাজ্ঞা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলবে।
এদিকে, নতুন প্রজননকেন্দ্রগুলো নির্মাণে ব্যয় হবে ৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার (টেক্সাসে) ও ২১ মিলিয়ন ডলার (মেক্সিকোতে)। নিরাপত্তার দিকটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—যাতে প্রজনন করতে পারে, এমন কোনো মাছি বাইরে ছড়িয়ে না পড়ে।
তথ্যসূত্র: এপি নিউজ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।