আন্তর্জাতিক ডেস্ক : চীনের একটি গবেষণা জাহাজের চলতি সপ্তাহে মালদ্বীপের একটি বন্দরে ভিড়ার কথা, যা নিয়ে বেইজিং, দিল্লি ও মালের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে।
দাপ্তরিকভাবে চীনা জাহাজ শিয়াং ইয়াং হং ৩ মালদ্বীপের বন্দরে যাচ্ছে ‘পোর্ট কলে’। ওই বন্দরে ভিড়ার পর জাহাজটির কর্মীদের একাংশ জাহাজটি ছাড়াবে, তাদের স্থলে নতুন আরেকদল কর্মী তাতে উঠবে আর জাহাজটি তাদের শেষ হয়ে আসা রসদ পূরণ করে নেবে।
সাগরে দীর্ঘ ভ্রমণে থাকা জাহাজগুলোর ক্ষেত্রে নিকটবর্তী বন্দরে যাত্রাবিরতি করা নিয়মিত ঘটনা হলেও চীনা জাহাজটি ক্ষেত্রে এটিকে ‘নিরীহ যাত্রাবিরতি’ হিসেবে দেখছে না দিল্লি; বরং এটিকে কম করে হলেও ‘কূটনৈতিক উপেক্ষা’ হিসেবে বিবেচনা করছে তারা। তবে দিল্লির কারও কারও আশঙ্কা, এটি গবেষণার নামে তথ্য সংগ্রহের একটি মিশন হতে পারে, যা পরে চীনের সামরিক বাহিনী তাদের ডুবোজাহাজ চালানোর কাজে ব্যবহার করবে।
মালদ্বীপের বন্দরে যাচ্ছে চীনা জাহাজ, উদ্বেগে ভারত
বিবিসি জানিয়েছে, চীনের বিশেষজ্ঞরা দিল্লির এসব উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়েছেন।
চীনের সামরিক বাহিনী গণমুক্তি ফৌজের সাবেক কর্নেল জউ বো বলেছেন, “চীনের জাহাজটি ভারত মহাসাগরে বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা করছে। এটি পুরোপুরি বৈধভাবে গভীর সাগরে এসব কাজ করছে।
“মাঝে মাঝে জাহাজগুলোর জ্বালানি, খাবার ও পানির মতো রসদ পূরণ করে নিতে হয়। এ কারণে তাদের তৃতীয় দেশের বন্দরে নোঙর করতে হয়, যা স্বাভাবিক। তাই ভারত সরকারের উচিত না এটি নিয়ে কোনো হইচই করা। ভারত মহাসাগর ভারতের (মালিকানাধীন) মহাসাগর না।”
জউ বো বর্তমানে বেইজিংয়ের চিংকুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি এন্ড স্ট্র্যাটেজির সিনিয়র ফেলো।
ভারত মহাসাগরে প্রভাব বিস্তারের জন্য দিল্লির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে বেইজিং। উত্তরে হিমালয় অঞ্চলের সীমান্ত নিয়েও দুই দেশের মধ্যে বিরোধ আছে।
এর আগে ২০১৪ সালে চীনের নৌবাহিনীর দু’টি ডুবোজাহাজ শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে নোঙর করেছিল। গত দুই বছরে চীনের দু’টি গবেষণা জাহাজ শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল। এসব নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল ভারত।
এবারের গবেষণা জাহাজ শিয়াং ইয়াং হং ৩ এরও মালদ্বীপে যাওয়ার আগে কলম্বো যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শ্রীলঙ্কার এক প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ওই পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যৌথভাবে গবেষণাটি করার জন্য শ্রীলঙ্কা প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তবে ভারতের চাপেই কলম্বো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু মালদ্বীপের ক্ষেত্রে ভারতের চাপ কাজ করেনি।
ভারত মহাসাগরের মাঝখানে ১২০০ প্রবাল দ্বীপ ও প্রবাল প্রাচীর নিয়ে গঠিত দেশ মালদ্বীপ দীর্ঘ সময় ভারতের প্রভাব বলয়ে ছিল। কিন্তু নভেম্বরে মোহাম্মদ মুইজ্জু (যাকে চীনপন্থি হিসেবে বিবেচনা করা হয়) দেশটির প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মালের এ অবস্থান পরিবর্তন করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
নির্বাচনী প্রচারে তিনি ‘ভারত হটাও’ শ্লোগান তুলেছিলেন আর নির্বাচিত হওয়ার পর দিল্লিকে মালদ্বীপে থাকা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ৮০ জন সদস্যকে প্রত্যাহার করে নিতে বলেছেন। এর জন্য মালদ্বীপের পার্লামেন্টে নির্বাচনের দুই দিন আগে ১৫ মার্চের মধ্যে সব সেনা সরিয়ে নেওয়ার জন্য দিল্লিকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে মালে।
গত সপ্তাহে এই নিয়ে দিল্লিতে আলোচনার পর মালদ্বীপের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারত তাদের সেনা সরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে, ১০ মার্চের মধ্যে প্রথম ব্যাচ দেশে ফিরে যাবে আর বাকিরা যাবে মে-র দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে।
ভারত জানিয়েছে, কয়েক বছর আগে মালদ্বীপকে দেওয়া তিনটি নজরদারি ও উদ্ধারকারী আকাশযান পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ওই ভারতীয় সেনারা মালদ্বীপে ছিল।
ইতোমধ্যে ভারত ও মালদ্বীপের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এতোটা তলানিতে নেমেছে যে ভারতের ৭৫তম প্রজাতন্ত্র দিবসে মালের ভারতীয় হাই কমিশনের অনুষ্ঠানে মালদ্বীপ সরকারের কোনো ঊর্ধ্বতন নেতা উপস্থিত ছিলেন না।
গত মাসে মইজ্জু চীন সফর করেছেন। বেইজিং তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে। মইজ্জুর সফরের পর চীনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মালদ্বীপ সফর করেছেন। মইজ্জু চীনা অর্থ সাহায্যে বেশ কয়েকটি অবকাঠমো প্রকল্প শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন।
চীনের দিকে মালের এই হঠাৎ মোড় পরিবর্তনে দ্বীপরাষ্ট্রটির কৌশলগত গুরুত্ব নিয়ে সজাগ দিল্লিতে উদ্বেগ বেড়েছে।
চীন দ্রুতগতিতে তার নৌ শক্তি বাড়িয়ে চলেছে। তারা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মালদ্বীপে প্রবেশের অনুমতি চাইতে পারে, যা ভারত আটকাতে চায়।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শ্যাম শরণ বিবিসিকে বলেন, “অবশ্যই মালদ্বীপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; এটি ভারতের দক্ষিণ মহাসাগরীয় প্রান্ত। শ্রীলঙ্কায় যা হচ্ছিল তা নিয়ে যেমন আমাদের গুরুতর আপত্তি ছিল, মালদ্বীপে যা হচ্ছে তা নিয়েও আমাদের একই ধরনের গুরুতর আপত্তি আছে।”
ছোট দ্বীপ দেশ মালদ্বীপ অনেক কিছুর জন্যই ভারতের ওপর নির্ভরশীল। খাদ্য, অবকাঠামো নির্মাণ, পর্যটন ও প্রযুক্তি এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। অনেক মালদ্বীপবাসী চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। দুই দেশের সম্পর্ক নাজুক হতে থাকায় এসবের ভবিষ্যত কী হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এ নিয়ে বিবিসির করা মন্তব্যের অনুরোধে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট দপ্তর ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাড়া দেয়নি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।