সকালবেলা ঘুম ভাঙে স্মার্টফোনের এলার্মে। চোখ খুলেই প্রথম দেখি নোটিফিকেশনের ঝলকানি। দিনভর হাতের মুঠোয় বন্দী সেই পর্দা – খবর, মেসেজ, ভিডিও কল, গেম, সোশ্যাল মিডিয়ার স্রোত। রাতের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার আলোয় উদ্ভাসিত আমাদের চোখ আর মন। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই টের পেলেন তরুণ উদ্যোক্তা আরিফুল হক। ঘাড়ে অসহ্য ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখছেন, রাতে ঠিকমতো ঘুম আসে না, মনোযোগও যেন উবে যাচ্ছে কোথায়। চিকিৎসকের প্রশ্নটা তাকে স্তম্ভিত করে দিল: “আপনার দিনে কত ঘণ্টা মোবাইল ব্যবহার করেন?” এই গল্প আরিফুলের একার নয়। ঢাকার অফিস থেকে শুরু করে রংপুরের কলেজ ক্যাম্পাস, খুলনার বাসা-বাড়ি – কোটি কোটি বাঙালির জীবনে মোবাইল ফোন আজ অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু এই সহচর যখন নিঃশব্দে আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষয় করতে থাকে, তখন জরুরি হয়ে ওঠে সচেতনতা ও সুরক্ষার উপায় জানা। এই নিবন্ধে, মোবাইল ফোনের ক্ষতি ও প্রতিকার:জরুরি নির্দেশিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যাতে আপনি এই অপরিহার্য যন্ত্রটির সুবিধা নিতে পারেন তার অন্ধকার দিকগুলোকে চিনে ও জয় করে।
মোবাইল ফোনের ক্ষতি ও প্রতিকার: শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব (H2)
মোবাইল ফোন আমাদের হাতের নাগালে অসীম জ্ঞান ও সংযোগ এনে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার বিনিময়ে আমাদের দেহই হয়ে উঠছে মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্র। চিকিৎসক ও গবেষকরা ক্রমাগত সতর্ক করছেন দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ব্যবহারের নানাবিধ শারীরিক জটিলতার ব্যাপারে:
- চোখের উপর আঘাত (ডিজিটাল আই স্ট্রেন): ছোট পর্দায় দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকা, নীল আলোর (Blue Light) নিঃসরণ এবং কম পলক ফেলা – এই ত্রয়ী মিলে তৈরি করে ‘কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম’। লক্ষণগুলো স্পষ্ট: চোখে জ্বালাপোড়া, শুষ্কতা, লালভাব, ঝাপসা দৃষ্টি, মাথাব্যথা এবং কখনো কখনো দৃষ্টিশক্তির স্থায়ী ক্ষতি পর্যন্ত হতে পারে, বিশেষ করে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে যাদের চোখের গঠন এখনও পূর্ণতা পায়নি। ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (BSMMU) চক্ষু বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে স্ক্রিন-রিলেটেড চোখের সমস্যায় ভোগা রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে।
- মাসকুলোস্কেলেটাল ডিজর্ডার (হাড়-পেশী-জোড়ার সমস্যা): ‘টেক্সট নেক’ বা ‘স্মার্টফোন নেক’ শব্দগুলো এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিচিত পরিভাষা। নীচের দিকে তাকিয়ে ফোন ব্যবহারের সময় মাথার অতিরিক্ত ওজন (১০-১২ পাউন্ড) ঘাড়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ গুণ বেশি। ফলাফল? ঘাড়, কাঁধ ও পিঠে তীব্র ব্যথা, গলার পেশীতে খিঁচুনি, এমনকি স্নায়ুর উপর চাপ পড়ার মতো জটিলতা। একইভাবে, থাম্বের অতিরিক্ত ব্যবহার (টেক্সটিং, স্ক্রলিং) ‘টেক্সট ক্লজ’ বা ডি ক্যুয়ারভেইন’স টেনোসাইনোভাইটিস নামক বেদনাদায়ক অবস্থার সৃষ্টি করে, যেখানে হাতের বুড়ো আঙুলের টেন্ডন ফুলে যায়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফিজিওথেরাপি বিভাগে দৈনিক আসা রোগীদের প্রায় ৩০% এখন এই ধরনের সমস্যায় ভুগছেন।
