তাকী জোবায়ের: কাঠামোগত পরিবর্তন এনে আগামী ৬ মাসের জন্য ‘সঙ্কুলানমুখী ও আঁটসাঁট’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা ও মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দেওয়াই এর মূল লক্ষ্য।
এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাজারে অর্থের জোগান আরও কমাতে নীতি সুদহার আরও এক দফা বাড়িয়েছে এবং সুদহারে ক্যাপ তুলে দিয়ে ‘করিডোর’ ব্যবস্থা চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রবিবার দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আগামী ছয় মাসের জন্য এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
দেশের অর্থনীতিতে সংস্কার করার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যেসব পরামর্শ দিয়েছে, তার অনেক ছাপ উঠে এসেছে এবারের মুদ্রানীতিতে। ১ জুলাই মাস থেকে এই নতুন মুদ্রানীতি কার্যকর হবে যার মেয়াদ থাকবে ডিসেম্বর পর্যন্ত।
ঘোষিত মুদ্রানীতি উদ্ভাবনী, না কি প্রথাগত- জুমবাংলার এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, এই মুদ্রানীতিতে আমরা চারটি কাঠামোগত পরিবর্তন এনেছি। প্রথমত, আগে মুদ্রানীতি দেয়া হতো ‘মানি সাপ্লাই’ টার্গেট করে। সেখান থেকে আমরা পুরোপুরি সরে এসে ইন্টারেস্ট রেট টার্গেট করে পলিসি নির্ধারণ করেছি। পুরো স্ট্রাকচারাল চেঞ্জ করে মুদ্রানীতি দিয়েছি আমরা।
দ্বিতীয় পরিবর্তন হলো, সুদহারের ক্যাপ তুলে দিয়ে ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের ওয়েইট এভারেজ রেটের সাথে ৩ শতাংশ ধরে ব্যাংক সুদ হার নির্ধারণ করা হয়েছে।
তৃতীয় পরিবর্তন হচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাবে আইএমএফ’র ম্যানুয়াল অনুসরণ করা হবে। একইসাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব পদ্ধতিও অনুসরণ করা রিজার্ভের হিসাব করা হবে। চতুর্থত, পলিসি রেট ০.৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে।
“তাই এই মুদ্রানীতি উদ্ভাবনী না কি প্রথাগত সেটি বিচার করার দায়িত্ব আপনাদের”, বলেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
নতুন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশের প্রথাগত বিচারে এসব পদক্ষেপ এমন এক সময়ে নেয়া হয়েছে যখন দেশে মূল্যস্ফীতি চরম আকার ধারণ করেছে। মে মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
সাধারণত বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে বা কমিয়ে বাজারে টাকার যোগান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এখন থেকে এরকম মুদ্রা সরবরাহ নীতির বদলে সুদহার ভিত্তিক নীতি নেয়া হবে। অর্থাৎ সুদের হার বাড়িয়ে বা কমিয়ে বাজারে মুদ্রার যোগান নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
নতুন মুদ্রানীতিতে ‘রেফারেন্স রেট’ অনুযায়ী সুদ হার নির্ধারণের নতুন নিয়ম চালু হচ্ছে।
এসএমএআরটি (স্মার্ট-সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ) নামের এ পদ্ধতিতে ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের গড় হার ধরে ঠিক হবে রেফারেন্স। এরসঙ্গে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ যোগ করে এবং ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৫ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে।
কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাত ও ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খরচ সামাল দিতে আরো ১ শতাংশ যোগ করতে পারবে সুদ হারে।
আর এক দিন মেয়াদী রেপোর (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদ হার ৬ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। রিভার্স রেপো হার (জুলাই থেকে এসডিএফ নামে পরিচিতি হবে) আগের ৪ দশমিক ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।
এর আগে গত জানুয়ারির মুদ্রানীতিতে রেপোর সুদ হার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ শতাংশ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর রিভার্স রেপো হার আগের ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছিল।
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, “আমরা সরবরাহ সাইড ঠিক রেখে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছি, যাতে সরকারি ঋণেও অর্থ খরচ বাড়ে। টাকার সরবরাহ কমিয়ে এনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাটাই উদ্দেশ্য।”
গত বছরই আইএমএফ এর কাছ থেকে সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ আসে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ হিসাব করার আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি চালু করারও পরামর্শ দেওয়া হয়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও তার বাজেটে বলেছিলেন, মুদ্রানীতির কাঠামোতে অধিকতর স্বচ্ছতা ও নমনীয়তা আনতে এবং মুদ্রার চাহিদা ও সরবরাহকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে কার্যকারিতা বিবেচনায় ‘মনিটরি টার্গেটিং’ এর স্থলে ‘ইন্টারেস্ট রেট টার্গেটিং’ এর দিকে সরে আসার চিন্তা করা হচ্ছে।
ঘোষিত মুদ্রানীতি নিয়ে মূল্যায়ন জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘বাজেট সম্প্রসারণমূলক হওয়া সত্ত্বেও মুদ্রানীতি এখনও সংকোচনমূলক হতে পারে কারণ মুদ্রাস্ফীতি মূলত একটি আর্থিক ঘটনা। তাছাড়া এবার নির্বাচনী বছর হওয়ায় বাজেটের পুরো ব্যয় পুরোপুরি বাস্তবায়ন নাও হতে পারে। সাধারণতঃ বাজেটের প্রায় ১০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয় না। তাই দিনের শেষে বাজেটও সম্প্রসারণমূলক নাও হতে পারে। এছাড়াও, এটি মনে রাখা উচিত যে রাজস্ব ও আর্থিক নীতি প্রকৃতপক্ষে পরিপূরক।
তিনি বলেন, ‘এই মুদ্রানীতি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। বৃদ্ধির হার কিছুটা প্রভাবিত হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, যখন মুদ্রাস্ফীতি এত বেশি চলছে তখন প্রবৃদ্ধির হার ঠেলে দেওয়ার সময় নয়। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিকভাবে অর্থনৈতিক অস্থিরতার বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুদ্রাস্ফীতিজনিত প্রত্যাশা পূরণ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঠিক পদক্ষেপ।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।