জুমবাংলা ডেস্ক: মিডিয়া নিয়ে আজকাল বেশ গালগপ্প চলছে। মিডিয়া বিপাকে আছে (!) সে কথা সবাই বলছে। আর মিডিয়া কিছুই পারছে না (!) সে কথাও বলা হচ্ছে আকছার। সর্বোপরি মিডিয়াকে বেশ গালমন্দও করা হচ্ছে। মিডিয়ার ওপর দোষ চাপানো অনেকটা অভ্যাসেই পরিণত হয়েছে অনেকের। এরই মধ্যে কথা উঠেছে মিডিয়ার টিকে থাকার সক্ষমতা নিয়ে। এত্ত দোষ-ত্রুটি, চাপ-বিদ্বেষের মুখে কীভাবেই টিকে থাকবে মিডিয়া?
কোনও মিডিয়া আউটলেটের টিকে থাকার সামর্থ পুরোপুরিই নির্ভর করবে সেই মিডিয়ার মানসম্মত সাংবাদিকতা চর্চার টেকসই সক্ষমতার ওপর।
পাঠক, দর্শক কিংবা শ্রোতা যদি নির্ভরযোগ্য তথ্য পায় তাহলেই মিডিয়াটির ওপর তাদের আস্থা থাকবে। আর পাঠক আস্থা পেলে মিডিয়াটি টিকে যাবে। কথাগুলো কেবল একক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার জন্যই প্রযোজ্য নয়, সার্বিকভাবে মিডিয়া নেটওয়ার্কের পরিবেশটিকেই এই আস্থার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।
এই মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা চর্চার বিষয়টি এখন অর্থ কিংবা অর্থের উৎসের চেয়েও বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। তবে পাশাপাশি আরও কিছু বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ বলে সামনে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে- আইনি কাঠামো, প্রযুক্তিগত সুবিধা, কার্যকর নেটওয়ার্ক আর সর্বোপরি যথার্থ সম্পাদকীয় নীতি কৌশলের কথাও। যার মাধ্যমে গণমাধ্যমের উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে।
তাহলে মূল প্রশ্নতো গিয়ে দাঁড়ালো সেখানেই- গণমাধ্যমের উন্নয়ন কীভাবে মানসম্মত সাংবাদিকতাকে টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখতে পারে? মূল চ্যালেঞ্জগুলোও সেখানেই।
মিডিয়া মার্কেটে এখন মৌলিক কিছু চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে যেগুলো হয়তো আগে ততটা ছিলো না। প্রধানত মিডিয়ার ডিজিটালে পাল্টে যাওয়া আর মিডিয়া ব্যবহার কিংবা ভোগ করায় এসেছে নতুন কিছু ধরন-ধারন।
এর বাইরে এসেছে অনলাইনে বিনামূল্যে খবর বিতরণের ধাক্কা। সংবাদকর্মীরা গায়ে খেটে, মালিকরা বড় অংকের অর্থ লগ্নি করে খবর সংগ্রহ করছেন। আর পাঠক তা মুফতে পেয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া আগে বাজারে তথ্য যেটুকু মিলতো এখন মিলছে তার চেয়ে অনেক বেশি । বলা চলে তথ্যের জোয়ার বইছে। খবরের উৎস নিজেই খবরের প্রকাশক হয়ে বসে আছে।
এর বাইরে ওয়েব জগতে চলে এসেছে শ্রেণিভুক্ত (ক্ল্যাসিফায়েড) বিজ্ঞাপন। আর সর্বোপরি টেকজায়ান্টদের উদ্ভব ও বিস্তার ঘটেছে ভীষণভাবে। সব কিছুই তারা নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে একাই ভোগ করার পায়তারাই কেবল নয়, রীতিমতো সফলভাবে সেটাই করছে।
