নিজস্ব প্রতিনিধি : এই রমজানে ইফতারের সময় রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগের খানকা-ই-মশুরিয়া জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে গেলে আপনার মন খানিকটা আনন্দে ভরে উঠতে পারে। গেলে দেখতে পাবেন, হাজার খানেক লোক মাদুর বিছিয়ে বসে পড়েছেন। সবার সামনে পানির বোতল ও শরবতের গ্লাস। প্লেটে খেজুর ও খিচুড়ি। আযান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ইফতার করছেন। সে এক দারুণ দৃশ্য!
মসজিদটিতে ২০-২৫ জন স্বেচ্ছাসেবী রোজাদারদের ইফতার করাচ্ছিলেন। তাঁরা জানান, এই চিত্র শুধু একদিনের না। রমজানের প্রতি দিনই এখানে হাজারের বেশি মানুষকে ইফতার করানো হয়। শুধু এ বছর নয়, ২০১৯ সাল থেকে হচ্ছে চমৎকার এ আয়োজন।
খানকা মসজিদ-মাদরাসা কমিটি, টোলারবাগবাসীর এ আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা করছে তৌহিদ ফাউন্ডেশন নামের একটি অলাভজনক ও অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
আয়োজকেরা জানান, এ মসজিদে প্রায় ৮৫০-৯০০ প্লেট রয়েছে। ইফতারে এস৷ প্লেট তো যাচ্ছেই। পাশের বিভিন্ন মার্কেটের দোকানি ও প্রহরীরাও এখান থেকে ইফতার নিয়ে যান। সব মিলিয়ে দিনে এক হাজারের বেশি মানুষ তাঁদের এ আয়োজনে ইফতার করেন।
তৌহিদ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তৌহিদুল ইসলাম। তিনি ২০১৮ সালে মিরপুর ১-এর টোলারবাগে এ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন।
ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ ইফতার বিতরণসহ নানা থেকে সেবামূলক কাজ করা হয়। পাশাপাশি বেকার যুবক ও বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষদের বিনা মূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ৭ কোটির বেশি টাকা খরচ করা হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ একক অর্থায়নে পরিচালিত হয়। এখানে সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি, সামাজিক বা ব্যক্তিগত কোনো অনুদান নেওয়া হয় না।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, এই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে মাদ্রাসার গরীব ও মেধাবী ৫ জন শিক্ষার্থীকে লেখাপড়ার খরচ বাবদ প্রতি মাসে তিন হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। তাঁদের এভাবে মাওলানা পর্যন্ত পড়ার খরচ দেওয়া হবে।
ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে সমাজের সকল বয়সী নারীদের মহিলা ক্বারী প্রশিক্ষক দ্বারা ২১ দিনব্যাপী বিনা মূল্যে নূরানী পদ্ধতিতে পবিত্র কুরআন শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এই প্রশিক্ষণার্থীদের ৪৫০টি কুরআন শরীফ হাদিয়া হিসেবে দেওয়া হয়।
প্রতিষ্ঠানটি থেকে রমজান মাসে ৩ জন কুরআনে হাফেজ দ্বারা নারীদের জন্য জামাতে খতম তারাবীহ নামাজের ব্যবস্থাও করা হয়। তাঁদের ১টি করে জায়নামাজ হাদিয়া হিসেবে দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর রমজান মাসে দিনে ১ হাজার মানুষকে ইফতার করানো হচ্ছে।
সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, ইফতারের আগমুহূর্তে স্বেচ্ছাসেবীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ রোজাদারদের পানির বোতল দিচ্ছেন। কেউ দিচ্ছেন শরবত। কেউ প্লেটে খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছেন, তা সারি সারি রোজাদারের সামনে পৌঁছে দিচ্ছেন অন্যরা। মসজিদের মাইকে আযান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ইফতার শুরু করেন।
এভাবে ইফতারে প্রতিদিন বিভিন্ন রকমের খাবারের আয়োজন থাকে। যারা ইফতারে অংশগ্রহণ করেন তারা এসব খাবার তৃপ্তি সহকারে খান।
তৌহিদ ফাউন্ডেশনের একটি ওয়েবসাইট রয়েছে। সেখান থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ২ হাজার ২০ জন তরুণ-তরুণীকে কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ১৯৩ জনকে। এ ছাড়া বর্তমানে ৫ হাজারের বেশি তরুণ-তরুণী কম্পিউটার প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে অপেক্ষমান রয়েছেন৷ ২ হাজার জনের বেশি নারী-পুরুষ সেলাই প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষমান রয়েছেন। তাঁদের পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি বিনা খরচে অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা দেওয়া থেকে শুরু করে লাশ দাফন ও গোসলের ব্যবস্থা করে। এটি দুস্থ ব্যক্তিদের চোখে চিকিৎসা করায়। নুরানী পদ্ধতিতে কোরান শিক্ষাদানসহ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের শিক্ষাভাতা দেয়। মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় নগদ অনুদানপ্রদানসহ প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে অসহায় নারী-পুরুষের মাঝে ত্রাণও বিতরণ করা হয়।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, ফাউন্ডেশনটি থেকে ৪টি অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে অসুস্থ রোগীদের জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সম্প্রতি এই বহরে ২টি লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িও যুক্ত হয়েছে। দরিদ্র ও অসহায় ব্যক্তিদের এসব সেবা বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। তবে সামর্থবানদের কাছ থেকে শুধু প্রকৃত খরচ নেওয়া হয়ে থাকে।
ফাউন্ডেশনটি থেকে অসহায় মানুষের কাফন-দাফন ও গোসল বিনা মূল্যে করানো হয়। তবে এসব সেবায় সামর্থবানদের কাছ থেকে প্রকৃত খরচ নেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ১ হাজার ৪৮০ জনের লাশ গোসল করানো হয়েছে।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে ২৪৬ জন নারী-পুরুষকে বিনা মূল্যে চোখের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ১৭৪ জনের চোখের ছানি অপারেশনসহ লেন্স প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফাউন্ডেশন থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় নগদ অর্থ নিয়মিত অনুদান দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত এসব খাতে ৬৪ লাখ ৭২ হাজার ২২০ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া করোনার সময়ে ঢাকা, বগুড়া ও লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় চল্লিশ লাখ টাকার ত্রাণ বিতরণ করা হয়।
প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, তৌহিদ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তৌহিদুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে অসহায় ও দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা ব্যয়সহ মসজিদ মাদ্রাসায় দান করে আসছেন। তাঁর এই দান ও সেবার বিষয়টির প্রতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই ‘তৌহিদ ফাউন্ডেশন’ গঠন করা হয়। তৌহিদুল ইসলামের বাড়ি/ফ্লাট ভাড়া এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আয়ের একটি অংশ দিয়ে এই ফাউন্ডেশনের তহবিল গঠিত এবং এর ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠাতার অবর্তমানে যেন ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ব্যাহত না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে ফাউন্ডেশনের নিজস্ব আয়ের উৎস তৈরি করা হচ্ছে।
তৌহিদ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক মোঃ শহিদুল ইসলাম জানান, ফাউন্ডেশনটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, অলাভজনক ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। শুধু মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রাজী ও খুশির জন্য আর্তমানবতার সেবার মানসে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এটি এ কারণে ব্যতিক্রমী যে, এটির সম্পূর্ণ ব্যয় প্রতিষ্ঠাতার পক্ষ থেকে এককভাবে নির্বাহ করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানে সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি, সামাজিক বা ব্যক্তিগত কোনো অনুদান নেওয়া হয় না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।