সকালের রোদ্দুরে উজ্জ্বল হাসি নিয়ে হাসপাতালে ঢুকেছিলেন জাহিদা আক্তার। প্রথম সন্তানের জন্ম দেবেন, আনন্দ আর উত্তেজনায় ভরপুর ছিল মন। কিন্তু প্রসব পরবর্তী জটিলতায় সাধারণ একটি ওষুধ প্রয়োগে ভুলের কারণে তার নবজাতক শিশুটি আজ স্থায়ী অন্ধত্ব বরণ করেছে। জাহিদার স্বামী রফিকুল ইসলামের কণ্ঠে এখন শুধুই ক্ষোভ আর অসহায়ত্বের ভার, “ডাক্তার বললেন, ‘এটা আল্লাহর ইচ্ছা’। কিন্তু অন্য হাসপাতালের রিপোর্ট বলছে, ওষুধের ডোজ ভুল ছিল… আমার সন্তানের পুরো জীবন তো অন্ধকারে ডুবে গেল!” জাহিদাদের মতো হাজারো বাংলাদেশি পরিবার প্রতিদিন চিকিৎসা সেবায় অবহেলা বা মেডিকেল নেগলিজেন্স-এর শিকার হচ্ছেন, কিন্তু অধিকাংশই জানেন না আইনি প্রতিকারের সঠিক পথ। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাম্প্রতিক এক অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই ঢাকা শহরের বড় হাসপাতালগুলোতে আনুমানিক ১২০০টিরও বেশি মেডিকেল নেগলিজেন্স-এর অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ১৫-২০% ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা আইনি ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন। এই নীরব যন্ত্রণা, আর্থিক ধ্বংসযজ্ঞ এবং ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটেই জরুরি হয়ে উঠেছে মেডিকেল নেগলিজেন্স ক্লেম সম্পর্কে সচেতনতা এবং আপনার অধিকার জানুন। এটি শুধু ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন নয়, ভবিষ্যতে অন্য কারও জীবন যাতে একই ভুলের বলি না হয়, তার দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার লড়াই।
চিকিৎসাক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হলে আইনগতভাবে কী করণীয়?
মেডিকেল নেগলিজেন্স বলতে কী বোঝায়? সহজ ভাষায়, যখন একজন যোগ্য চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী (হাসপাতাল, নার্স, টেকনিশিয়ান ইত্যাদি) রুগীর প্রতি তার ডিউটি অব কেয়ার (যত্নের দায়িত্ব) পালনে ব্যর্থ হন, এবং সেই ব্যর্থতার ফলে রুগীর শারীরিক, মানসিক বা আর্থিক ক্ষতি হয়, তখন তাকে মেডিকেল নেগলিজেন্স বলা হয়। বাংলাদেশে এই দায়বদ্ধতা সাধারণত দেওয়ানি আইন (ক্ষতিপূরণের জন্য) এবং কিছু ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইন (যদি ইচ্ছাকৃত অবহেলা বা গুরুতর অসাবধানতা প্রমাণিত হয়) এর অধীনে আসে।
মেডিকেল নেগলিজেন্স ক্লেম দায়ের করার পথে প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল প্রমাণ সংগ্রহ। এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, যার সফলতা অনেকাংশেই নির্ভর করে দ্রুত ও সঠিকভাবে তথ্য সংরক্ষণের উপর:
- সম্পূর্ণ মেডিকেল রেকর্ড: এটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে সম্পূর্ণ মেডিকেল ফাইল (প্রবেশপত্র, ডিসচার্জ সারাংশ, প্রেসক্রিপশন, টেস্ট রিপোর্ট, অপারেশন নোট, নার্সিং নোট, বিল ইত্যাদি) অফিসিয়ালি সংগ্রহ করুন। অনেক প্রতিষ্ঠানই এই রেকর্ড সরিয়ে ফেলতে বা পরিবর্তন করতে পারে। দ্রুত আইনি নোটিশ পাঠিয়ে রেকর্ড সুরক্ষিত করা জরুরি।
- সাক্ষী: পরিবারের সদস্য, হাসপাতালের অন্য রোগী বা কর্মচারী যারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, তাদের বিবরণ লিখিতভাবে নিন এবং স্বাক্ষর করান। তাদের পরিচয় ও যোগাযোগের তথ্য রাখুন।
- চিকিৎসা সংক্রান্ত মতামত: অন্য একজন বা একাধিক স্বাধীন ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের (প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ) কাছ থেকে লিখিত মতামত নিন। তাদের রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকতে হবে যে বিদ্যমান চিকিৎসা প্রোটোকল, স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস বা যুক্তিসঙ্গত যত্নের পর্যায় থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে এবং সেই বিচ্যুতিই সরাসরি ক্ষতির কারণ হয়েছে।