- ঘুমের চক্রে ব্যাঘাত: মোবাইল স্ক্রিন থেকে নির্গত নীল আলো আমাদের মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্রন্থিকে ধোঁকা দেয়। এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় ‘মেলাটোনিন’ নামক হরমোন, যা আমাদের ঘুমাতে সাহায্য করে। নীল আলো মেলাটোনিন উৎপাদনকে দমন করে, ফলে ঘুম আসতে দেরি হয়, ঘুমের গভীরতা কমে যায় এবং সারাদিন ক্লান্তি ও ঝিমুনি ভর করে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন সার্ভে (BNHNS) এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শহুরে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে প্রায় ৬৫% রাত ১১টার পরও সক্রিয়ভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, যা তাদের ঘুমের মানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
- বিকিরণ ও দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি (একটি জটিল বিতর্ক): মোবাইল ফোন রেডিওফ্রিকোয়েন্সি (RF) বিকিরণ নির্গত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা (IARC) এই বিকিরণকে ‘সম্ভবত মানুষের জন্য কার্সিনোজেনিক’ (Group 2B) হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। যদিও সরাসরি ক্যান্সারের সাথে এর যোগসূত্র প্রমাণিত নয় এবং ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত কম বলে ধরা হয়, বিশেষ করে সেল টাওয়ারের কাছাকাছি থাকার তুলনায়, তবুও দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ মাত্রার এক্সপোজার নিয়ে গবেষণা ও সতর্কতা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করেন, ফোনে কথা বলার সময় হেডসেট বা স্পিকার মোড ব্যবহার করা এবং শরীরের সংস্পর্শে (পকেটে, ব্রা-তে) ফোন কম রাখা। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (BTRC) নির্দেশিকাও এই সতর্কতাগুলো সমর্থন করে।
মোবাইল ফোনের ক্ষতি ও প্রতিকার: মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক জীবনের উপর নীরব ঘাতক (H2)
মোবাইল ফোনের ক্ষতি কেবল শারীরিক সীমানায় আটকে নেই; এটি আমাদের মানসিক সুস্থতা, সামাজিক বন্ধন এবং আবেগিক ভারসাম্যের গভীরেও আঘাত হানে:
- স্মার্টফোন অ্যাডিকশন ও ডোপামিনের ফাঁদ: প্রতিবার নোটিফিকেশন, লাইক, কমেন্ট বা নতুন কোনো কন্টেন্ট দেখার সময় আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক ‘ফিল-গুড’ নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসৃত হয়। এই আনন্দদায়ক অনুভূতি বারবার খোঁজার তাগিদ তৈরি করে, যা সহজেই আসক্তিতে রূপ নেয়। লক্ষণগুলো চেনা: ফোন ছাড়া অস্থিরতা, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সময় ফোনে ব্যয়, কাজ বা পড়াশোনায় অনীহা, সামাজিক ক্রিয়াকলাপ এড়িয়ে চলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ১৮-২৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীদের প্রায় ৪০% স্মার্টফোন আসক্তির প্রাথমিক লক্ষণ প্রদর্শন করছে, যা তাদের একাডেমিক পারফরম্যান্স ও আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
- অনুভূতির অবক্ষয় ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: ‘ফোবো’ (Fear Of Being Offline) বা ‘নোমোফোবিয়া’ (No Mobile Phobia) – এই নতুন ফোবিয়াগুলো সরাসরি মোবাইল নির্ভরতারই ফসল। পাশে মানুষ থাকলেও আমরা ডুবে থাকি ভার্চুয়াল জগতে। বাস্তব জীবনের আড্ডা, চোখাচোখি, আবেগের সরাসরি বিনিময় কমে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ‘হাইলাইট রিল’ বা ‘কিউরেটেড লাইফ’ দেখে অন্যের জীবনকে ‘আদর্শ’ ভেবে নিজের জীবনে হতাশা, হীনমন্যতা এবং উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীরা এর শিকার হচ্ছে বেশি, যাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও আত্মপরিচয় গঠনের সময় এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সিলেটের একটি স্কুলের কাউন্সেলর জানান, ফোনে অতিরিক্ত সময় কাটানোর কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক মেলামেশার ভয় ও বাস্তব জীবনে যোগাযোগের দক্ষতা কমে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
