সাঈদুর রহমান রিমন, (বাংলাদেশ প্রতিদিন) : মাদকাসক্তদের চিকিৎসার নামে ভয়াবহ টর্চার সেল গড়ে তুলেছে গুলশানের মুক্তি ক্লিনিকে। সেখানে মাদকাসক্তদের নিরাময়ের নামে লাখ লাখ প্যাকেজের আওতায় মাসের পর মাস রোগীদের বন্দীদশায় রাখা হলেও সুস্থতা ফিরে পায় না কেউ। শুধু তাই নয়, মাদকাসক্তের চিকিৎসার নামে প্রতিপক্ষকে এ বন্দীশালায় আটকে অকথ্য নির্যাতন চালানোরও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে হাতেনাতে প্রমাণ পেয়ে আট লাখ টাকা জরিমানা করে। দফায় দফায় সতর্কও করা হয়েছে। তবুও মুক্তি ক্লিনিকের অপরাধ অপকর্ম বন্ধ হচ্ছে না কোনোভাবেই। এর আগে ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর রাজধানীর গুলশান এলাকার একটি মাদকাসক্তি নিরাময় ক্লিনিকে চিকিৎসার নামে নির্যাতনের অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে অভিযান চালায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এ সময় মুক্তি ক্লিনিক নামে ওই প্রতিষ্ঠানকে ৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
র্যাব-১-এর নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম। গতকাল মো. সারওয়ার আলম বলেন, যতদূর মনে পড়ে, আমরা অনেক অনিয়ম পেয়েছিলাম ওই মুক্তি ক্লিনিকে। ওইগুলোর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও ছিল। যা বড় ধরনের প্রতারণা রোগীদের সঙ্গে। র্যাব সূত্রে জানা যায়, মানসিক ও মাদকাসক্ত রোগীদের সঠিক চিকিৎসা না দিয়ে শারীরিক নির্যাতন করার দায়ে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন খাবার সরবরাহের কারণে গুলশান-২ এলাকায় মুক্তি ক্লিনিককে ৮ লাখ টাকা জরিমানা করেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
অভিযানকালে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় যে, সঠিক কারণ ছাড়াই রোগীদের মাত্রাতিরিক্ত বিভিন্ন ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও নার্স ছাড়াই পরিচালনা করা হয়। অধিকাংশ রোগী কোনো বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিতে চাইলে তাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয় এবং বেশি পরিমাণে ঘুমের ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের শারীরিকভাবে দুর্বল করে রাখা হয়। এ সময় একজন আবাসিক চিকিৎসককে পাওয়া যায়, যিনি নিজেই মাদকাসক্তের কারণে এ ক্লিনিকে ছয় মাস চিকিৎসাধীন।
বর্তমানে তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি এবং আদালতে উপস্থিত বিশেষজ্ঞ দল তাকে পুরোপুরি সুস্থ নন বলে অভিমত দেন। এসব মাদকাসক্ত চিকিৎসক দ্বারা রোগীদের বেধড়ক মারধোর করানোসহ নানা মাত্রায় শাস্তি দেওয়ার অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। দেশের প্রথম মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র দাবি করে সরকারি-বেসরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেওয়া মুক্তি ক্লিনিক এখন পুরোপুরি বাণিজ্যিক অপরাধ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এ ক্লিনিকের টর্চার সেলকে ব্যবহার করেই জায়গা জমি নিয়ে বা অন্য কোনো শত্রুতাবশত প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। চাহিদা মাফিক টাকা ধরিয়ে দিয়ে যে কোনো সুস্থ ব্যক্তিকেও মাদকাসক্ত বানিয়ে অনায়াসে মুক্তির টর্চার সেলে মাসের পর মাস আটকে রাখা যায়। এর আগে টঙ্গী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক সমিতির সাবেক সভাপতি হোসেন মোক্তারকে (৭০) তার ছেলেরা মাদকাসক্ত ও মানসিক রোগী সাজিয়ে মুক্তি ক্লিনিকে আটকে রাখার ব্যবস্থা করেন।
ছেলেদের লিখে দেওয়া সম্পত্তি ফেরত চাওয়ায় এবং তার অবশিষ্ট সম্পত্তি ছেলেদের নামে লিখে না দেওয়ায় এ নির্মম ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, গত রবিবার সকালে টঙ্গীর আউচপাড়ার মোক্তারবাড়ি রোডের একটি দোকান থেকে হোসেন মোক্তারবাড়ি ফেরার পথে তার বড় ছেলে রফিকুল ইসলাম ও ছোট ছেলে মাজহারুল ইসলাম জোর করে তাকে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। এরপর থেকে তার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার সন্তানরা তাকে মাদকাসক্ত ও মানসিক রোগী বানিয়ে রাজধানীর গুলশানে মুক্তি নামের একটি মাদকাসক্ত কেন্দ্রে ভর্তি করিয়েছেন।
আউচপাড়ার সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ আলেক গণমাধ্যমকে বলেন, হোসেন মোক্তার তার মোট সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ তার দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে বণ্টন করে দেন। এ ছাড়া চার ছেলে-মেয়েকেই তিনি পৃথক পাকা বাড়ি করে দিয়েছেন।
কিন্তু ছেলেরা তাকে দেখাশোনা না করায় এবং তারা মাদকাসক্ত ও অবাধ্য হওয়ায় তিনি তাদের শাসন করেন এবং লিখে দেওয়া সম্পত্তি ফেরত চান। এ নিয়ে মামলাও করেন আদালতে। এতে ছেলে-মেয়েরা তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বাকি সম্পত্তি তাদের নামে লিখে দিতে বলেন। লিখে না দিলে তাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। এ নিয়ে একাধিকবার শালিস হয়; কিন্তু ছেলেরা বাপের কোনো কথাই মানতে নারাজ। যোগাযোগ করা হলে হোসেন তার দুই ছেলে রফিকুল ইসলাম ও মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘তিনি মানসিক রোগী, তাই তাকে গুলশানের মুক্তি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।