জুমবাংলা ডেস্ক : গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) সচিবালয়ে নিজ দফতরে প্রেস ব্রিফিংয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম এ তথ্য জানান।
মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ আছে। এর মধ্যে সরকারি সম্পদ অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো আমলে নেওয়া হয়েছে। সেগুলো তদন্তের স্বার্থে বলা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আইনের ধারা অনুযায়ী সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনে তিন সদস্যের প্যানেল মেয়র গঠন করা হয়েছে। প্যানেলের জ্যেষ্ঠ সদস্য মেয়রের দায়িত্ব পালন করবেন।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনে ‘মেয়র ও কাউন্সিলরদের সাময়িক বরখাস্তকরণ’অংশে বলা হয়েছে- সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়র বা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হলে সরকার লিখিত আদেশের মাধ্যমে মেয়র বা কাউন্সিলরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারবে। এই আইনেই জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
এই আইনের উপ-ধারায় বলা হয়েছে- সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়রকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হলে সেই আদেশপ্রাপ্তির তিনদিনের মধ্যে মেয়র প্যানেলের জ্যেষ্ঠ সদস্যের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন। মেয়রের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের আইনি প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত অথবা সেই মেয়র অপসারিত হলে, তার পরিবর্তে নতুন মেয়র নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র দায়িত্ব পালন করবেন।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের ১৩ ধারায় মেয়র ও কাউন্সিলর পদ থেকে অপসারণের কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে—
(ক) যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া সিটি করপোরেশনের পর পর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকেন; (খ) নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হন; (গ) দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করেন অথবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন; (ঘ) অসদাচরণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন; (ঙ) নির্বাচনের অযোগ্য ছিলেন মর্মে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন মাসের মধ্যে প্রমাণিত হলে; (চ) বার্ষিক ১২টি মাসিক সভার পরিবর্তে ন্যূনতম ৯টি সভা গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া অনুষ্ঠান করতে, বা ক্ষেত্রমত, সভায় উপস্থিত থাকতে ব্যর্থ হন।
এখানে ‘অসদাচরণ’ বলতে ক্ষমতার অপব্যবহার, এ আইন অনুযায়ী বিধি-নিষেধ পরিপন্থী কার্যকলাপ, দুর্নীতি, অসদুপায়ে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, ইচ্ছাকৃত অপশাসন, নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিল না করা বা অসত্য দেওয়াকে বোঝাবে। আইনে আরও বলা আছে, অপসারণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত গ্রহণ করার আগে বিধি অনুযায়ী তদন্ত ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।
সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়র বা কাউন্সিলরকে পদ থেকে অপসারণ করা হলে, ওই আদেশের তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করতে পারবেন এবং আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপসারণের আদেশ স্থগিত থাকবে। সব পক্ষকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিতে রাষ্ট্রপতি ওই অপসারণের আদেশ পরিবর্তন, বাতিল বা বহাল রাখতে পারবেন। আপিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির আদেশই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিধান না থাকলেও সরকার চাইলে সিটি কর্পোরেশনের একজন মেয়রকে অপসারণের অনেক পথ রয়েছে। অসদাচরণ বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য মেয়রকে প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলররা মেয়রের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে পারেন।
এর আগে গত ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আওয়ামী লীগ থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয় মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি কটূক্তির অভিযোগে আওয়ামী লীগ থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাওয়া এ নেতাকে দলের পদ থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি তার প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়।
গণভবনের ওই সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘গাজীপুরের মেয়রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে। তিনি (জাহাঙ্গীর) বঙ্গবন্ধকে নিয়ে, আমাদের ইতিহাস নিয়ে কটাক্ষ করে বক্তব্য দিয়েছেন। কাজেই তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবেও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। বিষয়টি অফিসিয়ালি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে।’
মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বিষয়ে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আমাদের অস্তিত্বে আঘাত হেনেছে। আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ। এখানে বিএনপি-জামায়াত আঘাত করার সাহস দেখাতে পারেনি। তিনি সেই সাহস দেখিয়েছেন। তার আওয়ামী লীগ করার অধিকার নেই।’
গত ২২ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। চার মিনিটের ওই ভিডিওতে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের নিয়ে ‘বিতর্কিত’মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীর আলম। এই ভিডিওতে মেয়র মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর দেশ স্বাধীন করার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, হেফাজতের প্রয়াত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে তার সখ্য ও রাষ্ট্রীয় দুটি সংস্থা নিয়ে নানা আপত্তিকর মন্তব্য করছেন মেয়র জাহাঙ্গীর।
জাহাঙ্গীরের মন্তব্য ঘিরে গাজীপুর আওয়ামী লীগের একাংশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা জাহাঙ্গীরের বহিষ্কার দাবি করেন। এ ঘটনায় গাজীপুরের রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ নিয়ে গাজীপুরে মেয়র-সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে কয়েক দফা।
এ বিষয়ে আলম সরকার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে একটি মহল চক্রান্ত করে এডিটেড ভিডিও বের করেছে। সেটা স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। সেটা আবার কিছু গণমাধ্যমও প্রকাশ করেছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমার যে আদর্শ; বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ। এই তিনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। মানুষের জীবনে ভুল থাকতে পারে, ভুল হতে পারে। আমার কিছু কথা কেটে কেটে মিথ্যাচারসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি নেত্রীর কাছে বিষয়টি স্পষ্ট করার চেষ্টা করবো।’
জাহাঙ্গীর আলম তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগ শাখার সহ-সভাপতি ছিলেন। এরপর একে একে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সহ-সম্পাদক ও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন। সর্বশেষ তিনি গাজীপুর সদর ও টঙ্গী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন। বহিষ্কারের আগ পর্যন্ত তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।