- আর্থিক ক্ষতির প্রমাণ: চিকিৎসা বিল, ওষুধের বিল, ভ্রমণ খরচ, আয়ক্ষতির প্রমাণ (বেতন স্লিপ, নিয়োগপত্র), ভবিষ্যত চিকিৎসা খরচের অনুমান ইত্যাদি সংরক্ষণ করুন।
- ছবি/ভিডিও (যদি প্রযোজ্য): দৃশ্যমান আঘাত বা ক্ষতির ক্ষেত্রে ছবি বা ভিডিও প্রমাণ হিসেবে কাজ করতে পারে।
বাংলাদেশে মেডিকেল নেগলিজেন্স ক্লেম এর জন্য প্রাথমিক আইনি পথ দুটি:
- সরাসরি দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়ের: সুনির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলার জজ আদালতে (সাধারণত যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে বা যেখানে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে) দেওয়ানি মামলা (Money Suit) দায়ের করা যায়। এখানে প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করেন। আইনের সীমাবদ্ধতা অনুযায়ী, ঘটনার ৩ বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হয়।
- ফৌজদারি অভিযোগ: যদি ইচ্ছাকৃত অবহেলা, গুরুতর অসাবধানতা বা প্রতারণার অভিযোগ থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি বা ফৌজদারি মামলা (ধারা ৩৩৮/৩৩৯/৩২৪/৩২৬/৪২০ দণ্ডবিধি অনুযায়ী) দায়ের করা যায়। তবে শুধু ফৌজদারি মামলায় সাধারণত ক্ষতিপূরণ আদায় হয় না, আলাদা দেওয়ানি মামলা প্রয়োজন হতে পারে।
- বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এ অভিযোগ: বিএমডিসি চিকিৎসকদের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা। এখানে লিখিত অভিযোগ দাখিল করা যায়। বিএমডিসি তদন্ত করে দোষী সাব্যস্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সতর্কীকরণ, জরিমানা, স্থগিতাদেশ এমনকি নিবন্ধন বাতিলের মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে বিএমডিসির শাস্তি ক্ষতিগ্রস্ত রোগীকে সরাসরি আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয় না। বিএমডিসি ওয়েবসাইট থেকে অভিযোগ প্রক্রিয়া জানা যাবে। এটি ক্ষতিপূরণের বিকল্প না, তবে পেশাগত জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।
বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিকোণ: “প্রথমেই মাথা ঠান্ডা রাখুন এবং দ্রুততম সময়ে সমস্ত প্রাসঙ্গিক ডকুমেন্টেশন সংগ্রহে মনোনিবেশ করুন,” পরামর্শ দেন ঢাকার বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম, যিনি মেডিকেল নেগলিজেন্সের মামলায় বিশেষজ্ঞ। “অনেক ভুক্তভোগী আক্রোশে বা হতাশায় অভিযুক্ত চিকিৎসক বা প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন, যা প্রায়শই প্রমাণ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। একটি আইনি নোটিশ পাঠানো এবং পেশাদার আইনি পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে কার্যকর প্রথম পদক্ষেপ।
মেডিকেল নেগলিজেন্স প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ ও জয় করার কৌশল
মেডিকেল নেগলিজেন্স ক্লেম-এ সবচেয়ে বড় বাধা হল প্রমাণের বোঝা (Burden of Proof)। আইন অনুসারে, এই প্রমাণের দায়িত্ব ভুক্তভোগী-র উপরই বর্তায়। চিকিৎসা জটিল একটি পেশা, এবং আদালত সাধারণত চিকিৎসকদের পেশাগত সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে চান না, যদি না স্পষ্ট ও জোরালো প্রমাণ থাকে যে স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস থেকে গুরুতর বিচ্যুতি ঘটেছে যা কোনো যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসকই করতেন না (বোলাম টেস্ট – Bolam Test এর সংশোধিত রূপ)। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৌশল:
- স্বাধীন মেডিকেল এক্সপার্ট রিপোর্টের গুরুত্ব: আপনার আইনজীবীর সহায়তায় একজন নিস্পক্ষ ও স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (যিনি অভিযুক্ত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট নন) এর কাছ থেকে একটি বিশদ মতামত (Expert Opinion) নেওয়া অপরিহার্য। এই রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে:
- রোগীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য চিকিৎসার স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস বা গাইডলাইন কী ছিল (বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা – WHO, বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত সংস্থার গাইডলাইন উল্লেখ করে)।
- অভিযুক্ত চিকিৎসক/প্রতিষ্ঠান সেই স্ট্যান্ডার্ড থেকে কোথায় এবং কীভাবে বিচ্যুত হয়েছেন।
- এই বিচ্যুতিই সরাসরি রোগীর ক্ষতির কারণ হয়েছে (Causation)।
- সঠিক চিকিৎসা পেলে রোগীর ফলাফল কী হতো (Prognosis)।
- দায়িত্ব চিহ্নিতকরণ: কে দায়ী? শুধু সার্জন নন, অ্যানেসথেটিস্ট, নার্সিং স্টাফ, প্যাথলজি ল্যাব, এমনকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও (যেমন, অপর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণবিহীন কর্মী, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ) দায়বদ্ধ হতে পারেন। চুক্তি অনুযায়ী হাসপাতাল প্রায়ই তার কর্মচারীদের কাজের জন্য ভিকারিয়াস লায়াবিলিটির (Vicarious Liability) অধীন হয়।
- সরকারি হাসপাতালে ক্লেম: সরকারি হাসপাতাল বা ডাক্তারের বিরুদ্ধে ক্লেম দায়ের করতে হলে প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়/ডিজি হেলথ) আইনি নোটিশ দেওয়া বাধ্যতামূলক। নোটিশের জবাব না পেলে বা অসন্তোষজনক হলে তবেই আদালতে মামলা দায়ের করা যায়। সরকারি কর্মচানীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় সেকশন ১৯৭ CrPC অনুযায়ী আদালতের পূর্বানুমতি লাগতে পারে।
- আইনজীবী বাছাই: মেডিকেল নেগলিজেন্স ক্লেম অত্যন্ত জটিল ও বিশেষায়িত ক্ষেত্র। এমন আইনজীবী নির্বাচন করুন যার এই ধরনের মামলা পরিচালনার সফল অভিজ্ঞতা আছে। তারা মেডিকেল টার্মিনোলজি বুঝবেন, সঠিক এক্সপার্ট খুঁজে পাবেন এবং আদালতে কার্যকরভাবে আপনার পক্ষ উপস্থাপন করতে সক্ষম হবেন।
একটি সতর্কবার্তা: মামলা দীর্ঘায়িত হতে পারে (প্রায়ই ৫-১০ বছর বা তারও বেশি), খরচ বহন করতে হতে পারে (আদালত ফি, আইনজীবীর ফি, এক্সপার্ট ফি) এবং ফলাফল নিশ্চিত নয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আইনজীবীর সাথে সম্ভাব্যতা, ঝুঁকি ও খরচ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করুন। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR), যেমন মধ্যস্থতা (Mediation), দ্রুত ও কম খরচে সমাধানের পথ হতে পারে যদি উভয় পক্ষ সম্মত হয়।
কী ধরনের ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন?
মেডিকেল নেগলিজেন্স ক্লেম-এ সফল হলে আদালত সাধারণত নিম্নলিখিত ধারাগুলোতে ক্ষতিপূরণ (Damages) প্রদান করে থাকেন:
- বিশেষ ক্ষতি (Special Damages): এটি অর্থের মাধ্যমে সরাসরি পরিমাপযোগ্য আর্থিক ক্ষতি। যেমন:
- অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত চিকিৎসা খরচ (হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ, থেরাপি, প্রতিস্থাপন যন্ত্রপাতি)।
- আয়ক্ষতি (যদি রোগী উপার্জনক্ষম হন) – অতীতের হারানো আয় এবং ভবিষ্যতে উপার্জন হারানোর সম্ভাবনা।
- ভ্রমণ ও থাকার খরচ।
- সহায়ক সেবা (Attendant Care) এর খরচ।
- সাধারণ ক্ষতি (General Damages): এটি অর্থের মাধ্যমে সরাসরি পরিমাপ করা কঠিন, কিন্তু ক্ষতির প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত। যেমন:
- ব্যথা ও কষ্ট (Pain and Suffering): শারীরিক যন্ত্রণা ও মানসিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্য ক্ষতিপূরণ।
- জীবন উপভোগের ক্ষতি (Loss of Amenities): যদি আঘাতের কারণে পূর্বের জীবনযাপন বা বিনোদনের সুযোগ হারিয়ে যায় (যেমন, খেলাধুলা করতে না পারা, ভ্রমণে অক্ষম হওয়া)।
