আশরাফুল মামুন, মালয়েশিয়া: সিন্ডিকেটের কারণে বছরের পর বছর ঝুলে আছে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রম বাজার মালয়েশিয়া। শত চেষ্টা করেও শক্তিধর সিন্ডিকেটের বলয় থেকে বের হওয়া আজও সম্ভব হয়নি।
এমনকি মৃত্যুর পরও সিন্ডিকেটের বলয় থেকে মিলছে না মুক্তি প্রবাসীদের। প্রবাসে মৃত্যুর পরে লাশ দেশে আনতে ঘাটে ঘাটে হয়রানির পাশাপাশি স্বজনদের গুনতে হয় মোটা অংকের টাকা। একমাত্র বাংলাদেশ দূতাবাস ছাড়া সব জায়গায় দিতে হয় এই টাকা।
মৃত প্রবাসীদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, মৃত প্রবাশীর লাশ দেশে আনার জন্য মালয়েশিয়ার পুলিশ, লাশ প্রেরণকারী এজেন্ট, হসপিটালসহ নানা খাতে ঢালতে হয় টাকা। চাহিদামত টাকা না দিতে পারলে মরদেহ মর্গে পড়ে থাকে মাসের পর মাস। পুলিশ, লাশ প্রেরণকারী ফিউনারেল এজেন্ট এবং হসপিটাল কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে একটি অলিখিত সিন্ডিকেট তেরী হয়ে যায়।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনায় সরজমিনে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে। সমস্যা দীর্ঘদিনের কিন্তু এই ভোগান্তি নিরসনে কেউ কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বিষয়টি একাধিকবার কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নজরে আনলেও তারা এসব ভোগান্তি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে এক প্রকার উদাসীন থেকেছে।
একজন প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধার সবচেয়ে দূর্ভাগ্য হলো যদি কোন কারণে প্রবাসে মারা যান। পরিবার, আত্মীয় স্বজন ছাড়া প্রবাসের মাটিতে তার মরদেহটি হস্তান্তর করতে সহযোগিতাসহ দু’ফোটা চোখের জল ফেলার মত কেউ থাকে না। তার কারণ এখানে সবাই সকাল সন্ধ্যা নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত সময় কাটায়।
একটি মরদেহ দেশে পাঠাতে হলে থানা পুলিশ, হসপিটাল, দূতাবাস, ফিউনারেল এজেন্টসহ নানা ঘাটে দিন রাত দৌড়াতে হয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য।
কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মোঃ জাহিদূর রহমান জুমবাংলাকে বলেন, কেউ মারা গেলে হাসপাতাল থেকে ডেথ সার্টিফিকেট, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট, কোম্পানির ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট, পরিবারের এনওসিসহ যাবতীয় তথ্যদি আমাদের কাছে এনে দিলেই আমরা যাচাই করে অনুমোদন করি।
এখন প্রশ্ন হলো এসব তথ্য উপাত্ত ঘাটে ঘাটে ধর্না দিয়ে কে সংগ্রহ করে দিবে? কারণ সব প্রবাসীরা তো আত্মীয় স্বজন ও পরিবার নিয়ে আসনি মালয়েশিয়ায়। এর সমাধান কি? কারো জানা নেই।
এরকম একটি ঘটনার সাক্ষী এই প্রতিবেদক নিজেই। বগুড়ার রাফিউল ইসলাম রাফি গত ২২ জুন হসপিটাল কুয়ালালামপুরে মারা যান ব্রেইন স্ট্রোক করে। তার ভাই শরন সাংবাদিকতা করেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় একটি স্যাটেলাইট টিভিতে। কুয়ালালামপুর থানা থেকে পুলিশ শরনকে ফোন দিয়ে বললো তোমার ভাইয়ের মরদেহ দেশে পাঠানোর ব্যাবস্থা করার জন্য টাকা পাঠাও। তখন শরন বললো আমার ভাই বৈধভাবে বসবাস করছে তাই যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে নিয়োগ কর্তা। কিন্তু পুলিশ বললো সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে। দ্রুত লাশ পেতে হলে এখনই টাকা পাঠাতে হবে।
শরন বাধ্য হয়ে পুলিশের চাহিদা অনুযায়ী প্রথমে ৫ হাজার রিংগিত এবং পরে আরও ৭৫০ রিংগিত পাঠান। অথচ একজন প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠাতে ৩ হাজার ৮০০ রিংগিত-ই যথেষ্ট।
৫ হাজার ৭৫০ রিংগুত নিয়েও গড়িমসি করতে থাকে সিন্ডিকেট প্রক্রিয়ায় দায়িত্ব পাওয়া লাশ প্রেরণকারী এজেন্ট K L Funeral services। কোন এজেন্ট লাশ পাঠাবে সেটা নির্ধারণ করবে মরদেহের স্বজন অথবা নিয়োগকর্তা। এখানে সেই সুযোগ পুলিশ দেয়নি।
এই এজেন্টের স্বত্তাধিকারী মালয়েশিয়ান মিস্টার অপ্পু। তার সাথে দূতাবাসের দু-একজন কর্মকর্তার সখ্যতা আছে। কিন্তু এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলেনি। অপ্পুর কাছে ফোনে জানতে চাইলে বলেন, কোম্পানি কাগজপত্র রেডি করতে দেড়ি করছে তাই দেড়ি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কোম্পানির Hello planet এর নিয়োগকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মিস্টার অপ্পু আমাদের কাছে আসলে সব তথ্য দেওয়া হবে। অপ্পুর গড়িমসি বিষয়ে জানতে চাইলে দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে থাকা মোঃ মোকসেদ বলেন, আমাদের কাছে তথ্য উপাত্ত না আসলে আমরা কি করবো? কাগজপত্র সরবরাহ করে দেন আমরা ব্যাবস্থা নেব।
মিস্টার অপ্পু কোম্পানির অফিসে গিয়ে সব ডকুমেন্টস সংগ্রহ করার পর ঈদ উপলক্ষে বিমান টিকিটের দাম বাড়তি উল্লেখ করে আরও ৮০০ চেয়ে বসে। না দিলে লাশ পাঠানো সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে KL Funeral service এর মালিকের সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমাকে পরিবার কিংবা দূতাবাস কোনো দায়িত্ব বা টাকা পয়সা দেয়নি। আমাকে পুলিশ শুধু ৩ হাজার ৮০০ রিংগিত দিয়েছে। আমার আরও টাকা লাগবে।
অবশেষে আরও অতিরিক্ত ৬০০ রিংগিত দেওয়ার পর গত ৩ জুলাই রাফিউলের মরদেহ দেশে পাঠানো হয়। তবে রাফিউলের পরিবার স্বচ্ছল হওয়ায় নগদ ৬ হাজার ৪০০ রিংগিত দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশি টাকায় বর্তমান সময়ে দেড় লাখ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু অধিকাংশ প্রবাসীর পক্ষে এটা দেওয়া সম্ভব হয় না। অনেক সময় চাঁদা তুলে প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠানোর নজির বহু রয়েছে।
বাংলাদেশে দূতাবাসের মিনিস্টার (শ্রম) মোঃ নাজমুস সাদাত সেলিম বলেন, ‘আমি তো মাঝে মধ্যে শুনি ৮ হাজার রিংগিত কিংবা ১০ হাজার রিংগিতও লাগছে প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠাতে। কী করবেন বলুন? প্রবাসীর মরদেহ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যদি আমাদের কাছে দেওয়ার পরই আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।