- মনোযোগের সংকট (অ্যাটেনশন স্প্যান কমে যাওয়া): মোবাইল ফোনের ক্রমাগত বিক্ষেপণ (ইন্টারাপশন) – নোটিফিকেশন, ভাইব্রেশন, বারবার চেক করার প্রবণতা – আমাদের মনোযোগকে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। গভীরভাবে কোনো কাজে মনোনিবেশ করা, দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশোনা করা বা একটি বইয়ের পাতায় ডুবে থাকা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। এই ‘কন্টিনিউয়াস পার্শিয়াল অ্যাটেনশন’ দীর্ঘমেয়াদে সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়।
- সাইবার বুলিং ও মানসিক আঘাত: মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়েছে। অপমানজনক মেসেজ, অপপ্রচার, ব্যক্তিগত তথ্য লিক হওয়া, অনাকাঙ্ক্ষিত ছবি বা ভিডিও শেয়ার – এসব ঘটনা, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে গভীর মানসিক আঘাত, বিষণ্ণতা, আত্মবিশ্বাসহীনতা এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়িয়ে দিতে পারে। ঢাকায় অবস্থিত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের তথ্য অনুসারে, সাইবার বুলিং সংক্রান্ত মানসিক সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মোবাইল ফোনের ক্ষতি ও প্রতিকার: শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য বিশেষ হুঁশিয়ারি (H2)
শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর প্রভাবের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী। তাদের দেহ ও মন এখনও বিকাশমান অবস্থায় রয়েছে:
- বিকাশগত ঝুঁকি: অত্যধিক স্ক্রিন টাইম শিশুদের শারীরিক ক্রিয়াকলাপ কমিয়ে দেয়, স্থূলতা বাড়ায়, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া শেখার সুযোগ হ্রাস করে এবং ভাষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। ছোট শিশুরা বাস্তব জগতের স্পর্শ, গন্ধ, স্বাদ এবং সরাসরি খেলাধুলার মাধ্যমে শেখার পরিবর্তে প্যাসিভলি স্ক্রিনের সামনে সময় কাটায়।
- মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব: শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা সোশ্যাল মিডিয়ার চাপ, সাইবার বুলিং এবং অনুপযুক্ত কন্টেন্টের সংস্পর্শে আসার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। এটি তাদের মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, আত্মসম্মান কমে যাওয়া এবং ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। অনেক শিশু আসক্তির লক্ষণও দেখাতে শুরু করে।
- চোখের স্থায়ী ক্ষতি: অল্প বয়সে দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ব্যবহার শিশুদের চোখের উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে এবং ক্ষীণদৃষ্টি (মায়োপিয়া) হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুযায়ী, ২ বছর বয়সের নিচে কোনো শিশুরই স্ক্রিন এক্সপোজার না থাকাই উত্তম। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী ও শিশু বিশেষজ্ঞরা অভিভাবকদের “মোবাইল ফোনের ক্ষতি ও প্রতিকার:জরুরি নির্দেশিকা” মেনে শিশুদের স্ক্রিন টাইম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিচ্ছেন।
মোবাইল ফোনের ক্ষতি ও প্রতিকার: ব্যবহারবিধি ও সরকারি নির্দেশিকা (H2)
ঝুঁকি জেনেও মোবাইল ফোনকে বর্জন করা যুগের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। তাই জরুরি হচ্ছে সচেতন ও নিরাপদ ব্যবহার নীতি (Safe and Responsible Usage Policy) মেনে চলা। এখানে কিছু কার্যকরী প্রতিকার ও সরকারি নির্দেশনার আলোকে পরামর্শ:
- স্ক্রিন টাইম ম্যানেজমেন্ট (সময় ব্যবস্থাপনা):
- ডিজিটাল ডিটক্স: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় (যেমন: খাওয়ার সময়, পরিবারের সাথে আড্ডার সময়, ঘুমানোর অন্তত ১ ঘণ্টা আগে) মোবাইল ফোন থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকুন। সাপ্তাহিক ডিজিটাল ডিটক্সের পরিকল্পনা করুন।