এর বাইরেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যার অন্যতম হচ্ছে- মিডিয়ার ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ। যা ক্রমেই বাড়ছে আর বাড়ছে। এতে করে মিডিয়া আর নিজের মতো চলতে পারছে না। তাকে হয় সরকারের নয়তো গোষ্ঠী স্বার্থের কাছে নত হয়ে থাকতে হচ্ছে। গোষ্ঠী স্বার্থগুলো স্রেফ স্বার্থের বশবর্তী হয়েই মিডিয়া হয় কিনে নিচ্ছে নয়তো বিজ্ঞাপনি সহায়তা দিয়ে মিডিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করছে।
এর বাইরে সংবাদমাধ্যমের ওপর রয়েছে সেন্সরশিপ, নিয়ন্ত্রণ ও সার্বক্ষণিক নজরদারির খাড়া।
কিন্তু এসব কিছুর মাঝেও মূল শক্তিটি থেকে যাচ্ছে পাঠকের ওপর। যারা আসলে দিনশেষে মানসম্মত সাংবাদিকতাই দেখতে চায়। এখন প্রশ্ন উঠেছে বিজ্ঞাপন নির্ভরতা দিয়ে মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা কতটুকু করা সম্ভব? আর যদি তা সম্ভব হয়ও তাও হবে খুব সীমিত আকারে।
গণমাধ্যম বোদ্ধারা এসব চ্যালেঞ্জের কথা বলে জোর দিলেন রিসোর্স মডেলের ওপর। বললেন, আসলে পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে এই যোগ্য সংবাদকর্মীরাই আমাদের সুরক্ষা দিতে পারবে। তবে তাদের চাই নতুন ধরনের দক্ষতা। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সাংবাদিকতায় তাদের দক্ষ পরিপক্ক হয়ে উঠতে হবে। এছাড়াও নিতে হবে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলগত উদ্যোগ। আর থাকতে হবে একটি সক্রিয় তথ্য ও গণমাধ্যম ব্যবস্থা।
কিন্তু মানসম্পন্ন মিডিয়া বা সাংবাদিকতা কিভাবে সম্ভব? গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে যে আলোচনা হলো- তাতে বলা হলো এ সবকিছুর কেন্দ্রে থাকতে হবে একটি বিষয়- তা হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এই শর্তটি মানলে মিডিয়ার পক্ষে সরকার তথা অর্থনৈতিক বিষয়গুলোতে জটিল সব প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব। আর তার মধ্য দিয়েই সাধারণ নাগরিকের কাছে নিরপেক্ষ তথ্যভিত্তিক খবরাখবর পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
কিন্তু শুধুই কি মিডিয়ার সক্ষমতা? মানসম্মত সাংবাদিকতা? পাঠকের কি কোনও ভূমিকা নেই?
আছে। সে নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আমরা পই পই করে একটি কথা বলছি। আপনি যতই মানসম্মত সাংবাদিকতার চর্চা করুন না কেনো, পাঠক/দর্শক/শ্রোতার রুচি যদি তৈরি না হয়, পাঠকের যদি না থাকে মিডিয়া লিটরেসি (গণমাধ্যম সংক্রান্ত স্বাক্ষরজ্ঞান) তা হলে একা মানসম্মত সাংবাদিকতা দিয়ে এই পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে মিডিয়া খুব একটা এগুতে পারবে না। সুতরং মিডিয়া অ্যান্ড ইনফরমেশন লিটেরেসি নিয়েও জিএমএফ-এ আলোচনা হলো।
অনেকেই বলবেন এই গণমাধ্যম স্বাক্ষরতা বিষয়টা আবার কী?
