রাজশাহীর এক প্রত্যন্ত গ্রামের মাটির মাঠ। দুপুরের প্রখর রোদেও থেমে নেই একদল কিশোরী। তাদের জীর্ণ জার্সিতে লেখা ‘সূর্য্যিমুখী ফুটবল একাডেমি’। বল নিয়ে দৌড়, ট্যাকল, গোলের উল্লাস – প্রতিটি মুহূর্তে লড়াই শুধু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নয়, সমাজের সেই পুরনো ধারণার বিরুদ্ধেও যে বলে, ‘মেয়েরা ফুটবল খেলতে পারে না’। এই মাঠ, এই উচ্ছ্বাস, এই লড়াই – এগুলোই তো গল্পের শুরু। বাংলাদেশের মাটিতে মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়ন আজ শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তবতার এক জ্বলজ্বলে অধ্যায়, যার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। এই পথচলা সহজ ছিল না। নিষেধ, উপহাস, অবকাঠামোর অভাব, সামাজিক বাধা – সবকিছুকে ঠেলে আজ তারা দাঁড়িয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর স্বপ্ন বুকে নিয়ে। এই গল্প শুধু গোলের নয়, লড়াইয়ের, অদম্য মনোবলের, এবং এক অবিশ্বাস্য রূপান্তরের। মেয়েদের ফুটবল উন্নয়ন: উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনার এই যাত্রায়, আসুন দেখে নিই কীভাবে বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবলকে করে তুলছে নিজেদের শক্তি ও সম্ভাবনার প্রতীক।
মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়ন: উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার পথে বাংলাদেশের অভিযাত্রা
বাংলাদেশে নারী ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়েছিল অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। একসময় স্কুল-কলেজের মাঠে মেয়েদের ফুটবল খেলাকে দেখা হতো ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে। কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে পথ চলা শুরু করে একদল সাহসী মেয়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে সংগঠিত লিগ বা প্রতিযোগিতার বড়ই অভাব ছিল। খেলোয়াড়রা প্রায়শই নিজেদের উদ্যোগে, স্থানীয় টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে দক্ষতা বাড়াতেন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)-এর নারী ফুটবলে মনোযোগ বৃদ্ধি এবং ফিফা, এএফসির মতো সংস্থাগুলোর সহযোগিতা প্রকল্পগুলোই মূলত এই খেলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে শুরু করে।
মাইলফলকগুলো:
- ২০১০ দশকের সূচনা: বাফুফে নারী ফুটবলকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়ার জন্য সক্রিয় পরিকল্পনা নিতে শুরু করে। জাতীয় দল গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
- জাতীয় দলের সাফল্য: সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য (বিশেষ করে ২০২২ সালে রানার্স-আপ হওয়া) দেশব্যাপী নারী ফুটবল নিয়ে উৎসাহ সৃষ্টি করে।
- প্রিমিয়ার লিগের সূচনা: ২০২১ সালে বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল প্রিমিয়ার লিগের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি স্থানীয় খেলোয়াড়দের জন্য নিয়মিত প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলার সুযোগ তৈরি করে এবং তাদেরকে জাতীয় দলে যাওয়ার পথ সুগম করে। লিগে জামালপুর, বসুন্ধরা কিংস, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের মতো দলগুলো শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলে।
- তরুণ প্রতিভা বিকাশ: বাফুফে এবং বিভিন্ন জেলা অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক নিয়মিত অনূর্ধ্ব-১৪, অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হচ্ছে। স্কুল ও মহিলা ফুটবল লিগের প্রসার ঘটছে। এটি ভবিষ্যত প্রজন্মের খেলোয়াড় তৈরির ভিত্তি স্থাপন করছে।
- আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ: জাতীয় দল এখন শুধু সাফেই নয়, এএফসি কাপ বাছাইপর্ব এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফ্রেন্ডলি ম্যাচেও অংশ নিচ্ছে, যা তাদের অভিজ্ঞতা বাড়াতে সাহায্য করছে।
সাক্ষ্য: মাঠের যোদ্ধাদের কণ্ঠস্বর
বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও স্ট্রাইকার, সাবিনা খাতুন, যিনি দেশের নারী ফুটবলের অগ্রযাত্রার জীবন্ত প্রতীক, বলেন, “আমরা যখন শুরু করেছিলাম, ভালো জার্সি-বুট জোগাড় করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। মাঠের চারপাশে দর্শক বলতেই, ‘মেয়েরা আবার ফুটবল খেলবে!’ আজকে প্রিমিয়ার লিগ হচ্ছে, মেয়েরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলছে, মাঠ ভরে উঠছে উৎসাহী দর্শকে। এটা অবিশ্বাস্য একটা পরিবর্তন। এই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি আমরা। কিন্তু আমাদের এখনো অনেক দূর যেতে হবে।”
মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়নে প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ ও উত্তরণের উপায়
যদিও মেয়েদের ফুটবল উন্নয়ন: উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর দিকে এগোচ্ছে, তবুও সামনে বেশ কিছু বাধা দাঁড়িয়ে আছে যেগুলো জয় করতে না পারলে এই গতি স্থায়ী হবে না।
- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা:
- চ্যালেঞ্জ: অনেক পরিবার এখনও মেয়েদের ফুটবল খেলাকে পেশা বা গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াকলাপ হিসেবে মানতে চায় না। ‘লজ্জা’, ‘অভদ্রতা’, ‘অভিভাবকদের অনুমতি না পাওয়া’ – এসব ধারণা এখনও প্রচলিত, বিশেষ করে গ্রামীণ ও অর্ধ-শহুরে এলাকায়। খেলার সময় পোশাক নিয়ে সমালোচনা বা উত্যক্ত করার ঘটনাও বিরল নয়।
- উত্তরণের উপায়:
- সচেতনতা বৃদ্ধি: মিডিয়া কভারেজ, সাফল্যের গল্প প্রচার (সাবিনা, কৃষ্ণা রানী সরকার, মরিয়ম মারিয়া, সেজুতি করণ প্রমুখের মতো আইকন তৈরি), স্কুল-কলেজে সেমিনার – এসবের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।
- পারিবারিক সম্পৃক্ততা: ক্লাব ও ফেডারেশনের উচিত অভিভাবকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, তাদের বুঝানো যে ফুটবল মেয়েদের জন্য একটি সম্মানজনক ও সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার পথ হতে পারে। সফল খেলোয়াড়দের পরিবারগুলোর অভিজ্ঞতা শেয়ার করা।
- রোল মডেলের গুরুত্ব: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সফল মেয়ে ফুটবলারদের উপস্থিতি তরুণীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। তাদের গল্প আরও ব্যাপকভাবে প্রচার করা প্রয়োজন। [বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ওয়েবসাইটে (bff.com.bd) প্রোফাইলগুলো দেখুন]।
- অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও সুযোগ-সুবিধার অভাব:
- চ্যালেঞ্জ: মানসম্মত ফুটবল মাঠ, বিশেষ করে শুধুমাত্র নারীদের জন্য বরাদ্দকৃত বা প্রাইভেট ট্রেনিং ফ্যাসিলিটির মারাত্মক অভাব। অনেক জেলায় পর্যাপ্ত মাঠই নেই। থাকলেও তার রক্ষণাবেক্ষণ ও বরাদ্দে নারী দলগুলো প্রায়শই পিছিয়ে থাকে। ফিজিওথেরাপি, স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ, উন্নত পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, আধুনিক ট্রেনিং সরঞ্জামের অভাব প্রকট।
- উত্তরণের উপায়:
- বিনিয়োগ বৃদ্ধি: সরকারি (যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় – [mos.gov.bd]) এবং বেসরকারি খাতকে নারী ফুটবলের অবকাঠামো উন্নয়নে আরও বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নারীদের জন্য মানসম্পন্ন মাঠ ও ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ জরুরি।