- সুযোগের ক্ষতি (Loss of Expectation of Life): আয়ুষ্কাল কমে গেলে।
- বিকলাঙ্গতা/অঙ্গহানি (Disfigurement/Amputation): স্থায়ী শারীরিক পরিবর্তন বা অঙ্গ হারানোর জন্য।
- দুর্ভোগ ও অসুবিধার ক্ষতি (Damages for Inconvenience): চিকিৎসা প্রক্রিয়াজনিত অতিরিক্ত দুর্ভোগের জন্য।
- নামমাত্র ক্ষতি (Nominal Damages): যদি অবহেলা প্রমাণিত হয় কিন্তু প্রকৃত ক্ষতি তেমন না থাকে (বিরল)।
- শাস্তিমূলক ক্ষতি (Exemplary/Punitive Damages): অত্যন্ত বিরল, শুধুমাত্র ইচ্ছাকৃত, জঘন্য বা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য, যাতে ভবিষ্যতে অনুরূপ কাজ নিরুৎসাহিত হয়।
ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণে আদালত রোগীর বয়স, আয়, আঘাতের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব, ভবিষ্যত প্রভাব, চিকিৎসার বর্তমান ও ভবিষ্যত খরচ, এবং বাংলাদেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেন।
সচেতন রোগী হিসেবে আপনার করণীয়: প্রতিরোধই সর্বোত্তম প্রতিকার
মেডিকেল নেগলিজেন্স ক্লেম একটি কষ্টকর ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই সচেতন রোগী হিসেবে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়:
- ডাক্তার ও প্রতিষ্ঠান বাছাই: প্রতিষ্ঠিত ও সুনামধন্য চিকিৎসক ও হাসপাতাল বেছে নিন। বিএমডিসির ওয়েবসাইটে চিকিৎসকের নিবন্ধন যাচাই করুন।
- সঠিক তথ্য প্রদান: আপনার সম্পূর্ণ মেডিকেল হিস্ট্রি, অ্যালার্জি, চলমান ওষুধ ইত্যাদি সম্পর্কে ডাক্তারকে স্পষ্ট ও সত্য তথ্য দিন। গোপন করবেন না।
- প্রশ্ন করতে ভয় পাবেন না: রোগ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা, সম্ভাব্য ঝুঁকি, বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া – সবকিছু বুঝে নিন। আপনার ইনফর্মড কনসেন্ট (তথ্যপ্রাপ্ত সম্মতি) নেওয়া ডাক্তারের দায়িত্ব।
- মেডিকেল রেকর্ডের কপি রাখুন: প্রতিটি পরামর্শ, পরীক্ষার রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশন, বিলের কপি নিজেই সংরক্ষণ করুন। এটি আপনার অধিকার।
- দ্বিতীয় মতামত নিন: জটিল রোগ বা বড় অপারেশনের আগে একাধিক বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
- সন্দেহ হলে দ্বিধা করবেন না: যদি চিকিৎসা বা সেবার মান নিয়ে আপনার মনে সন্দেহ জাগে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের (হাসপাতাল প্রশাসন, বিএমডিসি) কাছে তা নথিভুক্ত করুন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ: “রোগীর সক্রিয় অংশগ্রহণ চিকিৎসার ফলাফল উন্নত করে এবং ভুলের সম্ভাবনা কমায়,” বলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ও বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তাহমিনা হক। “চিকিৎসা একটি অংশীদারিত্ব। রোগীকে তার নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে উৎসাহিত করা এবং চিকিৎসককে প্রশ্ন করতে উৎসাহ দেওয়া – এই দ্বিমুখী যোগাযোগই মেডিকেল নেগলিজেন্স রোধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।”
জেনে রাখুন
প্রশ্ন: মেডিকেল নেগলিজেন্সের মামলা দায়েরের সময়সীমা কত?
উত্তর: বাংলাদেশে দেওয়ানি ক্ষতিপূরণের মামলা দায়েরের সাধারণ সময়সীমা ঘটনার ৩ বছরের মধ্যে (দি লিমিটেশন অ্যাক্ট, ১৯০৮ এর ধারা ২১ অনুযায়ী)। তবে, ক্ষতির প্রকৃতি বুঝতে দেরি হলে বা অব্যাহত চিকিৎসাধীন থাকলে কিছু ব্যতিক্রম হতে পারে। ফৌজদারি মামলার সময়সীমা অপরাধের ধরনের উপর নির্ভর করে (দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা দেখুন)। যেকোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে সময়সীমা সম্পর্কে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করা অত্যন্ত জরুরি।প্রশ্ন: সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাকালীন অবহেলার জন্য কে দায়ী? সরকার নাকি চিকিৎসক?
