জুমবাংলা ডেস্ক : আন্তর্জাতিক মহলে ‘দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় থাকা নারী নেত্রী’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্ব গণমাধ্যম তাকে বলেছিল ‘মানবতার জননী’। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার সাফল্য বহুবার আলোচিত হয়েছে। তবে নিজ দেশের জনগণের বড় একটি অংশের কাছে ছিলেন শেখ হাসিনা নিপীড়নের প্রতিচ্ছবি—এক শাসক, যার শাসন ছিল ভয়, দমন ও নিঃসঙ্গতার। শাসনের শেষ পর্যায়ে তাকে ঘিরে উচ্চারিত হয়েছে ‘জুলুমের রাণী’ অভিধা।
সাম্প্রতি প্রকাশিত আন্তজার্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার এক বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব চিত্র।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উত্থান হয়েছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বানে। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নেত্রী হিসেবে ফিরে এসেছিলেন দেশে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে সেই আখ্যান। দ্বিতীয় মেয়াদ থেকেই শুরু হয় বিরোধী দল ও মতের প্রতি কঠোর দমননীতি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচন এবং বিরোধীদলের অংশগ্রহণ ছাড়া গঠিত সংসদ তার সরকারের গণতান্ত্রিক ভিত্তি নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলে। দেশজুড়ে শুরু হয় গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার দুঃসময়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশে গুমের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ে। সরকার বিরোধীদের ওপর চালানো হয় নানা অত্যাচার নিপীড়ন। গুম খুন কমিশন বলছে, কবর কতজনকে দেয়া হয়েছে জানি না। তবে অনেককে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হয়েছে, বিভিন্ন সেতুর ওপর থেকে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয়েছে, বস্তাবন্দি করে ফেলা হয়েছে, হত্যা করে ট্রেনের তলে ফেলা হয়েছে যাতে লাশ বিকৃত হয়ে যায়। এই ধরনের অপরাধ কিন্তু এই শেখ হাসিনার নির্দেশে হয়েছে। আর এই কাজে সহযোগীতা করেছে র্যাব, ডিবি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বছরের পর বছর নিখোঁজ রয়েছেন এমন শত শত পরিবার অপেক্ষায় দিন গুনছে।
একের পর এক ঘটনার প্রেক্ষিতে, সরকারি চাকরিতে কোটা-ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় গত ২০২৪ সালের জুলাই মাসে, এটি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছিল। কিন্তু কোনো স্বৈরাচারই প্রতিবাদ/বিক্ষোভকে মানে না, শেখ হাসিনাও আন্দোলনের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর দমনাভিযান চালান। হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নামে, সরকারের দমন-পীড়নের মুখে নিহত হন অনেক তরুণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারদিকে গুলির শব্দে যখন বাতাস ভারী, তখনই সাধারণ শিক্ষার্থীরা অভ্যুত্থান ঘটায়। গত ৫ আগস্ট সারাদেশ থেকে আসা ছাত্র-জনতা প্রবেশ করে রাজধানীতে, তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছিলেন গণভবনের দিকে। শেষ পর্যন্ত দখল করে গণভবন, যেই জায়গা থেকে শেখ হাসিনা এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রায় একচ্ছত্রভাবে শাসন করে এসেছিলেন। তখন দেশ ছেড়ে হেলিকপ্টারে চড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা।
আজ সেই এক সময়কার জাঁকজমকপূর্ণ গণভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। আর শেখ হাসিনার প্রতিচ্ছবিও ইতিহাসের পাতায় এক বিপরীত দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে—গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে কীভাবে একনায়কতন্ত্রের দিকে গড়াতে পারে একজন নেতা।
তারপর থেকেই একের পর এক উন্মোচিত হতে থাকে শেখ হাসিনার শাসনামলের অন্ধকার অধ্যায়। আলোচনায় আসে বিশ্বের চোখে যাঁকে দেখা হয়েছিল নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রদূত হিসেবে, শিক্ষার উন্নয়ন আর দারিদ্র্য হ্রাসে রোল মডেল হিসেবে, সেই নেত্রীর বিরুদ্ধে উঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুন ও দুর্নীতির ভয়ংকর অভিযোগ। তার নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে গুম ও হত্যা করার। অনেকে বলেছেন, প্রতিরাতেই তারা ভাবতেন, আগামী সকালটা হয়তো দেখা হবে না।
তবে এই আন্দোলনের পেছনে দাঁড়ানো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক সাহসী তরুণ। মিতু আখতার, আবদুল কাদের, মীরা ও রিফাত রশীদ—তাঁরা ছিল এই আন্দোলনের সামনের সাড়িতে। দিনের পর দিন গুলি আর সাঁজোয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থেকেছেন তাঁরা। তাঁদের চোখের সামনে মারা গেছেন সহযোদ্ধারা। আন্দোলনটি যে শুধু কোটা সংস্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা এক সময় রূপ নেয় স্বৈরাচার পতনের জাতীয় আন্দোলনে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানায়, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকেই গুমের সংখ্যা হু-হু করে বাড়তে থাকে। এমন এক দুঃসহ বাস্তবতার মধ্যে গঠিত হয় ‘মায়ের ডাক’ নামে এক সংগঠন, যেখানে নিখোঁজদের পরিবার একত্রিত হয়ে খোঁজ করে প্রিয়জনের। একজন মায়ের কান্না, একজন বোনের অপেক্ষা কিংবা একজন সন্তানের ভয়ই হয়ে ওঠে এই আন্দোলনের ভাষ্য।
বিশেষ করে ‘হাউজ অব মিররস’ নামে একটি গোপন কারাগারের কথাই ঘিরে রয়েছে সবচেয়ে ভয়ংকর সব অভিযোগ। সেখানেই আটক রাখা হয়েছিল সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আজমীকে। আট বছর ধরে অন্ধকার ঘরে বন্দী জীবন, সূর্যের আলো না দেখা, মানবিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার এই অভিজ্ঞতা তাঁকে মানসিকভাবে গুঁড়িয়ে দেয়।
আজ যখন এইসব সত্য উন্মোচিত হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছে একটি তদন্ত কমিশন। নিখোঁজদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, অপরাধীদের চিহ্নিত করতে শুরু হয়েছে অনুসন্ধান। তবে অনেকেই মনে করেন, শেখ হাসিনার আমলে ঘটে যাওয়া বহু নিখোঁজের খবর হয়তো কোনোদিনও আর জানা যাবে না।
দেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এককালের ‘মানবতার প্রতীক’ হিসেবে যাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, ইতিহাস তাঁকে এখন দেখছে এক উল্টো আয়নায়—এককেন্দ্রিকতার প্রতীক, জুলুমের রাণী হিসেবে। প্রশ্ন উঠেছে—এই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বাংলাদেশ কি আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? জনগণের শক্তি কি সত্যিই টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? এর উত্তর আগামীই বলবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।