পৃথিবী থেকে শুধু টেলিস্কোপ দিয়ে গ্রহ দেখে দেখে সেগুলো নিয়ে অনুসন্ধান চালানো কঠিন। মানুষের আজন্ম সাধ নিজে সেখানে যাবে, সব কিছু নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখবে, নিজের চোখে দেখবে, নিজ কানে শুনবে, নাকে গন্ধ নেবে।
কী মজারই-না হতো যদি আমরা জানতে পারতাম অন্যান্য গ্রহে অন্তত প্রাণের কোনো চিহ্ন আছে কি না, অন্তত কোনো রকম উদ্ভিদ বা প্রাণী আছে কি না! সবচেয়ে বড় কথা, যেকোনো গ্রহেই হোক, বুদ্ধিমান প্রাণীর সঙ্গে দেখা করার বড় সাধ মানুষের।
কী রকম হবে সেই প্রাণী? আমাদের মতন? নাকি নয়? একেকটি গ্রহ এই বিশাল, অকূল মহাকাশের বুকে যেন একেকটি ছোট ছোট দ্বীপ। তাদের মাঝখানে কোটি কোটি কিলোমিটারের ব্যবধান। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে কীভাবে যাওয়া যায়? কীসে চড়ে?
তোমরা এখন জানো, বেলুন বা অ্যারোপ্লেন—কোনোটাই এ কাজের উপযুক্ত নয়। বেলুন আকাশে ভাসে। অ্যারোপ্লেন বাতাসে ডানা ভর দিয়ে চলে। বেলুন বা অ্যারোপ্লেন কেবল ততটা উঁচুতেই উঠতে পারে, যেখানে যথেষ্ট পরিমাণ ঘন বায়ু আছে, যেখানে বায়ুমণ্ডল যথেষ্ট ঘন। কিন্তু যেখানে বায়ুমণ্ডল শূন্যে এসে ঠেকেছে, শেষ হয়ে গেছে, সেখানে এর ওড়া সম্ভব নয়। গাছ নিজে যতটা উঁচু, গাছ বেয়ে কি আর তার চেয়ে উঁচুতে ওঠা যায়?
গ্রহে যাত্রার একেবারে গোড়ার পথটাই শুধু বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে গেছে। বাকি সবটা পথ গেছে মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে। কিন্তু লোকে যেমন নালা-নর্দমা লাফিয়ে পার হয়, তেমনি মহাশূন্যও লাফিয়ে পার হওয়া যায়।
মানুষ অনেক দিন পর্যন্ত জানত না, এটা কীভাবে সম্ভব। জানত না, কীভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে গতিবেগ সঞ্চয় করে হঠাৎ এক প্রচণ্ড ঠেলা মেরে লাফিয়ে অন্য গ্রহে পৌঁছানো যায়। লোকে জানতে পারল তখনই, যখন অসাধারণ রুশ বিজ্ঞানী কন্সট্যানটিন এদোয়ার্দভিচ জাল্কোভস্কি বললেন, মহাশূন্য ডিঙিয়ে গ্রহান্তরে যাওয়া যায় একমাত্র রকেটে চেপে।
রকেটে কয়েক মিনিটে বিপুল পরিমাণে জ্বালানি খরচ হয়। কান ফাটানো শব্দে রকেটের নিচ থেকে আগুন বেরিয়ে আসে, দানবীয় শক্তিতে রকেটকে ঠেলা মারে সামনের দিকে। এমনকি রেললাইনের ওপর ভারী ভারী রেলগাড়ি টানার উপযোগী যে সব ডিজেল ইঞ্জিন আছে, মহাকাশগামী একটা ছোটখাটো রকেটও তাদের চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী!