এটি হচ্ছে এক ধরনের দক্ষতা যা থাকলে সাধারণ মানুষ মিডিয়া তথা তথ্যসূত্রকে সঠিকভাবে বুঝতে ও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারবে।
একটি খবর- তা ভূয়া নাকি সঠিক? খবরটি যিনি কিংবা যারা দিচ্ছেন তিনি কিংবা তারা কোন মাধ্যম থেকে পাচ্ছেন, এবং কোন পদ্ধতিতে ছড়াচ্ছেন সেটিও জানতে ও বুঝতে পারা জরুরি। অসংখ্য মিডিয়ার যুগে কাটপেস্ট-এর মতো চৌর্যবৃত্তির সাংবাদিকতাও চলছে ধুন্ধুমার। সুতরাং সকলকে বুঝতে হবে কে এই কনটেন্টের মূল প্রস্তুতকারক? আর কারা একে বিনা শ্রমশক্তি ও মেধা ব্যয় করে স্রেফ ঘরে বসে কাটপেস্ট করে ছড়াচ্ছে।
এই মিডিয়া ইনফরমেশন লিটরেসি থাকলে কিন্তু গণমানুষের নিজের সক্ষমতাও বাড়ে। এর মধ্য দিয়ে তাদের তথ্য ভান্ডারে প্রবেশাধিকার যেমন নিশ্চিত হয়, তেমনি তারা নিজেরাও নিজেদের মত প্রকাশের যোগ্যতা অর্জন করেন। যে দুটোই মানুষের মৌলিক অধিকার।
আজকালের এই ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে সাধারণের এই গণমাধ্যম স্বাক্ষরতা বিশেষ করে গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইল ফোনের ব্যবহার যে হারে বাড়ছে তাতে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত গোপণীয়তা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও এই মিডিয়া লিটরেসি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
একই সঙ্গে কথা বলতে হবে নিউজ লিটরেসি নিয়েও। কোনটা সংবাদ, কোনটা সংবাদ নয়, কোনটা সঠিক কোনটা ভূয়া খবর এগুলো মানুষকে বুঝতেই হবে। তার জন্যই চাই সংবাদ বিষয়ক স্বাক্ষরজ্ঞান।
ভূয়া খবর যারা ছড়ায় তারা তো রয়েছেই, একটি মূলধারার সংবাদ মাধ্যম নিজেও কিন্তু তার পাঠক, দর্শককে নানাভাবে ঠকায়। সেল্ফ সেন্সরশিপ, দলকানা সাংবাদিকতার চর্চা- এসবও চলছে। তাতে সঠিক মিডিয়াটিকে বেছে নিতেও সাধারণের চাই নিউজ লিটেরেসি। তবে মূল কথা কী- এর জন্য কোনও বিশেষ একক কোনও কৌশল নেই। একটি কৌশলে সবাইকে স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন করে তোলা যাবে এমন কোনো পথও নেই। কারণ বিশ্বের দেশে দেশে এই সমস্যাটির ধরণ ভিন্ন ভিন্ন। অনেক দেশেই সাধারণ শিক্ষার হারটাই কম, সাধারণ স্বাক্ষরতা জ্ঞান সম্পন্ন মানুষের সংখ্যাই যেখানে কম, সেখানে মিডিয়া স্বাক্ষরতা আর কতটুকুই সম্ভব। আবার যেখানে স্বাক্ষরজ্ঞান হয়তো রয়েছে, কিন্তু কোনও বিষয়কে স্বাধীন, নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা, তার জটিল দিকগুলো চিন্তায় নিয়ে বিবেচনা করার জন্য যে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষকে যেতে হয়, তা এখনো অধিকাংশ দেশেই অবর্তমান।
জার্মানি এখন এই মিডিয়া লিটেরেসিকে তাদের স্কুল পাঠ্যসূচিতে নিয়ে এসেছে। অর্থাৎ স্কুলের ছেলেমেয়েরাই শিখে নেবে মিডিয়া কি? খবর কী এবং কোনটা। এতে তাদের গভীর চিন্তাবোধ তৈরি হবে। কোনও বিষয়কে জটিলভাবে ভাবতে পারবে। তাতে সুসাংবাদিকতার চর্চার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে জন্য টিকে থাকবে যেসব মিডিয়া তাদের পাঠের কিংবা ব্যবহারের জন্য পাঠক/দর্শক শ্রেণিটিও তৈরি হবে নিউজ ও মিডিয়া লিটরেসি নিয়ে।
বাংলাদেশের জন্য দিনটি কীভাবে আসবে? কবে আসবে?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।