উত্তর: সাধারণত, সরকারি চিকিৎসক তার কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মেডিকেল নেগলিজেন্স করলে, তার জন্য রাষ্ট্র দায়ী হতে পারে (State Liability)। তবে, চিকিৎসকের ব্যক্তিগত গুরুতর অসাবধানতা বা ইচ্ছাকৃত অসদাচরণ প্রমাণিত হলে তাকে ব্যক্তিগতভাবেও দায়ী করা যেতে পারে। ক্লেম সাধারণত সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ/হাসপাতালের বিরুদ্ধে দায়ের করতে হয় এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য আলাদা দেওয়ানি মামলা দায়ের করতে হয়।প্রশ্ন: অপারেশন থিয়েটারে ভুল অঙ্গ অপারেশন বা ভুল রোগীর অপারেশন হলে কী করব?
উত্তর: এটি নেভার ইভেন্ট (Never Event) বা একেবারেই অমার্জনীয় ভুল হিসেবে বিবেচিত হয়, যা কখনোই ঘটার কথা নয়। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে:
১. অবিলম্বে ঘটনার বিস্তারিত লিখিত বিবরণ তৈরি করুন।
২. সমস্ত মেডিকেল রেকর্ড জরুরি ভিত্তিতে সুরক্ষিত করুন।
৩. হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করুন।
৪. দ্রুত একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর শরণাপন্ন হন।
৫. বিএমডিসি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দাখিল করুন। এ ধরনের ঘটনা প্রায়শই ফৌজদারি দায়বদ্ধতার দিকে যায়।প্রশ্ন: ডায়াগনোসিস ভুল হলে কি মেডিকেল নেগলিজেন্স হয়?
উত্তর: শুধু ডায়াগনোসিস ভুল হলেই মেডিকেল নেগলিজেন্স হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডায়াগনোসিস একটি জটিল প্রক্রিয়া। তবে, যদি প্রমাণিত হয় যে একজন যুক্তিসঙ্গতভাবে সক্ষম চিকিৎসক একই উপসর্গ ও পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সঠিক ডায়াগনোসিস করতে পারতেন, অথবা রোগীকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি যা সঠিক ডায়াগনোসিস দিতে পারত, এবং এই ভুল ডায়াগনোসিসের ফলেই রোগীর গুরুতর ক্ষতি হয়েছে (যেমন, চিকিৎসায় দেরি, ভুল চিকিৎসা), তাহলে তা মেডিকেল নেগলিজেন্স হিসেবে গণ্য হতে পারে।- প্রশ্ন: মেডিকেল নেগলিজেন্স ক্লেম এর জন্য আদালতের বাইরে অন্য কোনো সহায়তা পাবার উপায় আছে কি?
উত্তর: হ্যাঁ, কিছু বিকল্প পথ থাকতে পারে:- হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি: অনেক বেসরকারি হাসপাতালে অভিযোগ নিষ্পত্তির কমিটি থাকে। তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করুন।
- বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি): পেশাগত অসদাচরণের জন্য বিএমডিসিতে অভিযোগ দাখিল করা যায়।
- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়/জেলা স্বাস্থ্য কার্যালয়: সরকারি সেবা সংক্রান্ত অভিযোগের জন্য।
- জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (NHRC): চিকিৎসা সেবায় অবহেলাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে উত্থাপন করা যায়।
- মধ্যস্থতা (Mediation): উভয় পক্ষের সম্মতিতে একটি নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে আপোষ নিষ্পত্তি।
তবে, এই পদ্ধতিগুলো সাধারণত ক্ষতিপূরণ আদায়ের নিশ্চয়তা দেয় না। ক্ষতিপূরণের জন্য আদালতই প্রধান মাধ্যম।
আপনার স্বাস্থ্য এবং জীবন – আপনার সবচেয়ে মূল্যবান অধিকার। যখন এই অধিকার চিকিৎসা সেবায় অবহেলা বা ভুলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন নীরবতা বা ভয় কখনোই সমাধান নয়। মেডিকেল নেগলিজেন্স ক্লেম দায়ের করা কেবল আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য নয়; এটি একটি নৈতিক দায়িত্ব, নিজের জন্য, পরিবারের জন্য এবং ভবিষ্যতের রোগীদের জন্য যাতে তারা একই ভুলের শিকার না হন। আপনার অধিকার জানুন, প্রমাণ সংরক্ষণ করুন, আইনি পরামর্শ নিন এবং ন্যায়বিচারের জন্য দাঁড়ান। জাহিদা ও রফিকুলের মতো অসংখ্য পরিবারের যন্ত্রণা আমাদের শেখায় যে চিকিৎসকদের পেশাগত দায়বদ্ধতা এবং রোগীদের আইনি অধিকার – উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিয়েই একটি নিরাপদ ও জবাবদিহিমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। আজই সচেতন হোন, আপনার অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।