এরকম অলৌকিক শক্তির অধিকারী হওয়ায় ভারী রকেট অবলীলায় মাটির টান ছেড়ে ওপরে উঠে পড়ে, অতি দ্রুত তার গতিবেগ বাড়তে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে রকেট মেঘ ভেদ করে বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে মহাকাশে বেরিয়ে আসে। সেখানে, মহাশূন্যতার মধ্যে কোনো রকম বাধা না থাকায় প্রমত্ত বেগে ধেয়ে চলে! সেই সময় তার বেগ হয় আমাদের আধুনিক ‘তু-১৫৪’ যাত্রীবাহী জেটপ্লেনের ৫০ গুণ দ্রুত।
এরকম অবিশ্বাস্য গতিতে পৃথিবী ছাড়ার পর রকেট স্তব্ধ হয়ে যায়। ‘লাফ’ দেওয়ার পর এখন সে ফাঁকা মহাকাশে উড়তে থাকবে খাদের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া ঢিলের মতো।
ঢিল সরল রেখায় না গিয়ে ধনুকের মতো হয়ে মাটির দিকে বাঁক নেয়। রকেটও মহাকাশে সরল রেখায় ওড়ে না, উড়তে উড়তে সূর্যের দিকে বাঁক নেয়। তাই রকেট এমন ভাবে ছাড়তে হবে, যাতে বাঁক নিয়ে শেষ পর্যন্ত যেখানে দরকার, ঠিক সেই জায়গায় গিয়ে পড়ে। ভুলে যেয়ো না, যে গ্রহটা তোমার লক্ষ্যস্থল, সেটাও কিন্তু এক জায়গায় স্থির হয়ে নেই। সেটা সূর্যের চারধারে ঘুরছে। তার মানে, ফাঁকা জায়গা নিশানা করে এমনভাবে হিসেবটা করতে হবে যাতে রকেট উড়তে উড়তে কয়েক মাস পরে এই জায়গাটায় এসে গ্রহের সঙ্গে মিলতে পারে। মোট কথা, কাজটা দারুণ জটিল। কিন্তু মানুষ এ কাজে সক্ষম হয়েছে।
১৯৫৭ সালে সোভিয়েত মহাকাশবন্দর বাইকোনূর থেকে পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ আকাশে উৎক্ষিপ্ত হয়। ১৯৫৯ সালেই মানুষ অন্যান্য গ্রহে মহাকাশযান পাঠানোর জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। মানুষ প্রথম ‘আকাশের চাঁদ হাতে ধরল’—সোভিয়েত স্টেশন ‘লুনা-২’ সেখানে একটা প্রতীক নিশান পাঠায়। এর পর থেকে সোভিয়েত ও মার্কিন আন্তঃমহাকাশ স্বয়ংক্রিয় স্টেশনগুলো একের পর এক মহাকাশ চষতে থাকে।
গত আড়াই দশকের মধ্যে ওই সব স্বয়ংক্রিয় স্টেশন চাঁদ, বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনির কাছাকাছি যায়, নিজেদের সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি দিয়ে কাছাকাছি দূরত্ব থেকে গ্রহগুলোর ওপর অনুসন্ধান চালায়, তাদের ছবি তোলে, বেতারে আমাদের কাছে কাজের ফলাফল ও চমৎকার চমৎকার ছবি পাঠায়।
চাঁদ, শুক্র ও মঙ্গলের বুকে মহাকাশযান নিরাপদে অবতরণ করে সেখানকার মাটি ও বায়ুমণ্ডলের গঠনপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করেছে, আশপাশের এলাকার ছবি তুলেছে। ওই সব জায়গায় তারা প্রাণের লক্ষণ খুঁজে বেড়িয়েছে। চাঁদ থেকে পাহাড়ি খনিজ পদার্থের নমুনা পৃথিবীতে পাঠিয়েছে।
কিন্তু তার অর্থ মোটেই এই নয় যে আজ যেকোনো মানুষ বিশেষ প্রস্তুতি ছাড়াই রকেটে চড়ে মঙ্গল বা ওরকম কোনো গ্রহে যাত্রা করতে পারে। মানুষ বড় কোমল, ঠুনকো জীব। পৃথিবীতে কোনো মহামূল্যবান মাছকে জ্যান্ত কোথাও পাঠাতে গেলে তার পেছনে যেমন যত্ন নিতে হয়, মানুষকে মহাকাশে পাঠাতে গেলেও সেরকম যত্ন নিতে হয়। মাছটাকে রাখতে হয় একটা জলভরা কাচের বয়ামে, জল যাতে না ছলকায়, যাতে বেশি গরম না হয়ে যায়, নোংরা না হয়, সেই দিকে রীতিমতো নজর রাখতে হয়। মাছকে খাবার দেওয়ার কথা ভুললে চলবে না।
মানুষের কাছে মহাকাশযান হলো ‘বাতাস ভরা বয়াম’। এই বয়ামের ভেতরকার মানুষকে নিয়ে যে ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়, সেই তুলনায় বয়ামের মাছ নিয়ে ঝঞ্ঝাট অনেক কম। এই কারণে মানুষ একেবারে শুরু থেকে যতটা সম্ভব স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।