জুমবাংলা ডেস্ক: নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৬৫ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে ১০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পোরশা উপজেলা। তবে উপজেলা পরিষদের সব প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় পোরশা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে নীতপুর এলাকায়। আর মুসাফিরখানাটি অবস্থিত নীতপুর থেকে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে পোরশা গ্রামের মিনা বাজারে। খবর কালের কণ্ঠ’র।
আজ থেকে ১১৪ বছর আগে: বরেন্দ্রভূমি খ্যাত পোরশা একসময় ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ ছিল। আজকের মতো পানীয়জলের এমন সুব্যবস্থাও ছিল না। খাল আর ছোট-বড় জলাশয় ছিল ভরসা। কূপ খনন করতে হতো ৮০ থেকে ১০০ হাত, তবেই পানির দেখা মিলত। তখন মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে হেঁটেই চলাচল করত। হাঁটতে গিয়ে কখনো বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যেত। দিনের কাজ শেষে হয়তো বাড়ি ফেরা সম্ভব হতো না। সে সময় সন্ধ্যার পর চারপাশ সুনসান হয়ে যেত। রাতের নির্জনে হিংস্র প্রাণীর ভয়, চোর-ডাকাতের উপদ্রব তো ছিলই। স্বাভাবিকভাবেই পথিকদের মনে এক ধরনের ভয় কাজ করত। আশপাশে কোনো আবাসিক হোটেল বা ভবন ছিল না। ফলে সন্ধ্যার পর মানুষ আশ্রয় খুঁজত। কারো ভাগ্যে নিরাপদ আশ্রয় মিলত, আবার কারো ভাগ্যে মিলত না। শতবর্ষ আগে এই জনপদ ছিল এমনই। মানুষের কষ্টের কথা চিন্তা করে ১৯০৮ সালে তৎকালীন জোতদার খাদেম মোহাম্মদ শাহ তৈরি করেছিলেন একটি মাটির ঘর। নাম দিয়েছিলেন—‘মোসাফিরখানা’। উদ্দেশ্য, মানুষ বিপদে-আপদে এই ঘরে যেন আশ্রয় নিতে পারে। পাশাপাশি খাবারের ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি। থাকা-খাওয়া সবই বিনা মূল্যে। পরিচালনা ও খরচ চালানোর জন্য মুসাফিরখানার নামে দান করেছিলেন নিজের ৮০ বিঘা জমি। আজও সেই জমির ফসল বিক্রির টাকায় চলে মুসাফিরখানা। খাদেম মোহাম্মদ শাহ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন বেশ আগে। কিন্তু তাঁর সেই মুসাফিরখানা থেকে এখনো উপকৃত হচ্ছে মানুষ।
প্রবীণদের ভাষ্য: খাদেম মোহাম্মদ শাহের উত্তরসূরিরা ঠিক কবে পোরশায় এসেছিলেন তার ঠিক চিত্র পাওয়া যায় না। তবে এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের ভাষ্য, প্রায় ১৫ শতকের পরে কোনো একসময়ে তৎকালীন বাদশা আলমগীরের আমলে ইরান থেকে হিজরত করতে বরিশালে আসেন শাহ বংশের কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে ফাজেল শাহ, দ্বীন মোহাম্মদ শাহ, ভাদু শাহ, মুহিদ শাহ, জান মোহাম্মদ শাহ, খান মোহাম্মদ শাহ অন্যতম। পরে বরিশাল থেকে তাঁরা আসেন এখনকার পোরশায়। যদিও তখন এখানে কোনো বসতবাড়ি ছিল না। ছিল শুধু ঝোপঝাড়। কিন্তু এলাকাটি ভালো লেগে যায় তাঁদের। তাঁরা এখানে বসবাস শুরু করেন। পাশাপাশি আশপাশের গ্রামগুলোতে ইসলাম প্রচার করতেন। নওগাঁর মানুষের সঙ্গে সখ্য তৈরি হওয়ায় তাঁরা আর পোরশা ছেড়ে যাননি। তাঁদেরই বংশধর খাদেম মোহাম্মদ শাহ।