- অ্যাপের ব্যবহার মনিটর করুন: ফোনের বিল্ট-ইন স্ক্রিন টাইম ট্র্যাকার (আইওএস-এ ‘স্ক্রিন টাইম’, অ্যান্ড্রয়েডে ‘ডিজিটাল ওয়েলবিং’) অথবা থার্ড-পার্টি অ্যাপ ব্যবহার করে প্রতিদিন কতক্ষণ কোন অ্যাপে সময় কাটাচ্ছেন তা ট্র্যাক করুন। লক্ষ্য নির্ধারণ করে সময়সীমা বেঁধে দিন।
- নোটিফিকেশন কন্ট্রোল: অপ্রয়োজনীয় সব নোটিফিকেশন বন্ধ করুন। শুধু অত্যন্ত জরুরি অ্যাপের নোটিফিকেশন চালু রাখুন। এটি বিক্ষেপণ কমাবে।
- দৈহিক সুরক্ষা (এরগোনমিক্স):
- ২০-২০-২০ নিয়ম: প্রতি ২০ মিনিট স্ক্রিনের দিকে তাকানোর পর, অন্তত ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরের কোনো বস্তুর দিকে তাকান। চোখের পেশীকে বিশ্রাম দিন।
- সঠিক ভঙ্গি: ফোন ব্যবহারের সময় মাথা সোজা রাখার চেষ্টা করুন। ফোনটিকে চোখের লেভেলে তুলে ধরুন, ঘাড় নিচু করে তাকাবেন না। মেরুদণ্ড সোজা রাখুন। সমতল জায়গায় ফোন রেখে স্ট্যান্ড ব্যবহার করাও ভালো।
- নীল আলো ফিল্টার: সন্ধ্যার পর থেকে ফোনে ‘নাইট মোড’ বা ‘ব্লু লাইট ফিল্টার’ চালু করুন। বিশেষ নীল আলো ব্লকিং চশমাও (Blue Light Blocking Glasses) ব্যবহার করতে পারেন।
- হেডসেট/স্পিকারের ব্যবহার: দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সময় ফোন সরাসরি কানে লাগিয়ে না রেখে হেডসেট (ব্লুটুথ বা ওয়্যার্ড) বা স্পিকার মোড ব্যবহার করুন। ফোন শরীর থেকে দূরে রাখুন।
- মানসিক সুস্থতা ও সামাজিক সংযোগ:
- বাস্তব জগতে সংযোগ: সচেতনভাবে ফোন রেখে পরিবার, বন্ধুবান্ধবের সাথে মানসম্পন্ন সময় কাটান। চোখাচোখি করে কথা বলুন, প্রকৃতির সান্নিধ্যে যান, শখের চর্চা করুন।
- সোশ্যাল মিডিয়া ডায়েট: সোশ্যাল মিডিয়ায় দৈনিক সময়সীমা বেঁধে দিন। অপ্রয়োজনীয় অ্যাকাউন্ট আনফলো করুন। মনে রাখুন, সোশ্যাল মিডিয়া বাস্তব জীবনের ‘হাইলাইট রিল’ মাত্র।
- মাইন্ডফুলনেস ও মেডিটেশন: মনকে স্থির করতে ধ্যান বা মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস করুন। এটি স্ট্রেস কমাতে ও ফোকাস বাড়াতে সাহায্য করে।
- শিশুদের জন্য বিশেষ নির্দেশনা:
- বয়সভিত্তিক নিয়ম: ২ বছরের নিচে স্ক্রিন এক্সপোজার নয়। ২-৫ বছর: দিনে সর্বোচ্চ ১ ঘণ্টা, উচ্চমানের শিক্ষামূলক কন্টেন্ট, অভিভাবকের সাথে দেখা। বড় শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য দৈনিক সময়সীমা নির্ধারণ করুন (যেমন: স্কুলের কাজ ছাড়া ১-২ ঘণ্টা)।
- সক্রিয় অংশগ্রহণ: শিশুরা যা দেখছে বা খেলছে, তা নিয়ে তাদের সাথে কথা বলুন। একসাথে শিক্ষামূলক অ্যাপ বা গেম খেলুন।
- স্ক্রিন-ফ্রি জোন ও সময়: শোবার ঘর, খাবার টেবিল স্ক্রিন-ফ্রি জোন রাখুন। ঘুমানোর অন্তত এক ঘণ্টা আগে স্ক্রিন ব্যবহার বন্ধ করুন।
- রোল মডেল হওয়া: অভিভাবকদের নিজেদের মোবাইল ব্যবহারের অভ্যাসই শিশুদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা ও নির্দেশিকা (H3)
বাংলাদেশ সরকার, বিশেষ করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, মোবাইল ফোনের নিরাপদ ব্যবহার ও বিকিরণ সংক্রান্ত ঝুঁকি প্রশমনে জনসচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (BTRC) নেটওয়ার্ক অপারেটরদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট মান (Specific Absorption Rate – SAR) মেনে চলা নিশ্চিত করে এবং জনগণকে নিরাপদ দূরত্বে ফোন রাখা, হ্যান্ডস-ফ্রি ডিভাইস ব্যবহার এবং দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা না বলার পরামর্শ দিয়ে থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও স্ক্রিন টাইম কমানো ও শারীরিক সচলতা বাড়ানোর উপর জোর দেয়। জনসচেতনতামূলক প্রচারণা এবং স্কুল-কলেজে সেমিনারের আয়োজনও করা হয়। সরকারি এই মোবাইল ফোনের ক্ষতি ও প্রতিকার:জরুরি নির্দেশিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট বা বিটিআরসির রিসোর্স সেকশন পরিদর্শন করতে পারেন।
জেনে রাখুন (FAQs) (H2)
প্রশ্ন: মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রেডিয়েশন (বিকিরণ) কি সত্যিই ক্যান্সারের কারণ?
