সিরাজুল আরিফিন : পেনিওয়াইজকে মনে পড়ে?
মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তির মধ্যে অন্যতম একটি প্রবৃত্তির নাম ভয়। ক্ষুধা, কষ্ট বা রাগের মতো খুবই পরিচিত এবং সাধারণ অনুভূতি এই ভয়ের অনুভূতি। সাধারণত বিপদে পড়লে বা প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে মানুষের মধ্যে ভয়ের উদ্রেক ঘটে থাকে। মৃত্যুচিন্তা, শারীরিক আঘাত বা ভীষণ বিপদের আশংকার মতো বিষয়গুলিতে ভয় কখনোই কারো কাছে কাঙ্ক্ষিত নয়।
আবার ঘরের আলো নিভিয়ে সব ভাই-বোন একসাথে বসে গা ছমছমে ভূতের গল্প শুনে ভয় পেতে ভালোবাসেনা, এমন শিশু-কিশোর খুঁজে পাওয়া ভার। কিংবা রগরগে হরর মুভি থেকে মানুষের প্রত্যাশাই থাকে যে সে ভয় পাবে। একদম পিলে চমকানো ভয়ের সিনেমা দেখে যদি মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত বয়ে যায়, তাহলে সময় উশুল, পয়সা উশুল। একইরকম অনুভূতি পেতে রোলার কোস্টারে চড়তেও মানুষের আপত্তি থাকেনা। এই যেচে পড়ে ভয় পাওয়ার পেছনের রহস্যও কিন্তু বেশ রোমাঞ্চকর।
সাধারণত দিনের পুরো সময়টা জুড়ে কেউ ভয় পায়না। কিন্তু যখনই চারপাশের কোনো শব্দ, দৃশ্য বা চিন্তা একজন মানুষকে বিরূপ পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়, সবার আগেই মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। এই অনুভূতি চলে আসছে হাজার হাজার বছরের আদিম পূর্বপুরুষদের থেকে। তখনকার দিনে বন্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে সতর্ক থাকার জন্য যে ভীতি থাকতো সর্বক্ষণ, সেটাই বংশগতির ধারায় প্রবাহিত হয়ে এখনো ফিরে ফিরে আসে সকলের মাঝে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে খুব সহজেই মস্তিষ্ক বুঝে নিতে পারে, কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। আর হরর সিনেমার আবহ সঙ্গীত বা আচমকা ভীতিকর দৃশ্যে এমনটাই হয়।
ভয়ের প্রক্রিয়া যতোটা সহজে বলা হয়, বাস্তবে তা ততোটাই প্যাঁচালো। বাস্তবে ভয় পাওয়ার সময় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের অসংখ্য উদ্দীপনা যেমন জড়িত, তেমনি জড়িয়ে আছে নানান হরমোনের রসায়ন। সেসব বিজ্ঞানের জটিল ধাঁধার তত্ত্বকথা না জানলেও উত্তেজনার সাথে সংশ্লিষ্ট স্ট্রেস হরমোন অ্যাড্রেনালিনের নাম জেনে রাখা যেতে পারে। ভয় পাওয়ার পর অ্যাড্রেনালিন হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বাড়িয়ে দেয়। এমনকী পেশিতে রক্তসঞ্চালনের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়।
ভয় পাওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হলো, কিন্তু এখানে আনন্দের উৎস কী? এই প্রশ্নের উত্তরও সহজ। যেহেতু গল্পে শোনা বা সিনেমায় দেখা ভয়ংকর মুহূর্ত সরাসরি মানুষের জীবনে আঘাত ফেলছেনা, মস্তিষ্ক নিজে থেকেই বুঝে নেয় স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে আসাকে। তৎক্ষনাৎ মস্তিষ্ক থেকে আনন্দ ও পরিতৃপ্তির হরমোন নিঃসৃত হতে শুরু করে অ্যাড্রেনালিনের পরিবর্তে। আর ভয় কেটে গিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে পারার অনুভূতি এতোটাই তীব্রভাবে আকর্ষণীয় যে বারবার মানুষ গাঁটের পয়সা খরচ করে যায় ভৌতিক সিনেমা দেখতে, চেপে বসে রোলার কোস্টারে, কোমরে দড়ি বেঁধে ঝাঁপ দেয় পাহাড়ের চুড়া থেকে।
মোটা দাগে বলতে গেলে শরীরজুড়ে চলতে থাকা হরমোনের খেলা আর তার সাথে পূর্বপুরুষদের থেকে বিবর্তনের ধাপে ধাপে পাওয়া অনুভূতির মিশ্রণই ভয়কে ভালোবাসতে শেখায়। সাধারণত শব্দ শুনে ভয় পাওয়ার তীব্রতা সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। কোন ধরণের শব্দে ভীতি বেশি এ নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি। আচমকা জোরালো বা অপ্রত্যাশিত শব্দের কারণে হরর সিনেমার যে দৃশ্য রক্ত হিম করে দেয়, শব্দ বন্ধ করে দেখলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে ভয়ই চলে যায়। এছাড়া আলো-অন্ধকারের কারণেও দেখা দেয় ভয়ের তারতম্য।
এইসব কিছু ছাপিয়েও সবাই যে ভয় পেতে ভালোবাসবেন এমনটা কখনোই নয়। হরর জনরার সিনেমা প্রচুর জনপ্রিয়, এবং চলচ্চিত্রপ্রেমীদের অনেকের কাছেই রোমাঞ্চকর হলেও এমন অনেক মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে যারা হরর সিনেমার নাম শুনলেই কপাল কুঁচকে ফেলেন বিরক্তিতে। আবার ভয়ের অনুভূতি অনেকক্ষেত্রে মারাত্মক আকার ধারণ করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়।
বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্নভাবে ভয়ের প্রকাশের অনেকখানিই নির্ভর করে ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, বেড়ে ওঠার ধরণ, ব্যক্তিত্ত্বের বিকাশ ইত্যাদির ওপর। বয়স ও লিঙ্গভেদেও ভয় পাওয়ার আকর্ষণের ভিন্নতা তৈরি হয় মানুষের মধ্যে। তবে, ক্ষণস্থায়ী ভয়ের ক্ষেত্রেই ভয় থেকে আনন্দের সংশ্লিষ্টতা থাকে। যেখানে বাঁচা-মরার সংকট, তেমন পরিস্থিতিতে আর যাই হোক, ভয়ের প্রতি ভালোবাসার জায়গা থাকেনা।
সিরাজুল আরিফিন বর্তমানে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।