বিনোদন ডেস্ক : ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী ঘটনার মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চিরতরে আলাদা রাষ্ট্র হয়ে যায় বাংলাদেশ। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির পেছনে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। তবে তার মানে এই নয় যে, মাওলানা ভাসানী, আবুল মনসুর আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, জিয়াউর রহমান, মানিক মিয়া, শামসুল হকসহ আরও অসংখ্য নেতা ও ব্যক্তিত্বদের অবদান নেই। শুধু তারাই নয়, বরং তাদের অবদান আরও বেশি, যারা বাইরে থেকে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধটা চালিয়ে গেছেন।
তাজউদ্দীনের জ্যেষ্ঠ কন্যা শারমিন আহমদের লেখা বই, ‘তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা’ থেকে জানা যায়, বরং শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘তাজউদ্দীন ২৭ তারিখ হরতাল ডেকে দিয়েছি, যাও বাসায় গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও।’ এরপর কাগজে বা রেকর্ডে স্বাধীনতা ঘোষণা করার কথা বললে শেখ মুজিব বলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে।’ হয়তো কথাটি ঠিকই বলেছিলেন। কারণ বিচারের সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের কুখ্যাত বিচারব্যবস্থায় তার ফাঁসির রায়ও হয়েছিল। সে যাই হোক, সেই শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর বায়োপিক ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ নির্মাণ করা হলো, তা কী করা হলো? গোটা সিনেমাটিই শেখ মুজিবময়। শেখ মুজিব ছাড়া বাকি সব যেন একেবারেই গৌণ চরিত্র। তাদের কোনোই অবদান নেই। যেন শেখ মুজিব সিনেমাটির সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, যার জাদুর বাঁশি সুরে সব মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে জাদুগ্রস্ত হয়ে একাট্টা হয়ে যায়, আর সেই সুরের বাঁশিতে একে একে হ্যামিলনের ইঁদুরের মতো আত্মাহুতি দেয়। এভাবেই ৩০ লাখ মানুষ শেষ হয়ে যায়। ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’ এই সিনেমাটি কার টাকায় নির্মিত হয়েছে? জনগণে, নাকি পতিত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার পরিবারের? আর এই সিনেমাটি বানাতে তাদের কত টাকা খরচ হয়েছে? এটার টাকা কি শেখ হাসিনার নিজের, নাকি জনগণের? এই হিসাবও আজ জনগণের কাছে দেওয়ার আছে। কারণ এক প্রচারণা খাতেই এই সিনেমাটির পেছনে খরচ ধরা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। সরকারি মতে, এর নির্মাণে খরচ হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ মোট অর্থের ৫০ কোটি ও ভারত ৩৩ কোটি টাকা দিয়েছে। আর ভুয়া হিসাব দেখানো হয়েছে ছবিটির কলাকুশলীদের পেছনে টাকা খরচের হিসাব। বলা হয়েছে তাদের নামে মাত্র ১ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। কলাকুশলীদের ধরে এর হিসাবও নিতে হবে। ৫৪ বছরেও যে শেখ মুজিবকে জাতীয় ব্যক্তিত্ব করতে পারেনি, তার সিনেমা বানাতে কেন জনগণের টাকা খরচ করতে হবে- এই প্রশ্ন এখন জাতি করতে শুরু করেছে। বরং শেখ মুজিবকে জাতীয় ব্যক্তিত্ব না করে শুধু তার পরিবার ও আওয়ামী