উত্তর: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা (IARC) মোবাইল ফোনের রেডিওফ্রিকোয়েন্সি বিকিরণকে “সম্ভবত মানুষের জন্য কার্সিনোজেনিক” (Group 2B) হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। এর মানে প্রাণী পরীক্ষায় কিছু প্রমাণ আছে, কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে সরাসরি ও সুস্পষ্ট কারণ-প্রভাব সম্পর্ক প্রমাণিত নয়। ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম, বিশেষ করে আধুনিক ফোনের নিম্ন SAR মানের জন্য। তবে, দীর্ঘমেয়াদী উচ্চ মাত্রার এক্সপোজার এড়াতে নিরাপদ ব্যবহারবিধি (হ্যান্ডস-ফ্রি, পকেটে না রাখা) মেনে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিস্তারিত জানতে WHO/IARC এর ওয়েবসাইট দেখুন।প্রশ্ন: “নীল আলো” (Blue Light) ঠিক কী ক্ষতি করে? রাতেও ফোন ব্যবহার করব কীভাবে?
উত্তর: মোবাইল স্ক্রিনের নীল আলো চোখের রেটিনার কোষের ক্ষতি করতে পারে, ডিজিটাল আই স্ট্রেন বাড়ায় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, ঘুমের হরমোন মেলাটোনিনের উৎপাদন দমন করে। এর ফলে ঘুম আসতে দেরি হয়, ঘুমের গভীরতা কমে যায়। রাতে ফোন ব্যবহার করতেই হলে: ১. ফোনের ‘নাইট শিফ্ট’/’ব্লু লাইট ফিল্টার’ চালু করুন (সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত অটো), ২. ব্রাইটনেস কম রাখুন, ৩. ঘুমানোর কমপক্ষে ১ ঘণ্টা আগে ফোন ব্যবহার বন্ধ করুন, ৪. বেডরুমে ফোন না রাখাই ভালো বা সাইলেন্ট/এয়ারপ্লেন মোডে রাখুন।প্রশ্ন: শিশুকে শান্ত রাখতে বা খাওয়ানোর সময় মোবাইল ফোন/ট্যাবলেট দেওয়া কি ঠিক?
উত্তর: একদমই অনুচিত, বিশেষ করে ২ বছরের কম বয়সী শিশুর জন্য। এটি তাদের ভাষা শেখা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া এবং সৃজনশীল খেলার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এটি অভ্যাসে পরিণত হলে স্ক্রিন ছাড়া শিশুকে শান্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। খাওয়ানোর সময় স্ক্রিন দেখলে শিশুরা খাবারের প্রতি মনোযোগ দেয় না, যা খাদ্যাভ্যাসের সমস্যা তৈরি করতে পারে। শিশুকে বাস্তব জগতের খেলনা, বইপড়া বা আপনার সরাসরি খেলায় ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন। আমাদের নিবন্ধে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য বিশেষ হুঁশিয়ারি অংশে আরও বিস্তারিত আছে।প্রশ্ন: আমি কি স্মার্টফোনে আসক্ত? কীভাবে বুঝব এবং প্রতিকার কী?