মাটির ঘর থেকে দ্বিতল ভবন: উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার এ সময়েও সগৌরবে টিকে আছে পোরশার মুসাফিরখানাটি। দূর-দূরান্তের পথিকদের আগের মতোই স্বাগত জানাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ৮০ বছর মাটির ঘরেই এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। ১৯৮৮ সালে মুসাফিরখানার জমিজমার আয় দিয়ে বর্তমান দ্বিতল ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এখন ভবনের ভেতরে গেলে মন জুড়াবে যে কারো। ভেতরে মোজাইক করা মেঝেতে গালিচা বিছানো। সব মিলিয়ে প্রায় ১৬টি কক্ষ রয়েছে অতিথিদের জন্য। সেমিনার কক্ষ আছে একটি। আর একটি কক্ষ অফিসের কাজে ব্যবহার করা হয়। এখানে একসঙ্গে প্রায় ৬০ জন থাকতে পারে। মুসাফিরখানার উত্তর পাশে রয়েছে শান-বাঁধানো ঘাটওয়ালা পুকুর। একটি কমিউনিটি সেন্টারও আছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কমিউনিটি সেন্টারটি বিনা মূল্যে ব্যবহার করতে পারে এলাকাবাসী।
মুসাফিরখানায় এক দিন: পোরশা সদরের মিনা বাজারের বড় মসজিদের কাছেই মুসাফিরখানা। পূর্ব-পশ্চিম লম্বা দোতলা ভবন। প্রবেশের আগেই গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। মাথার ওপর ঝোলানো সাইনবোর্ডে লেখা ‘পোরশা মুসাফিরখানা’। ভবনের ভেতরে আছে সম্মেলনকক্ষ, প্রশস্ত বারান্দা, আবাসিক কক্ষ, পরিচ্ছন্ন ওয়াশরুমসহ নানা সুবিধা। মুসাফিরখানায় ঢোকার মুখেই দেখা হলো মাসুম নামের একজনের সঙ্গে। দুই দিন অবস্থান করে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। জানতে চাইলাম, এখানে সেবা কেমন? হাসিমুখে বললেন, ‘খুব ভালো। লোকজন খুব আন্তরিক। ভাই, আজকের দিনে কে কারে বিনা পয়সায় রাখে-খাওয়ায়?’
একটি কমিটির মাধ্যমে মুসাফিরখানাটি পরিচালিত হয়। সেই কমিটির সভাপতি জামিল শাহ। বললেন, ‘আমাদের এলাকাটি প্রত্যন্ত। মুসাফিরখানাটি যখন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সে সময় যোগাযোগব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এলাকার বাইরের কেউ এলে কাজ শেষ করে ফিরে যাওয়াটা তার জন্য অত্যন্ত কষ্টের ছিল। সেই কষ্ট লাঘবে মুসাফিরখানাটি নির্মাণ করেছিলেন খাদেম মোহাম্মদ শাহ। ’ এখন অতিথিদের সার্বক্ষণিক দেখভালের জন্য একজন ম্যানেজার ও একজন কর্মচারী আছেন। মুসাফিরখানার ম্যানেজার সিরাজুল ইসলাম। প্রায় ২৫ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি বললেন, এখন প্রতিদিন গড়ে পাঁচজনের মতো অতিথি থাকেন। অন্যান্য সময়ের তুলনায় রমজানে অতিথিদের আগমন বাড়ে। তখন প্রতিদিন গড়ে ২৫০ জনের খাবারের আয়োজন করা হয়। মুসাফিরখানার জমির টাকায় খরচ চলে। স্থানীয়রাও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করে থাকেন। এই এলাকায় কোনো আবাসিক হোটেল নেই। দূর-দূরান্ত থেকে মুসাফিররা আসেন। কেউ দুই দিনের জন্য, আবার কেউ তিন দিনের জন্য থাকেন।
আপনি যদি থাকতে চান: একজন মুসাফির সর্বোচ্চ তিন দিন থাকতে পারেন। এ জন্য আপনাকে প্রথমে মুসাফিরখানায় গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। থাকার পাশাপাশি দুপুর ও রাতে বিনামূল্যে খাবার মিলবে। তবে আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানাতে হয়। দুপুরে খেতে চাইলে সকাল ৯টা এবং রাতের খাবারের জন্য বিকেল ৪টার মধ্যে বলতে হবে। মুসাফিরখানায় যিনি একবার থেকেছেন, দুই মাস পর তিনি ফের থাকতে পারবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।