- বিদ্যমান সুবিধার সর্বোত্তম ব্যবহার: বিদ্যমান স্টেডিয়াম ও ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিতে নারী দলগুলোর জন্য পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ নিশ্চিত করা।
- বাফুফের নেতৃত্ব: ফেডারেশনকে নারী দলগুলোর জন্য আলাদা ও উন্নত ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। আধুনিক সরঞ্জাম, মেডিকেল টিম ও পুষ্টিবিদ নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। [ফিফা ফরওয়ার্ড প্রোগ্রামের মতো উদ্যোগ থেকে অনুদান তদ্বির]।
- আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা ও পেশাদারিত্বের অভাব:
- চ্যালেঞ্জ: প্রিমিয়ার লিগের আগে খেলোয়াড়দের জন্য আর্থিক সুযোগ ছিল নিতান্তই কম। লিগ শুরু হওয়ায় কিছুটা বেতন ও ম্যাচ ফি চালু হলেও তা এখনও পুরুষ ফুটবলের তুলনায় অনেক কম এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য যথেষ্ট নয়। দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার পরিকল্পনা, পেশা শেষে কর্মসংস্থান বা শিক্ষার সুযোগের অভাব খেলোয়াড়দের মনে অনিশ্চয়তা তৈরি করে।
- উত্তরণের উপায়:
- লিগের আর্থিক ভিত্তি মজবুত করা: স্পনসরশিপ বাড়ানো, টিকেট বিক্রি, ব্রডকাস্টিং রাইটস বিক্রির মাধ্যমে লিগের রাজস্ব বাড়ানো। এর সুফল সরাসরি খেলোয়াড়দের বেতন ও সুযোগ-সুবিধায় বরাদ্দ করতে হবে। খেলোয়াড়দের ন্যূনতম বেতন কাঠামো নিশ্চিত করা।
- পেশাগত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার সুযোগ: বাফুফে এবং ক্লাবগুলোর উচিত খেলোয়াড়দের জন্য কোচিং কোর্স, রেফারি ট্রেনিং, স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট বা অন্যান্য পেশাগত প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি করা। এতে ক্যারিয়ার শেষে তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ বা BKSP-এর সাথে সহযোগিতা করা যেতে পারে।
- সরকারি চাকুরিতে কোটা: পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, বিসিএস (শিক্ষা/ক্রীড়া ক্যাডার) বা অন্যান্য সরকারি চাকুরিতে যোগ্য নারী ফুটবলারদের জন্য বিশেষ কোটা নীতিমালা করা যেতে পারে।
- দক্ষ কোচ ও টেকনিক্যাল স্টাফের অভাব:
- চ্যালেঞ্জ: নারী ফুটবলের জন্য বিশেষায়িত ও উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোচ, বিশেষ করে গ্রাসরুট লেভেলে, খুবই কম। আধুনিক ফুটবলের কৌশল, ফিটনেস ম্যানেজমেন্ট, সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অভাব আছে।
- উত্তরণের উপায়:
- কোচ এডুকেশন প্রোগ্রাম: বাফুফে এবং এএফসির সহায়তায় নারী ফুটবলের জন্য বিশেষায়িত কোচিং কোর্স চালু ও বাধ্যতামূলক করা। বিদেশ থেকে অভিজ্ঞ কোচ আনা এবং তাদের মাধ্যমে স্থানীয় কোচদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।
- তরুণ কোচ উত্থাপন: সাবেক নারী ফুটবলারদের কোচিং পেশায় আকৃষ্ট করা এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাদের অভিজ্ঞতা অমূল্য।
- টেকনিক্যাল সাপোর্ট টিম: জাতীয় দল ও প্রিমিয়ার লিগ ক্লাবগুলোতে পূর্ণকালীন ফিজিও, স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ, পারফরম্যান্স অ্যানালিস্ট নিয়োগ নিশ্চিত করা।
মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়নে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার কার্যকর কৌশল
চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেই মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়ন: উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য দরকার সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
- গ্রাসরুট লেভেলে ব্যাপক সম্প্রসারণ:
- স্কুল ফুটবল লিগ: প্রতিটি স্কুলে মেয়েদের ফুটবল দল গঠন এবং আন্তঃস্কুল, আন্তঃউপজেলা, আন্তঃজেলা লিগ চালু করা। এতে খুব অল্প বয়স থেকেই প্রতিভা খুঁজে পাওয়া যাবে এবং অংশগ্রহণ বাড়বে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এর সাথে সমন্বয়ে এটি করা যেতে পারে।
- জেলা অ্যাকাডেমি: প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে নারী ফুটবল একাডেমি স্থাপন, যেখানে বিনামূল্যে বা নামমাত্র ফিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা।
- কমিউনিটি ক্লাব: স্থানীয় পর্যায়ে নারী ফুটবল ক্লাব গড়ে তোলা এবং তাদের নিয়মিত লিগে অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করা।
- প্রিমিয়ার লিগকে শক্তিশালী ও টেকসই করা:
- দীর্ঘ মৌসুম: বর্তমান স্বল্প ম্যাচের লিগকে ধীরে ধীরে দীর্ঘ মৌসুমে রূপান্তর করা, যাতে খেলোয়াড়রা বেশি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা পায়।
- ক্লাব ইনফ্রাস্ট্রাকচার: ক্লাবগুলোর নিজস্ব ট্রেনিং গ্রাউন্ড, একাডেমি এবং যুব দল গড়ে তোলার উপর জোর দেওয়া। স্থায়ী খেলোয়াড় পুল তৈরি করা।
- মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিং: লিগকে জনপ্রিয় করতে সক্রিয় মার্কেটিং ক্যাম্পেইন, সোশ্যাল মিডিয়া একটিভিটি, স্টার খেলোয়াড়দের প্রোমোশন। দর্শকদের মাঠে আনার ব্যবস্থা করা।
- জাতীয় দলের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা:
- এ-টিমের পাশাপাশি যুব দলের উন্নয়ন: অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-২০ দলগুলোর জন্য নিয়মিত আন্তর্জাতিক ফ্রেন্ডলি ও টুর্নামেন্ট আয়োজন করা। তাদের জন্য আলাদা ক্যাম্প ও এক্সপোজার নিশ্চিত করা।
- বিদেশে প্রস্তুতি ও খেলা: জাতীয় দলকে উন্নত দেশগুলোর সাথে নিয়মিত খেলার সুযোগ দেওয়া এবং সম্ভব হলে বিদেশে লম্বা সময়ের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে রাখা।
- টেকনিক্যাল ডিরেক্টর: নারী ফুটবলের জন্য পৃথক ও অভিজ্ঞ টেকনিক্যাল ডিরেক্টর নিয়োগ, যিনি দীর্ঘমেয়াদি ফুটবল ফিলোসফি ও ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান তৈরি করবেন।
- বিনিয়োগ ও স্পনসরশিপ আকর্ষণ:
- মাধ্যমিকতা বৃদ্ধি: টেলিভিশন, অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে নারী ফুটবল লিগ ও জাতীয় দলের ম্যাচের লাইভ সম্প্রচার নিশ্চিত করা। দর্শক বাড়লে স্পনসররাও আগ্রহী হবে।
- কর্পোরেট অংশীদারিত্ব: দেশের বড় বড় কর্পোরেট হাউসগুলোর কাছে নারী ফুটবলের বিপণন সম্ভাবনা তুলে ধরা এবং তাদেরকে দল, লিগ বা একাডেমি স্পনসর করতে উদ্বুদ্ধ করা।
- সরকারি অনুদান: ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে নারী ফুটবলের জন্য বাজেট বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো।
- মিডিয়া কভারেজ ও জনসচেতনতা:
- ইতিবাচক ও নিয়মিত কভারেজ: পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টালগুলোতে নারী ফুটবলের সাফল্য, সংগ্রাম, খেলোয়াড়দের জীবনী নিয়মিতভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা।
- ডকুমেন্টারি ও ফিচার: নারী ফুটবলারদের জীবন, সংগ্রাম ও সাফল্য নিয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক ডকুমেন্টারি ও ফিচার তৈরি ও প্রচার।
- সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন: #SupportWomenFootball, #FutureIsFemaleFootball, #BrightFutureBDWomenFootball – এরকম হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা ও সমর্থন তৈরি করা।
মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়নে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ: তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে
বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল উন্নয়ন: উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর সবচেয়ে বড় ভিত্তি হল তরুণী প্রজন্মের মাঝে এই খেলার প্রতি ক্রমবর্ধমান উৎসাহ ও অংশগ্রহণ। স্কুল, একাডেমি এবং কমিউনিটি ক্লাবগুলোতে যে তরুণীরা আজ প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, তারাই আগামী দিনের সাবিনা, কৃষ্ণা রানী, মারিয়া। তাদের সুরক্ষা, সুযোগ এবং সঠিক গাইডেন্স নিশ্চিত করতে পারলেই এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
- সেফগার্ডিং পলিসি: নারী খেলোয়াড়দের যেকোনো ধরনের হয়রানি, শোষণ ও নির্যাতন থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বাফুফে এবং ক্লাবগুলোকে কঠোর নীতিমালা (Safeguarding Policy) প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। অভিযোগ নিষ্পত্তির স্বচ্ছ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- শিক্ষার সমন্বয়: খেলোয়াড়দের জন্য শিক্ষা অব্যাহত রাখার সুযোগ তৈরি করা। বিশেষ স্কলারশিপ বা কোচিং এর ব্যবস্থা করা যাতে ক্রীড়া ও শিক্ষা একসাথে চলতে পারে।
- মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: প্রতিযোগিতার চাপ, আঘাত, সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় খেলোয়াড়দের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পেশাদার কাউন্সেলিং সুবিধা নিশ্চিত করা।
একটি প্রত্যাশার গল্প: খুলনার এক ছোট্ট একাডেমির ১৪ বছরের ফরিদা বলে, “আমি টিভিতে দিদি সাবিনার গোল দেখে ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখি। আমার বাবা প্রথমে রাজি ছিলেন না। কিন্তু আমাদের কোচ স্যার বাড়ি গিয়ে বুঝিয়েছেন। এখন বাবা মাঝে মাঝে ম্যাচ দেখতেও আসেন। আমি বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলব, অনেক গোল করব।” ফরিদাদের মতো হাজারো কণ্ঠে ধ্বনিত এই স্বপ্নই তো মেয়েদের ফুটবল উন্নয়ন: উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর সবচেয়ে বাস্তব ও আশাব্যঞ্জক দিক।
জেনে রাখুন
- বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবল কবে থেকে নিয়মিতভাবে শুরু হয়?
যদিও বিচ্ছিন্নভাবে আগেও খেলা হত, তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারী ফুটবলের বিকাশ মূলত ২০১০-এর দশকের শুরুতে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এর অধীনে জাতীয় দল গঠন ও নিয়মিত আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে ত্বরান্বিত হয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল প্রিমিয়ার লিগের সূচনা এটি আরও সুসংহত করে। - মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়নে বাফুফের ভূমিকা কী?
বাফুফে নারী ফুটবলের কেন্দ্রীয় সংগঠক। তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে জাতীয় দল (সিনিয়র ও যুব) গঠন ও পরিচালনা, প্রিমিয়ার লিগ ও অন্যান্য ঘরোয়া টুর্নামেন্ট আয়োজন, কোচ ও রেফারি প্রশিক্ষণ, ফিফা/এএফসি প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন, নীতিমালা প্রণয়ন, এবং সারাদেশে নারী ফুটবলের প্রসার ঘটানো। তবে চ্যালেঞ্জ অনেক, আরও সক্রিয়তা ও বিনিয়োগ প্রয়োজন। - বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা (অনুমতি, সমালোচনা), পর্যাপ্ত মানসম্মত মাঠ ও ট্রেনিং সুবিধার অভাব, দক্ষ কোচ ও টেকনিক্যাল স্টাফের স্বল্পতা, খেলোয়াড়দের আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা ও পেশাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, এবং গ্রাসরুট লেভেলে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব। - মেয়েরা ফুটবল খেলে তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিশ্চিত করার উপায় কী?