উত্তর: আসক্তির কিছু লক্ষণ: ফোন ছাড়া অস্থির/উদ্বিগ্ন বোধ করা, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সময় ফোনে কাটানো, কাজ বা পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে না পারা, ফোন ব্যবহার কমাতে ব্যর্থ হওয়া, সামাজিক সম্পর্ক বা শখের কাজ উপেক্ষা করা, লুকিয়ে ফোন ব্যবহার করা। প্রতিকারের জন্য: স্ক্রিন টাইম ট্র্যাক করা ও সীমা নির্ধারণ, নোটিফিকেশন বন্ধ করা, ডিজিটাল ডিটক্স পালন করা, ফোন-ফ্রি জোন তৈরি করা, বাস্তব জীবনের শখ ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপে সময় দেওয়া, প্রয়োজনে মনোবিদের সাহায্য নেওয়া। মোবাইল ফোনের ক্ষতি ও প্রতিকার:জরুরি নির্দেশিকা অনুসরণ করুন।প্রশ্ন: ঘাড় ও কাঁধের ব্যথা থেকে রক্ষা পেতে ফোন ব্যবহারের সময় কী করব?
উত্তর: টেক্সট নেক এড়াতে: ফোনটিকে চোখের লেভেলে তুলে ধরুন, ঘাড় নিচু করে তাকাবেন না। দীর্ঘক্ষণ টেক্সটিং বা স্ক্রলিং এড়িয়ে চলুন। প্রতি ১৫-২০ মিনিট পর পর ঘাড় ও কাঁধের হালকা স্ট্রেচিং করুন (চক্রাকারে ঘাড় ঘোরানো, কাঁধ ওপরে-নিচে তোলা)। ফোনে কথা বলার সময় হ্যান্ডস-ফ্রি ব্যবহার করুন যাতে হাত ও কাঁধ মুক্ত থাকে। দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা হলে ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নিন।- প্রশ্ন: সরকার মোবাইল ফোনের নিরাপদ ব্যবহার নিয়ে কী নির্দেশনা দেয়?
উত্তর: বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (BTRC) নেটওয়ার্ক অপারেটরদের মাধ্যমে বিকিরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং জনগণকে নিরাপদ ব্যবহারবিধি (যেমন: ফোন শরীর থেকে দূরে রাখা, হ্যান্ডস-ফ্রি ব্যবহার, দীর্ঘক্ষণ কানে লাগিয়ে কথা না বলা, ভাল সিগন্যাল এলাকায় কথা বলা) সম্পর্কে সচেতন করে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় স্ক্রিন টাইম কমানো, শারীরিক সক্রিয়তা বাড়ানো এবং শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের উপর জোর দেয়। সরকারি মোবাইল ফোনের ক্ষতি ও প্রতিকার:জরুরি নির্দেশিকা সম্পর্কে বিস্তারিত ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে পাওয়া যেতে পারে।
এই নিবন্ধটি আপনাকে সতর্ক করলেও আশাহত করার জন্য নয়। মোবাইল ফোন আমাদের আধুনিক জীবনের এক অনিবার্য অংশ। কিন্তু তার সুফল ভোগ করতে গিয়ে যেন আমরা এর নীরব ঘাতক রূপকে আমন্ত্রণ জানাই না, সেটাই জরুরি। “মোবাইল ফোনের ক্ষতি ও প্রতিকার:জরুরি নির্দেশিকা” শিরোনামের এই আলোচনা শুধু সমস্যাই চিহ্নিত করেনি, হাতিয়ারও দিয়েছে। আপনার চোখ, ঘাড়, মেরুদণ্ডের কথা ভাবুন; আপনার অনিয়ন্ত্রিত ঘুম, উড়ে যাওয়া মনোযোগ, ফিকে হয়ে যাওয়া বাস্তব সামাজিক সম্পর্কের দিকে তাকান। আপনার সন্তানের বিকাশমান দেহ ও কোমল মনের দিকে নজর দিন। প্রতিটি ক্ষতির বিপরীতে রয়েছে সহজ কিছু প্রতিকার – সময়সীমা বাঁধা, ভঙ্গি সচেতন হওয়া, নীল আলো ফিল্টার চালু করা, ডিজিটাল ডিটক্স পালন করা, বাস্তব সংযোগকে প্রাধান্য দেওয়া। সরকারি নির্দেশিকাও এই পথেই হাঁটার কথা বলে। আজই সিদ্ধান্ত নিন। আজই শুরু করুন। নিজের জন্য, আপনার প্রিয়জনের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই ডিজিটাল যুগে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখার এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলোই তৈরি করবে বড় পার্থক্য। আপনার হাতের মুঠোয় থাকা যন্ত্রটিকে করুন আপনার সেবক, প্রভু নয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।