লীগের সম্পদ করে কুক্ষিগত করেছে ক্ষমতাকে একচেটিয়া করার উদ্দেশ্যে। তাই যে শেখ মুজিবকে পারিবারিকভাবে একচেটিয়াভাবে কুক্ষিগত করা হয়েছে, তার বায়োপিক বানানোর জন্য জনগণ কেন তার নিজের গাঁট থেকে টাকা খরচ করবে? আর যদি জনগণের টাকাতেই এই সিনেমা বানানো হয়, তাহলে সে সিনেমায় ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, তাজউদ্দীন, জিয়াউর রহমান, মানিক মিয়া, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজসহ অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তিকে কেন যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হবে না? তাদের চরিত্রের জন্য কয় মিনিট রাখা হয়েছে? সেই সব নেতারা কি জনগণের নেতা নয়? সবচেয়ে বড় কথা, এই দেশের মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার জন্য জাতিকে একটি ‘ঘোষণা’ শোনানোরও দরকার ছিল। আর এটাই শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা ঠিক, ঘোষণাটি জিয়াউর রহমান ‘বাই চান্স’ থেকে পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো ঘোষণা দিতে হতোই। সে ডাকটি তবে দেবেন কে? শেখ মুজিব তো ঘোষণা দিতে না চেয়ে বরং তাজউদ্দীনকে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতেই বলেছিলেন। আসল লিডারই যেখানে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে বলেছেন, সেখানে এমন ব্যক্তি আছে যে অমিত সাহস নিয়ে এগিয়ে আসবে ঘোষণা দিতে? আওয়ামী লীগে আর কি নেতা ছিল না, যিনি অমিত সাহস নিয়ে এগিয়ে আসবেন ঘোষণা দিতে? যিনি ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ বীরবিক্রমের ভাষণ দিতে পারেন, তিনিই যখন কোনো সাহস পেলেন না, আওয়ামী লীগের আর কোনো নেতা সাহস দেখাবে? তাই তারা নিজেরা সেই সাহস না পেয়ে জিয়াউর রহমানকে ধরলেন। প্রথমে নিজেকে প্রধান রূপে ঘোষণা দিলেও পরে আওয়ামী নেতাদের চাপে পড়ে শেখ মুজিবের পক্ষে ঘোষণাটি দেন। তবে এটাও ছিল জিয়ার ঔদার্যতা। কারণ শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে কীভাবে হয়, ঘোষণাপত্রটি শেখ মুজিবের, এর তো প্রমাণ নেই! তবে হতে পারত সেই ঘোষণাটি তাজউদ্দীনের পক্ষ থেকে। কেননা তিনিই ছিলেন তখন আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা আর শারমিন আহমদের লেখা থেকে জানা যায়, ঘোষণার ওই লেখাটিও ছিল তাজউদ্দীনের। তবে কার ঘোষণা ছিল সেটা সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, একজন ডিসিপিস্নন আর্মির লোক হয়েও জিয়া যে তা পড়েছিলেন এটাও তো কম দুঃসাহসের কথা নয়। কিন্তু এই সিনেমাটিতে সেই জিয়াকেও দেখানো হয়েছে একেবারে গৌণভাবে। যিনি তার সামরিক বাহিনীর চেইন অব কমান্ড লঙ্ঘন করে, প্রফেশানিলজম ভঙ্গ করে সম্ভাব্য মৃতু্যকে হাতের মুঠোয় ভরে সেই ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছিলেন। এমন সাহস থাকলে তো আওয়ামী লীগের কত নেতাই ছিলেন, তারাই তো তা করতে পারতেন। করলেন না কেন? ঠিক তেমনিভাবে গৌণভাবে দেখানো হয়েছে তাজউদ্দীন আহমদকেও। যিনি না হলে কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধ কিছুতেই সংঘটিত হতো না। তাহলে এই বায়োপিক কেন জাতি দেখবে? হয়েছেও তাই। চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির অন্য সব সিনেমার মুক্তি বন্ধ করে মাসের পর মাস প্রেক্ষাগৃহে চালানো হয়েছে এই বায়োপিক। নতুন সিনেমা মুক্তি দিতে না পেরে হলমালিকদের প্রচুর লোকসান গেছে এ সময়ে। ১০-১৫ জন দর্শক নিয়েই চালাতে হয়ে প্রেক্ষাগৃহ। শুধু আওয়ামী লীগের লোকই যদি এই সিনেমাটি দেখত, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড ব্যবসা করত। ‘প্রিয়তমা’ করে না। তার মানের আওয়ামী লীগের লোকই সেই সংখ্যায় তাদের সিনেমাটি দেখেনি। আর গোটা জাতি কী দেখবে? গোটা জাতির জন্য তো শেখ মুজিবকে গ্রহণ করানো যায়নি। শুধু তা-ই নয়। সিনেমার যে পোস্টার করা হয়েছে তাতেও শেখ মুজিব ছাড়া আর কেউই নেই। পোস্টারজুড়েই মুজিব। যারা আছে সেই জনতাকেও দেখানো হয়েছে একেবারে ঝাঁপসা রূপে। জনতার ভূমিকাও নেই। তারা যেন কিছুই করেনি। শুধু হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সুর শোনার জন্য ইঁদুরের মতো তারা ঝাঁপসা হয়ে আছে। যেমন- এই ছবিতে রাইসুল ইসলাম আসাদের একটি চরিত্র হিসেবে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এতটাই সংক্ষিপ্ত যে, তাতে এ মজলুম জননেতাকে হুবহু খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে
তিনি বলেন, ‘আমি কিছুই করিনি, যা করেছেন সবই করেছেন আমার পরিচালক। আমি শুধু তার কথামতোই অভিনয়টুকু করে গেছি। আমি শুধু একজন পরিচালকের ক্রীড়নক হিসেবে যতটুকু সম্ভব কাজ করে গেছি।’ সিনেমাটিতে তার চরিত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ছবিটির নাম কি? ‘মুজিব : একটি জাতির রূপকার’। কাজেই ছবিটিতে অন্য সব চরিত্রের গুরুত্ব থাকবে কেন? ছবিটির স্ক্রিপ্ট যেভাবে তৈরি হয়েছে পরিচালক যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই কাজ হয়েছে। আমিও সেভাবেই ক্যারেক্টারটা করেছি। আর আমি ছবির খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশে ক্যারেক্টার করেছি। খুব ক্ষুদ্র একটা অংশে অভিনয় করেছি, আমি তো মূল কাজ করিনি- এর বেশি তো কিছু বলা যাবে না।’ অর্থাৎ এই বায়োপিকটি এমনভাবে করা হয়েছে যে, তখনকার ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী থেকে শুরু করে সব নেতা যেন শেখ মুজিবের জন্য ব্যবহৃত হওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছেন। যেভাবে তাদের বলবে সেভাবেই তারা অমোঘরূপে প্রদর্শিত হবেন। আর শেখ মুজিবও ইতিহাসের স্বৈররূপেই প্রদর্শিত হবেন। সেখানে তিনিই সর্বেসর্বা। বাকিরা সব চুনোপুঁটি। যে কারণে ছবিটিও উৎকৃষ্ট না হয়ে হয়েছে নিকৃষ্ট মানের। যে ছবি তার দলের লোকেরাই সবাই দেখে না। তাই আজ স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর এই সিনেমাটি নিয়েও কথা বলা শুরু হচ্ছে। ছবিটি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। তিনি বলেন, ‘মুজিব নামে যে সিনেমাটি বানানো হয়েছে, আমি সেটার হিসাব চাই। আমি দেখতে চাই, এত বাজেটের একটা সিনেমা কীভাবে এত নিকৃষ্টভাবে বানানো যায়!’ এর আগে ‘মুজিব’ সিনেমার টিজার, ট্রেলার নিয়ে নানা সমালোচনা হয়েছে নেটদুনিয়ায়। সেসময় প্রশ্ন উঠেছিল এর বাজেট নিয়েও। কেউ কেউ দাবি করেছে সিনেমাটির বাজেট ১২০ কোটি টাকা। সূত্র : যায়যায়দিন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।