পেশাদার লিগ (প্রিমিয়ার লিগ) শক্তিশালী করে বেতন বৃদ্ধি, ক্লাবগুলোর স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে তোলা, খেলোয়াড়দের জন্য কোচিং/রেফারিং/স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টের প্রশিক্ষণ সুযোগ সৃষ্টি, সরকারি চাকুরিতে বিশেষ কোটা নীতি চালু করা, এবং সফল খেলোয়াড়দের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া – এই উপায়গুলো ক্যারিয়ার নিশ্চিত করতে পারে। - সাধারণ মানুষ কিভাবে মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়নে সাহায্য করতে পারেন?
স্থানীয় টুর্নামেন্টে গিয়ে দর্শক হিসেবে সমর্থন জানানো, সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিবাচকভাবে শেয়ার করে সচেতনতা বাড়ানো, মেয়ে সন্তানদের ফুটবল খেলতে উৎসাহিত করা, স্থানীয় ক্লাব বা একাডেমিকে স্বেচ্ছাসেবী বা ছোট অনুদান দিয়ে সহায়তা করা, এবং স্পনসর বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে নারী ফুটবল স্পনসর করার আহ্বান জানানো – এসবের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ অবদান রাখতে পারেন। - বাংলাদেশ মেয়েদের ফুটবলের ভবিষ্যৎ কতটা উজ্জ্বল?
সাম্প্রতিক বছরগুলোর অগ্রগতি (প্রিমিয়ার লিগ, সাফে সাফল্য, তরুণ প্রতিভার উত্থান) এবং ক্রমবর্ধমান জনসমর্থন মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়ন: উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর ইঙ্গিত দেয়। তবে এই সম্ভাবনাকে স্থায়ী ও টেকসই করতে সামাজিক বাধা দূরীকরণ, অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার ব্যাপক উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা এবং ক্রমাগত বিনিয়োগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। সঠিক দিকনির্দেশনা ও সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকলে এশিয়ার শক্তিশালী দলগুলোর কাতারে উঠে আসা বাংলাদেশের পক্ষে অসম্ভব নয়।
বাংলাদেশের মাটিতে যে স্বপ্ন একদিন কেবল চোখে জল এনেছিল, আজ তা হাজারো মেয়ের পায়ের জোরালো শব্দে, বলের গতিপথে, গোলের উল্লাসে ধ্বনিত হচ্ছে। সামাজিক বাধা, অবকাঠামোর ঘাটতি, আর্থিক অনিশ্চয়তা – সবকিছুকে ডিঙিয়ে মেয়েদের ফুটবল আজ দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন ভোরের সন্ধিক্ষণে। প্রিমিয়ার লিগের মাঠে প্রতিটি ট্যাকল, জাতীয় দলের জার্সিতে প্রতিটি গোল, গ্রামের মাটির কোর্টে প্রতিটি দৌড়ঝাঁপ শুধু একটি খেলার ইতিহাস রচনা করছে না, রচনা করছে লিঙ্গসমতার, সামাজিক রূপান্তরের এক বলিষ্ঠ অধ্যায়। সাবিনা, কৃষ্ণা রানীরা যে পথ দেখিয়েছেন, ফরিদা, মরিয়ামেরা তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে দৃপ্তপায়ে। এই যাত্রাপথে আমাদের দায়িত্ব – সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, সামাজিক কুসংস্কার ভাঙা, সুযোগের দরজা খুলে দেওয়া। কারণ, বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়ন: উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ শুধু তাদের জয় নয়, এটি আমাদের সকলের জয়, দেশের জয়। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই – মাঠে গিয়ে সমর্থন জানিয়ে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কণ্ঠ তুলে, এবং আমাদের চারপাশের প্রতিটি সম্ভাবনাময় মেয়েকে বলতে উৎসাহিত করে: ‘খেলো, জিতো, স্বপ্ন দেখো!’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।